Dr Khondaker Golam Moazzem on RMG and TPP

বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন।

Published in Ittefaq on Tuesday, 27 October 2015.

পিছিয়ে পড়ছে গার্মেন্টস

রিয়াদ হোসেন

গার্মেন্টস রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিযোগী দেশগুলো ভালো করছে। বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৪ শতাংশ বাড়লেও একই সময়ে ভারত, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের বেড়েছে যথাক্রমে ১০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ও প্রায় ৭ শতাংশ হারে।

বাংলাদেশের রপ্তানির ৮১ শতাংশই আসে গার্মেন্টস রপ্তানি থেকে। স্বাভাবিকভাবেই গার্মেন্টস রপ্তানিতে নেতিবাচক কোন কিছুর প্রভাবে পড়ে সার্বিক রপ্তানিতে। গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ হলেও গার্মেন্টস রপ্তানি কমে যাওয়ায় গত অর্থবছর এই প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৪ শতাংশে। উল্লেখ্য, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গার্মেন্টস রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি প্রকৃত অর্থে বাড়েনি। বরং প্রকৃত রপ্তানি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কম হয়েছে। অথচ একই সময়ে প্রধান প্রতিযোগী চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত, ফিলিপাইন, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার প্রকৃত রপ্তানি বেড়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে গার্মেন্টস রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে বাংলাদেশ। বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, দেড় দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের শেয়ার ছিল ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ আর ভিয়েতনামের একেবারেই সামান্য (মাত্র দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ)। অথচ ২০১৪ সালে একই বাজারে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ আর ভিয়েতনামের বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগীরা ভাল করেছে। পাকিস্তান, ভিয়েতনাম   ও কম্বোডিয়া ইউরোপের বাজারে এবং ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও হন্ডুরাস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে ভাল করেছে।  বাংলাদেশের রপ্তানি কমার অন্যতম কারণ হিসেবে গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তাকে দায়ী করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এছাড়া প্রধান রপ্তানি বাজারে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে না পারা, বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের দাম কমা ও ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো’র দর হারানোকে দায়ী করা হয়েছে।

বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, গত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে কিছু অর্ডার প্রতিযোগী দেশগুলোতে চলে গেছে। সেগুলো এখনো ফেরত আসেনি। প্রতিযোগী সব দেশের মুদ্রার মান কমেছে কিন্তু আমাদের দেশে টাকার বিপরীতে ডলার দুর্বল হয়েছে। রানা প্লাজা আর তাজরীন দুর্ঘটনা প্রভাব ফেলেছে। এখন সংস্কারের জন্য আমাদের কারখানা প্রতি গড়ে ৫ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে পণ্যের উত্পাদন খরচ বাড়লেও ইউরোপ ও আমেরিকায় পণ্যের দাম কম পাচ্ছি। এসব বিবেচনায় প্রতেযোগিতার ক্ষমতা বাড়াতে রপ্তানিকারকদের জন্য টাকার বিপরীতের ডলারের বিনিময় হার ঠিক করে দেয়া প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

অর্থনীতিবিদরাও বাংলাদেশে পিছিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রা মান কমে যাওয়া ও বাংলাদেশের মুদ্রার দর বাড়ার প্রবণতাকে দায়ী করছেন। কেননা স্থানীয় মুদ্রার মান বাড়লে রপ্তানি পণ্যের বিপরীতে পূর্বের চাইতে কম অর্থ পাওয়া যায়।

বিজিএমইএ’র হিসাবে, বাংলাদেশের মুদ্রার মান বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। একই সময়ে ভিয়েতনামের কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের ৩৪ শতাংশ, চীনের ১ দশমিক ২৫ শতাংশ, পাকিস্তানের প্রায় ১৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ২১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ৬২ শতাংশ, তুরস্কের ৭১ শতাংশ ও রাশিয়ার কমেছে ১১৭ শতাংশ। অন্যদিকে ইউরোপ ও কানাডার মুদ্রার মানও কমেছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রপ্তানির প্রকৃত প্রবৃদ্ধির মূল্যায়নে দেখা গেছে, গত অর্থবছর বাংলাদেশের রপ্তানি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ কমলেও ভিয়েতনামের বেড়েছে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার প্রায় ৭ শতাংশ, চীনের সাড়ে ৫ শতাংশ, ভারতের ৩ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার সামান্য কমেছে, নেপালের বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ, ফিলিপাইনের বেড়েছে ৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডের দশমিক  ৮ শতাংশ বেড়েছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর দেয়া দরকার। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্থগিত হওয়া জিএসপি পুনরুদ্ধারে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া দরকার। বিশেষত সেখানে গার্মেন্টস পণ্য যাতে আরো সুবিধা পায়। এ জন্য শ্রম অধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে কারখানার কর্মপরিবেশ (কমপ্লায়েন্স) ঠিক করতে হবে। শতভাগ কমপ্লায়েন্স কারখানা থেকে পণ্য নেয়ার ক্ষেত্রে বায়াররা এগিয়ে এলে রপ্তানি বাড়বে। প্রতিযোগিতার ক্ষমতাও বাড়বে।

 

টিপিপি ও এর প্রভাব

অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশের মধ্যে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। চলতি বছরই চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এ চুক্তি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানির সুযোগ পাবে বাংলাশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। ফলে নতুন করে আবারো বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। বিশ্বব্যাংকের ওই  প্রতিবেদনে টিপিপি ছাড়াও ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের আরো একাধিক চুক্তির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে।

এতদিন বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে জিএসপি’র আওতায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পেত। সম্প্রতি পাকিস্তান ইউরোপের বাজারে ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা পেয়েছে। এ সুবিধার আলোকে তারাও এখন সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে যু্ক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামও এতদিন প্রায় ১৮ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে পণ্য রপ্তানি করতো। কিন্তু টিপিপি চুক্তিভুক্ত দেশ হওয়ায় এখন তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু বাংলাদেশকে প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে রপ্তানি করতে হবে। টিপিপি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে কানাডা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, চিলি, ব্রুনেই, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, পেরু ও যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, কানাডা বাংলাদেশের পোশাকের অন্যতম বড় বাজার। সেখানে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও ভিয়েতনাম পেত না। কিন্তু টিপিপি’র ফলে কানাডাতেও দেশটি শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। অন্যদিকে মেক্সিকোর বাজারে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামসহ অন্যান্য প্রতিযোগীর প্রায় ২৭ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু এখন থেকে ভিয়েতনামকে কোন শুল্ক দিতে হবে না। কিন্তু বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ঠিকই ২৭ শতাংশ শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, টিপিপি আমাদের পোশাক রপ্তানির জন্য বড় ধরনের হুমকি। টিপিপি কার্যকর হলে বাংলাদেশ আরো বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গার্মেন্টস খাত নিয়ে। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন।