Dr Khondaker Golam Moazzem on unemployment, investment and politics

Published in Kaler Kantho on Saturday, 24 May 2014.

কর্মসংস্থানে ভাটার টান
বেকারের সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে

রাজীব আহমেদ

দেশের শিল্প খাতে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে তৈরি পোশাক খাতে। এ খাতে একদিকে যেমন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কাজ করছে, তেমনি সব সময়ই শ্রমিকের ঘাটতি ছিল পোশাক কারখানাগুলোতে। চট্টগ্রামে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় গার্মেন্টের কর্মকর্তারা আগে মাইক্রোবাস নিয়ে ঘুরতেন; কাজ করার লোক পেলেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতেন পোশাক কারখানায়। কিন্তু গত ডিসেম্বরে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন এবং পর্যাপ্ত অর্ডার না থাকার কারণে সে অবস্থা এখন আর নেই। শ্রমিক আগের মতোই ঘুরছেন কারখানার দরজায় দরজায়; কিন্তু মালিকরা এখন আর নতুন নিয়োগে আগ্রহী নন।

এ দেশে বেকারত্ব নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে সর্বশেষ শ্রম জরিপ অনুযায়ী, প্রতিবছর চাকরির বাজারে শিক্ষিত-নিরক্ষর মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ মানুষ ঢুকছে। এ বিপুল শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ সীমিত। চাকরির বাজার থেকে সরকার এক রকম হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের চাপ বাড়ছে বেসরকারি খাতে।

নিশ্চিন্ত জীবিকা হিসেবে সরকারি চাকরির আকর্ষণ এখনো বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পদের তুলনায় প্রতিযোগিতা এত বেশি যে একজনের চাকরি হলে ১০০ জন বাদ পড়ে যান। সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ১৪টি শূন্যপদে নিয়োগের জন্য আবেদন পড়ে তিন হাজার ৬০টি। সেখানে প্রতি পদের জন্য লড়াই করেছেন ২১৯ জন।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে নজিরবিহীন রাজনৈতিক সহিংসতা ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই এক বছরে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে। ছোট ব্যবসায়ীরা পুঁজি খুইয়েছেন। আর নতুন করে যাঁরা শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রম জরিপ হয়েছে ২০১০ সালে। এর পরে বেকারত্বের হার বা সংখ্যা নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ব্যবসায়ী ও শ্রম বিশ্লেষকরা মনে করেন, বেকারত্বের হার এখন আগের চেয়ে বেশি। বেসরকারি খাতে চাকরিদাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সাবেক সভাপতি ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৩ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল। তখন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি তো হয়ইনি, বরং অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। আমার মনে হয়, বেকারত্ব আরো বেড়েছে।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এখনকার কর্মসংস্থান পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তাই পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করা যাবে না যে বেকারত্ব বেড়েছে। তবে লক্ষণ সে রকমই।’ তিনি বলেন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ কম হয়েছে। ফলে উৎপাদন খাতে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ ছিল তা হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও হরতাল-অবরোধের কারণে দেশীয় শিল্প খাতে উৎপাদন কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। স্বকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আয় সংকোচন হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে যে প্রবৃদ্ধির দরকার ছিল তা হয়নি। ফলে সেই লোকগুলো আবার দেশীয় শ্রমবাজারে চাপ তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে ২০১৩ সাল কর্মসংস্থানের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং বছর ছিল।

উন্নয়ন অন্বেষণ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষে করা এক গবেষণায় গবেষক জয়ন্ত কুমার বসাক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় দুই কোটি ৪৪ লাখ। এর মধ্যে কাজ করার বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি ১৪ লাখ। কিন্তু কর্মসংস্থান করা সম্ভব হয়েছে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষের। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসে। কিন্তু কর্মসংস্থান হয় ১৬ লাখ মানুষের।

২০১০ সালের তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে জয়ন্ত কুমার বসাক বলেন, এটা খুব সহজ হিসাব যে বিনিয়োগ কম হলে, উৎপাদনের গতি কমে গেলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিও কমে যায়।

অর্থনীতির গতিতে টান : অর্থনীতিতে টাকার সরবরাহ যত বেশি থাকে, পণ্য ও সেবা তত বেশি বিক্রি হয়। চাহিদা বেশি থাকলে উৎপাদন বাড়ে। উৎপাদন বাড়াতে হলে আরো বেশি কর্মী নিতে হয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। তাতে কর্মসংস্থান বাড়ে। মহাজোট সরকারের প্রথম দিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেশি ছিল। অর্থের জোগান বেশি থাকায় পণ্য ও সেবার চাহিদাও বেশি ছিল। কিন্তু মেয়াদের শেষ দিকে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গিয়ে সরকার বাজারে টাকার সরবরাহ কমিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ফর্মুলায় সে ব্যবস্থা নিয়ে সরকার মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু অর্থনীতির প্রসারণের গতিও তাতে কমে গিয়েছিল। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়ে ২০১৩ সাল বিপাকে ফেলেছে অর্থনীতিকে। ষষ্ঠ পাঁচসালা পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বাড়ার হার ৭.৬ শতাংশে নেওয়ার কথা। কিন্তু সেখান থেকে বাংলাদেশ এখন যোজন দূরত্বে।

বাড়ছে বেকারের সংখ্যা : শ্রম জরিপ ২০১০ অনুসারে, ২০০২-০৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে কর্মরত লোকের সংখ্যা ছিল প্রায় চার কোটি ৪৩ লাখ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে সে সংখ্যা প্রায় চার কোটি ৭৪ লাখে দাঁড়ায়। ২০১০ সালে কর্মরত মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় পাঁচ কোটি ৪১ লাখ হয়েছে। বছর বছর কর্মরত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও জনসংখ্যা অনুপাতে তা বাড়ছে না। ফলে বেকারের সংখ্যা ও বেকারত্বের হার বাড়ছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে বেকার মানুষের সংখ্যা ছিল ২০ লাখ। ২০১০ সালে তা ২৬ লাখে দাঁড়ায়। ২০০২-০৩ অর্থবছরে বেকারত্বের হার ছিল ৪.৩ শতাংশ। ২০১০ সালে তা ৪.৫ শতাংশে দাঁড়ায়।

তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের মাত্র ২৬ লাখ মানুষ বেকার। এর সঙ্গে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। ২০০২-০৩-এ প্রায় তিন কোটি ৪৫ লাখ মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে ছিল। ২০১০ সালে তা বেড়ে প্রায় তিন কোটি ৮৯ লাখে দাঁড়ায়।

এককভাবে দেশে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে কৃষি খাতে। কিন্তু বছর বছর কর্মসংস্থানে কৃষির অংশীদারি কমছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে কৃষি খাতে কাজ করত ৫১.৭ শতাংশ মানুষ। ২০১০ সালে তা ৪৭.৩ শতাংশে নামে। আনুষ্ঠানিক খাতের অংশও কমছে। ২০০২-০৩ সালে আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করত মোট শ্রমশক্তির ৯.২ শতাংশ, যা ২০১০ সালে কমে ৬.৮ শতাংশে দাঁড়ায়। একটি পদের বিপরীতে আবেদনের হার দেখেও চাকরি খোঁজা বেকারের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় লোক নিয়োগের কথা ছিল দুই হাজার ৫২টি পদে। এতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে আবেদন করেন দুই লাখ ২১ হাজার ৫৭৫ জন। অর্থাৎ প্রতি পদের বিপরীতে আবেদন ছিল ১০৮টি। রাজধানী শহরে প্রার্থী বেশি, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও বেশি; কিন্তু পিছিয়ে থাকছে না জেলা শহরও। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে স্বাস্থ্য সহকারীর ১০৭টি পদে আবেদন করেছেন সাত হাজার ৭০৪ জন। অর্থাৎ প্রতি পদের বিপরীতে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা ৭২। জয়ন্ত কুমার বসাক বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছেই।

কর্মসংস্থানে চাই বিনিয়োগ : দেশের রপ্তানি খাতে নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। সরকারি খাতে জনপ্রশাসনে ব্যয় এত বেড়ে গেছে যে সেখানে ব্যাপক পরিমাণে নতুন কর্মী নিয়োগ করা সরকারের জন্য কঠিন। আবার সরকারি চাকরির বয়স বাড়ানোয় নতুনদের ঢোকার সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। কর্মসংস্থানে কৃষির অংশীদারি কমছে। আর মজুরি বেড়ে যাওয়ায় কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বাড়ছে। ফলে সেখানেও নতুন করে বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার সুযোগ কমছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একমাত্র সুযোগ আছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। কিন্তু নতুন বিনিয়োগে গতি না থাকায় বাংলাদেশ বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিনিয়োগ নিবন্ধনে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। ২০১৩-১৪তেও অবস্থা ভালো যায়নি।

বিনিয়োগ বোর্ডে ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে এক হাজার ২৮৫ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব আসে। পরের বছর তা  এক হাজার ১১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। পরের বছর তা আরো কমে ৮৩৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরে মার্চ পর্যন্ত ৮৩৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা হয়েছে বোর্ডে। নির্বাচন-পরবর্তী তিন মাসে বিনিয়োগ বোর্ডে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের হার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে।

বিনিয়োগ হলেই কর্মসংস্থান হয়। এ জন্য বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সম্ভাবনা থাকার পরও বিনিয়োগ আশানুরূপ না হওয়ার পেছনে অবকাঠামো সংকটকে দায়ী করে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরি করা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন এবং পরে ছয় লেন করা, গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিসহ শিল্প সহায়ক প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে এবারের বাজেটে।

ফজলুল হক বলেন, অন্যদিকে বেসরকারি খাত যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি। এটা হলে বিনিয়োগ বাড়ানোও সম্ভব হবে। এতে কর্মসংস্থানও বাড়বে।