জিএসপি ফেরতের প্লাটফর্ম হতে পারে ‘টিকফা’ – খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Dr Khondaker Golam Moazzem in an interview with Samakal, published on Sunday, 16 August 2015.

সাক্ষাৎকার

জিএসপি ফেরতের প্লাটফর্ম হতে পারে ‘টিকফা’

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। দীর্ঘ দিন ধরে বাণিজ্য নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। মাার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের স্থগিত হওয়া জিএসপি এবং দেশটির সামগ্রিক জিএসপি কর্মসূচি নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু হেনা মুহিব

সমকাল :সম্প্রতি জিএসপি কর্মসূচি নবায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু বাংলাদেশের জিএসপি ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে না। এতে কি বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হলো, নাকি বাংলাদেশের বিষয়টি ভিন্ন?

গোলাম মোয়াজ্জেম :জিএসপি নবায়নের সঙ্গে বাংলাদেশের জিএসপি ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত নয়। কারণ, জিএসপির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর পুনরায় নবায়ন হয়েছে। আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জিএসপি স্থগিত করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে শ্রম প্রতিনিধির কার্যালয়ের (ইউএসটিআর) দেওয়া ১৬ শর্তের অগ্রগতি নিয়ে এরই মধ্যে তিন দফা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়েছে। অগ্রগতিও সন্তোষজনক। তবে বেশ কিছু শর্তের কিছু অংশ এখনও বাকি রয়েছে। পরবর্তী মূল্যায়নে ইউএসটিআর বাংলাদেশের অগ্রগতি সন্তোষজনক মনে করলে জিএসপি ফিরিয়ে দিতে পারে। তবে এজন্য আবার পর্যালোচনায় বসতে হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, অভিযোগ পাওয়া অনেক দেশের বেলায়ই এটা হচ্ছে।

সমকাল :বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশের জিএসপি স্থগিত রয়েছে?

গোলাম মোয়াজ্জেম :এখন শুধু বাংলাদেশ এবং রাশিয়ার জিএসপি স্থগিত রয়েছে। তবে বিভিন্ন অভিযোগে আরও ১১টি দেশের জিএসপি পর্যালোচনা চলছে। যদিও এসব দেশের জিএসপি স্থগিত নেই। যেমন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে ২০০৭ সালে। তখন জিএসপি স্থগিত করা হয়নি। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের মতো বড় দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে, জিএসপি স্থগিত করতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

সমকাল :আর কোন দেশের বিরুদ্ধে এ-সংক্রান্ত আর কী অভিযোগ রয়েছে?

গোলাম মোয়াজ্জেম :বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়ে মার্কিন শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইও যেমন অভিযোগ করেছে, সংগঠনটি একই অভিযোগ করেছে ইরাক, জর্জিয়া ও ফিজির বিরুদ্ধে। ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে শেভরন করপোরেশন। ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইনটেললেকচুয়াল প্রপার্টি অ্যালায়েন্স। এ রকম অভিযোগ রয়েছে ফিলিপাইন, ইউক্রেন, উজবেকিস্তান ও নাইজারের বিরুদ্ধে।

সমকাল :অভিযুক্ত এসব দেশের জিএসপি তো স্থগিত করা হয়নি?

গোলাম মোয়াজ্জেম :আপাতত স্থগিত করা হয়নি। পর্যালোচনা চলছে। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেয়। কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলে এসব দেশের জিএসপি অব্যাহত থাকতে পারে। আবার সন্তোষজনক মনে না করলে স্থগিতও হয়ে যেতে পারে। এটা নিতান্তই মার্কিন কর্তৃপক্ষের নিজেদের বিষয়।

সমকাল :বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করা এবং দুই বছরের মাথায়ও পুনর্বহাল না করার পেছনে রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে?

গোলাম মোয়াজ্জেম :এটাকে এক বাক্যে রাজনীতি না বলাই ভালো। কারণ বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬ শর্তের সব বাস্তবায়নের কাজ শেষ করত এবং তার পরও জিএসপি ফিরিয়ে দেওয়া না হতো, তাহলে এ ধরনের অভিযোগের কথা আসতে পারত। আমি মনে করি, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ অভিযোগের ভিন্ন একটি তাৎপর্য আছে। সেটা হচ্ছে, এক ধরনের রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা। এটারও প্রয়োজন রয়েছে।

সমকাল :সরকারের এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৬ শর্তের প্রায় সবক’টিই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

গোলাম মোয়াজ্জেম :শর্তগুলোর মধ্যে অন্তত ১২টি পূরণ করা হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। তবে সংশোধিত শ্রম আইনের বিধিমালা হয়নি। কারখানার একটা তথ্য ভাণ্ডার হয়েছে; কিন্তু শ্রমিকদের তথ্য ভাণ্ডার হয়নি। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডে শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ে জটিলতা কাটেনি, চিংড়ি শিল্পে দুটি কমপ্লায়েন্স শর্তের বাস্তবায়ন নিয়ে কিছুই জানা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এ শর্তগুলো আংশিক পূরণ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে যত রকম সংস্কার হয়েছে, সেগুলোর ধারাবাহিকতা প্রয়োজন।

সমকাল :প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক তো কখনোই মার্কিন জিএসপি সুবিধার আওতায় ছিল না। আবার যেসব পণ্য এ সুবিধা পেত স্থগিত হওয়ার পরও সেসব পণ্যের রফতানি কমেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন জিএসপি বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

গোলাম মোয়াজ্জেম :শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের কোনো দেশেরই তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামো চুক্তি ( টিকফা) রয়েছে, সে হিসেবে প্রধান পণ্যকে জিএসপিভুক্ত করার বিষয়ে বাংলাদেশ জোরালো দাবি তুলতেই পারে। আর স্থগিত হওয়ার পরও গত দুই বছরে জিএসপিভুক্ত পণ্যের রফতানি আয় না কমার কারণটা একেবারেই কাকতালীয়। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ১২২ দেশের জিএসপির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। এর মাত্র দুই মাস পর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের এ সুবিধা স্থগিত করা হয়। ফলে সব দেশের পণ্যকেই শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে হয়েছে। এ সুযোগে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত হলেও আগে এ সুবিধা পাওয়া পণ্যগুলো প্রতিযোগিতার মুখে পড়েনি। এ কারণে এসব পণ্যের রফতানি গত দুই বছরে খুব একটা কমেনি। তবে ১২২ দেশের জিএসপি আবার নবায়ন হওয়ায় এবার বাংলাদেশের এসব পণ্য কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।

সমকাল :জিএসপি ফিরে পেতে বাংলাদেশ এখন কীভাবে এগোতে পারে?

গোলাম মোয়াজ্জেম :আমি মনে করি, এখন দুই ভাবে তৎপরতা চালাতে পারে বাংলাদেশ। প্রথমত, স্থগিত হওয়া জিএসপি পুনর্বহালের চেষ্টা করা এবং পোশাক শিল্পকে এ সুবিধার আওতায় আনার লবিং করা। এক্ষেত্রে অনেক বড় প্লাটফর্ম হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তি। এখানে বাংলাদেশ তার দাবি এবং যুক্তি তুলে ধরে দর কষাকষি করতে পারে। যদিও টিকফার মাধ্যমে সরাসরি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে না। তবে এর মাধ্যমে বাংলাদেশের এ-সংক্রান্ত দাবিটি জোরালো হতে পারে। টিকফার মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পোশাক খাতে অগি্ননিরাপত্তায় ব্যবহৃত ফায়ার ডোর আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছে। এ সুবাদে এখন তাদের ফায়ার ডোরের বড় রফতানির বাজার বাংলাদেশ।