Dr Khondaker Golam Moazzem on RMG

বিশ্ববাজারে অনেক কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। তবে উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়াতে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে এমন বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হলে সস্তা পণ্যের গন্ডি পেরিয়ে দামি পোশাক রফতানিতেও বাংলাদেশ অন্যতম উৎস হতে পারে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

Published in Alokito Bangladesh on Friday, 18 September 2015.

পোশাক শিল্পে সুদিন ফিরছে
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রফতানি আয় ৪৪৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার

জাহিদুল ইসলাম

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশের রফতানি খাত। কয়েক মাসের সহিংসতায় অনেক বিদেশি ক্রেতাই রফতানি আদেশ অন্য দেশে স্থানান্তর করেছিলেন। তবে এসব ক্রেতা আবার ফিরে এসেছেন। তাছাড়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের চাহিদার আলোকে পোশাক শিল্পে সংস্কার কার্যক্রমও শেষ পর্যায়ে। সবকিছুর প্রভাবে এ খাতে সুদিন ফেরার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১৪ সালে বছরব্যাপী ও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতা পোশাক শিল্পের অগ্রগতির রাশ টেনে ধরে। এ সময়ে অনেক বিদেশি ক্রেতা হারায় পোশাক শিল্প। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতার সুবাদে স্বস্তি বিরাজ করছে পোশাক শিল্প খাতে। রফতানি আদেশ সরিয়ে নেয়া বিদেশি ক্রেতারাও ফিরে আসছেন। সব মিলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের পোশাক শিল্প। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরে পোশাক খাতের হাত ধরে রফতানি আয় ব্যাপক হারে বাড়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) পোশাক শিল্পে ৪৪৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার রফতানি আয় এসেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৪২৩ কোটি ১৮ লাখ ডলার। একক মাস হিসেবে আগস্টে রফতানি আয়ে প্রায় ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর এর বেশিরভাগই এসেছে পোশাক শিল্পের হাত ধরে। দুই মাসে ওভেন পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। আর নিটওয়্যার রফতানি বেড়েছে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

ইপিবি কর্মকর্তা ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের বড় দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা জানিয়েছেন, আক্ষরিক অর্থেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের পোশাক শিল্প। তবে প্রতিযোগী অন্যান্য দেশও এ সময়ে অনেক এগিয়েছে বলে তাদের ধারণা। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে ভারত, চীন ও পাকিস্তানের রফতানিকারকদের বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কার উদ্যোক্তারা কম সুদে ঋণের সুবিধা পাচ্ছেন। বিপরীত ধারায় বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের চাপে অবকাঠামো সংস্কারে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে এখনও কিছু ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বিদেশি ক্রেতারা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রফতানি আদেশ অন্য দেশে স্থানান্তর করেছিলেন। তবে এসব ক্রেতা আবার ফিরে এসেছেন। এর প্রভাবে রফতানি আয় সামনে আরও বাড়বে।

তবে আগস্ট মাসের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন রফতানিকারকদের সংগঠন ইএবি’র প্রেসিডেন্ট ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মোর্শেদী। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, প্রতিযোগী প্রায় সব দেশের মূল্য সক্ষমতা বাড়ছে। অনেক দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তেলের দাম কমিয়েছে অনেক দেশ। সুদের হার প্রায় সব দেশেই তুলনামূলক কম। তাছাড়া সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আরেক দফায় বাড়ানো হয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় রফতানি শিল্প এখনও চাপে রয়েছে। তবে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশ-বিদেশে সঙ্কটে পড়া ইমেজ বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা ফিরে পেয়েছেন।

বিদেশে ইতিবাচক অবস্থান ফিরে আসায় ক্রেতারা ফিরে আসছেন বলে মনে করেন বিকেএমইএ’র সাবেক প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাতেম। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায় ৪০ শতাংশ রফতানি আদেশ বাতিল হয়। সম্প্রতি এসব ক্রেতা আবার রফতানি আদেশ বাড়াচ্ছেন। এর সুফল পাওয়া যাবে চলতি বছরের শেষের দিকে। তিনি জানান, বড়দিনকে কেন্দ্র করে বড় আকারে পোশাক রফতানি হলেও এবার আদেশ পাওয়া গেছে কম। তবে গরম মৌসুমের রফতানি আদেশ পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর।

জানা যায়, ব্যবসায় মুনাফার কথা বিবেচনা করেই আশির দশকে বাংলাদেশে আসেন বিদেশি ক্রেতারা। প্রথমবার মাত্র ১২ হাজার ডলারের পোশাক রফতানি হলেও বর্তমানে এ খাতে আয় হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। ১৯৮১ সালে মোট রফতানি আয়ের দশমিক ১ শতাংশ আসত পোশাক শিল্পের হাত ধরে। বর্তমানে রফতানি আয়ের ৭৯ দশমিক ২ শতাংশ আসছে এ খাতের হাত ধরে।

সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য মিশ্র ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা মন্থর হয়ে এসেছে। এর প্রভাবে রফতানি প্রত্যাশিত হারে নাও বাড়তে পারে। মুদ্রা বিনিময় হারে অনেক দেশ সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তি সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে এ অসুবিধাটিও কেটে আসছে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য। পোশাক খাতের সংস্কার প্রক্রিয়ায় করণীয় এরই মধ্যে নির্ধারণ হয়েছে। তাছাড়া পরিদর্শন শেষে অনেক প্রতিষ্ঠানই শতভাগ কমপ্লায়েন্স হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববাজারে অনেক কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে। তবে উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়াতে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে এমন বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হলে সস্তা পণ্যের গন্ডি পেরিয়ে দামি পোশাক রফতানিতেও বাংলাদেশ অন্যতম উৎস হতে পারে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

বাধা অর্থ সঙ্কট : বিদেশি ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে চিহ্নিত পোশাক কারখানাগুলোর সংস্কার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থ সঙ্কটে। একই ভবনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদ্যমান কারখানা স্থানান্তর জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব শর্ত পূরণে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের উদ্যোক্তাদের পক্ষে এ অর্থের জোগান দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠনের নেতারা। সঙ্কট উত্তরণে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও ক্রেতা জোটের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের সন্ধান করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এরই মধ্যে দাতাদের ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ইআরডির কর্মকর্তারা।

একগুচ্ছ উদ্যোগ : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় প্রণয়ন করা হয় ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান। এর বাস্তবায়নে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ ও আঞ্চলিক সংস্থা। জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও বিশ্বব্যাংকের সহায়ক সংস্থা আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এগিয়ে আসে স্বল্প সুদের ঋণ নিয়ে। একই সময়ে আইএলও এবং আইএফসি যৌথভাবে প্রণয়ন করে বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচি। এ সব কিছুর প্রভাবে পোশাক খাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে।

কারখানায় কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও এখন অনেক জোর দিয়ে দেখা হচ্ছে। এ সময়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা পরিদর্শন করতে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতারা গঠন করে অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং অ্যান্ড ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতারা এসময় গঠন করেন অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি। এ দুটি ক্রেতা জোট বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি প্রতিনিধি দলও এগিয়ে এসেছে কারখানা পরিদর্শনে। সবকিছুর প্রভাবে পোশাক খাতে অনেকটা স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ফিরে এসেছে।

সামনে উজ্জ্বল দিন : বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এতদিনে রৌদ্রোজ্জ্বল। দুর্নামের পরও মূলত কম দামে পোশাক সরবরাহ করায় ক্রেতারা বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছেন না বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আর স্বল্প দামে পোশাক উৎপাদনের পেছনে রয়েছে কম বেতনে শ্রমিক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা।

বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা ঘণ্টায় গড়ে ২১ সেন্ট মজুরি পান। প্রতিবেশী ভারতে এ খাতে মজুরি ৫৫ থেকে ৬৮ সেন্ট। এ হিসেবে ভারতে পোশাক খাতে মজুরি বাংলাদেশের তিনগুণ। সাড়ে চারগুণ বেশি হিসেবে চীনের শ্রমিকরা পান ৯৩ সেন্ট। এর বাইরে কম্বোডিয়ায় ২৪ সেন্ট, ইন্দোনেশিয়ায় ৩৫ সেন্ট, পাকিস্তানে ৩৭ সেন্ট, শ্রীলঙ্কায় ৪৬ সেন্ট, ভিয়েতনামে ৫২ সেন্ট, গুয়াতেমালায় প্রতি ঘণ্টায় ১ ডলার ২১ সেন্ট দেয়া হয় পোশাক শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে।