Dr Khondaker Golam Moazzem on market, value chain and syndicate

নিত্যপণ্য সাধারণ ক্রেতাদের হাতে আসতে কয়েক ভাগে হাতবদল হয়। এ হাতবদলে কয়েক দফা দাম বাড়ে। প্রতি হাতেই কিছু না কিছু লাভ রাখে। এসব কারণেই দাম বাড়ে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ পাওয়ার আশায় বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে।

Published in Amader Shomoy on Tuesday, 20 October 2015.

সব সুবিধা সিন্ডিকেটের পেটে

আবু আলী ও আব্দুল্লাহ কাফি

সরকার বেশ কিছু নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক রহিত করলেও ফল পাচ্ছেন না সাধারণ ক্রেতা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পকেট ভারী হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের। তাদের অনৈতিক তৎপরতায় পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা। চাহিদা অনুসারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ থাকলেও দামের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন নেই বাজারে। জনসাধারণের জন্য যত সুবিধা তার ফলভোগী হয় সুরক্ষিত সিন্ডিকেট। ভোক্তাসাধারণ থেকে যায় সেই তিমিরেই।

সাধারণ ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজারব্যবস্থায় এখন সরকারি হস্তক্ষেপ নেই বললেই চলে। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল এবং দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা বর্তমান সরকারের অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। পদক্ষেপ হিসেবে বেশ কিছু নিত্যপণ্যে সরকার শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শুল্ক নেই। কিন্তু সম্প্রতি পেঁয়াজ নিয়ে ঘটেছে লঙ্কাকা-। চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এখনো তা স্বাভাবিক হয়নি। ডাল আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। অন্যদিকে চাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ছিল। কিন্তু দেশের বাজারে চাহিদার চেয়ে বেশি চাল থাকার পরও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে নিম্নমানের চাল আমদানি করে। তা বন্ধে এবং দেশি উৎপাদনের দিকে নজর দিয়ে চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এ ছাড়া নামমাত্র শুল্ক পরিশোধ করতে হয় রসুন আমদানিতে। এ ক্ষেত্রে শুল্ক রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। আদা ও হলুদ আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। পামঅয়েলে ২০, সয়াবিনে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ রয়েছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, সরকার আমদানি শুল্কমুক্ত বা সামান্য শুল্কে আমদানির সুযোগ দিলেও তার প্রতিফলন নেই বাজারে। অর্থাৎ সরকার সাধারণ মানুষের জন্য এ সুবিধা দিলেও লাভবান হচ্ছেন মূলত ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর সরবরাহ দেশজ উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে তা সরবরাহ করা হয়। চাহিদা ও জোগানের পার্থক্য হলে বাজারে প্রভাব পড়ার কথা। কিন্তু আমাদের বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর অনৈতিক তৎপরতার কারণে হঠাৎ অস্বাভাবিক বেড়ে যাচ্ছে এসব পণ্যের দাম। ফলে সাধারণ ক্রেতাদের অসহনীয় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট সম্পর্কে খোদ সরকারও জানে। এ ছাড়া গোয়েন্দা নজরদারিতেও এটি চিহ্নিত। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপটে এই সিন্ডিকেট বরাবরই সুরক্ষিত। তাই নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবসায়ীরা।

যুগের পর যুগ কিছু উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী এভাবেই ভোক্তাদের পকেট কেটে মুনাফা লুটে নিচ্ছেন। এই অপতৎপরতা বন্ধে তিন বছর আগে করা হয় প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২। ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইনটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ে সুস্থ প্রতিযোগিতা হবে। এতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি পণ্যের ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে পারবে সরকার। কিন্তু নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভোক্তাদের স্বার্থে করা আইনটি আলোর মুখ দেখতে পারেনি। ভোক্তাদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১৭ পণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ১৭ পণ্যের একটি হলো মসলাজাতীয় পণ্য পেঁয়াজ। সম্প্রতি আকাশছোঁয়া দামে উঠে যায় পেঁয়াজ। সর্বোচ্চ ৯০ টাকা বাড়ানোর পর এখন তা ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটাই বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকার কারণে নিত্যপণ্যের দরদাম নিয়ে এ ধরনের কারসাজি হচ্ছে। এ জন্য দ্রব্যমূল্য নিয়ে বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন। দেশে যে প্রতিযোগিতা আইন রয়েছে সেটি বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক চিহ্নিত ১৭ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হচ্ছেÑ পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, শুকনা মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনে, জিরা, আদা, হলুদ, তেজপাতা, সয়াবিন তেল, পামতেল, চিনি ও খাদ্য লবণ। এই ১৭ পণ্যের দাম নিয়ে কারসাজি করা হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ও নিবন্ধন বাতিল এবং পণ্য বাজেয়াপ্ত করার কথা রয়েছে। শুধু তাই নয়, সাবধানতা অবলম্বনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিপণনের সব পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট আইন, আদেশ এবং বিধি অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এসবের কিছুই মানছেন না। সময়, সুযোগ ও চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে হরহামেশা বাড়ানো হচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম।

চাহিদা ও সরবরাহ : দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২২ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে ১৯ লাখ ৩০ টন পেঁয়াজ দেশে উৎপাদিত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশে পেঁয়াজের কোনো মজুদ সংকট নেই। যেসব পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, সেগুলোও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে কেনা। শুধু তাই নয়, আমদানিকৃত ৩ লাখ টন পেঁয়াজের কাস্টমস নিষ্পত্তি হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে পেঁয়াজের দর বেড়ে যাওয়ার আগেই। তার পরও হঠাৎ করে পেঁয়াজের দাম ১০০ ভাগ বেড়েছে।

দেশে ৫ লাখ টন রসুন ও ৩ লাখ টন আদার চাহিদা রয়েছে। গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টন রসুন ও ৭৭ হাজার টন আদা উৎপন্ন হয়েছে। প্রতি বছর চায়না থেকে ৮৩ হাজার টন রসুন আমদানি করা হয়। গরম মসলা বিশেষ করে এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৫০০ টন এলাচ, ৭ হাজার ৬০০ টন দারুচিনি, ১৭০ টন লবঙ্গ ও ১০ দশমিক ৩১ টন জিরা আমদানি করা হয়। তার পরও নিয়ন্ত্রণে নেই এসব নিত্যদিনের মসলার বাজার। দেশে সারা বছরে প্রায় ১৬ দশমিক ৫৮ লাখ টন লবণের চাহিদা রয়েছে। দেশে বার্ষিক উৎপাদন ১২ দশমিক ৮২ লাখ টন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এসএ কাদের কিরণ বলেন, আমদানিকারকরাই এ সুবিধা পান; ভোক্তা পর্যন্ত এ সুবিধা আসে না। ভোক্তা পর্যায়ে যাতে এ সুবিধা আসে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। তাহলে হয়তো সাধারণ ভোক্তারা এ সুবিধা পাবেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান আমাদের সময়কে জানান, নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রথমে প্রতিযোগিতার বাজার হতে হবে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকলে যে যার মতো করে দাম বাড়াতে পারবেন না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যদি আঁতাত থাকে এবং সরবরাহ চেইন ঠিক না থাকে তখনই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মধ্যে সরবরাহ চেইন কমিয়ে আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারকে আমদানি-রপ্তানি নীতি, উৎপাদন এবং সরবরাহ নীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি রাস্তাঘাটের চাঁদাবাজি কমিয়ে আনতে হবে। পণ্যবাহী প্রতি ট্রাকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদার টাকা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে পড়ে। এ কারণেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে হবে। এ ছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে শুধু একটি দেশের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। বিকল্প দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি টিসিবির সক্ষমতা বাড়ানোরও পরামর্শ দেন বিপণন বিশেষজ্ঞ।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নিত্যপণ্য সাধারণ ক্রেতাদের হাতে আসতে কয়েক ভাগে হাতবদল হয়। এ হাতবদলে কয়েক দফা দাম বাড়ে। প্রতি হাতেই কিছু না কিছু লাভ রাখে। এসব কারণেই দাম বাড়ে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ পাওয়ার আশায় বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। এর পরই ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে আঁতাত করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে বাজারে শৃঙ্খলা আনা দরকার। কঠোর নজরদারি এবং সর্বোপরি ব্যবসায়ীদের মধ্য সততা থাকতে হবে। তা না হলে কোনোভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।