Professor Mustafizur Rahman on insurance policy

Published in Bonik Barta on Saturday 5 September 2015.

বীমা সেবার আওতার বাইরে ৮৮% পরিবার

আব্বাস উদ্দিন নয়ন

শাহাব উদ্দিন একটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। বেতন ও কমিশন বাবদ আয়, তাতে প্রয়োজন মিটিয়ে কিছু অর্থ সঞ্চয়ের সামর্থ্য রয়েছে তার। পরিচিত একজনের অনুরোধে এবং জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি বিবেচনা করে শাহাব উদ্দিন একটি জীবন বীমা কোম্পানিতে পলিসি খোলেন। ১০ বছর মেয়াদি পলিসিতে বছরে ৫ হাজার টাকা হারে প্রিমিয়াম দিলে মেয়াদ শেষে পাবেন দ্বিগুণের বেশি। আর কোনো কারণে তার মৃত্যু হলে পরিবার অথবা মনোনীতরা পুরো টাকাই পাবেন। বীমা কোম্পানির এজেন্ট পরিচিত হওয়ায় বছর শেষে তার কাছেই প্রিমিয়ামের অর্থ জমা দিতেন শাহাব উদ্দিন। কাজের ব্যস্ততায় খুব একটা খোঁজ নিতে পারতেন না। চার বছর পর বদলি হয়ে নতুন কর্মস্থলে যান তিনি। এজন্য কাগজপত্র হালনাগাদ ও ঠিকানা পরিবর্তন করতে বীমা অফিসে গিয়ে তিনি পড়েন বিপত্তিতে। তার নামে পলিসি খোলা থাকলেও তাতে প্রিমিয়াম জমা দেয়া হয়নি। পরিচিত বীমা এজেন্ট তার কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নিলেও তা জমা করেননি অফিসে। ফলে তামাদি হয়ে গেছে পলিসি।

বীমা কোম্পানিতে পলিসি খুলে শুধু তামাদি হওয়া নয়, মেয়াদ শেষ করে দাবির অর্থও পান না অনেক পলিসিধারী। ফলে বীমা নিয়ে সচেতনতা থাকলেও আস্থার অনুপস্থিতিতে এ সেবা নিতে আগ্রহী নয় দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ। জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা— দু’ক্ষেত্রেই আগ্রহ ও আস্থার সংকট প্রবল। দেশে মোট বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৭৭। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ৩০টি জীবন বীমা কোম্পানি পাঁচ থেকে ২৫ বছর মেয়াদি বিভিন্ন পলিসিতে স্বল্প বিনিয়োগের বিনিময়ে কাভারেজ অথবা সেবা দিতে চাইলেও এ সেবার আওতার বাইরে থেকে গেছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। যদিও দেশে ব্যাংক-বীমা, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংগঠনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সেবা নেয়ার হার ৯০ শতাংশ।

সম্প্রতি দেশের ৬৪ জেলার ৯০০ পরিবারের মধ্যে জরিপ করে, এমন তথ্য পেয়েছে ইনস্টিটিউট অব মাইক্রো ফিন্যান্স (আইএনএম)। নিজস্ব জরিপের পাশাপাশি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাউজহোল্ড সার্ভে প্রতিবেদনেরও সহায়তা নিয়েছে সংগঠনটি।

আইএনএমের জরিপে বলা হয়, আর্থিকভাবে সচ্ছল ও শহুরে পরিবারগুলো বীমা সেবায় কিছুটা সম্পৃক্ত হলেও গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ হার একেবারেই কম। ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার বীমা বিষয়ে সচেতন হলেও তামাদি হয়ে যাওয়া ও প্রতারণার কারণে এগিয়ে আসছেন না। আর ৪৭ শতাংশ মানুষ বীমা বিষয়ে কোনো ধারণাই রাখে না। সব মিলিয়ে দেশে পরিবার পর্যায়ে বীমাসেবা গ্রহণের হার ১২ শতাংশ।

বীমার দাবি নিষ্পত্তি ও আস্থার সংকটের কারণে মানুষ এ সেবায় সম্পৃক্ত হচ্ছে না বলে মনে করেন ইনস্টিটিউট অব মাইক্রো ফিন্যান্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এম এম বাকী খলিলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশে ৭৭টি বীমা কোম্পানি থাকলেও তাদের সেবার বিষয়ে মানুষের আস্থা তৈরি হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পলিসি খোলার পর দাবি নিষ্পত্তি হয় না। কোম্পানিগুলো সাধারণত উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবার টার্গেট করে কাজ করে। এ কারণে দরিদ্ররা এ সেবার আওতায় আসছে না। এছাড়া সব বীমা কোম্পানির পর্যাপ্ত এজেন্ট না থাকায় গ্রামীণ পর্যায়ে এ সেবার আওতা বাড়ছে না।

তিনি আরো বলেন, জীবন বীমায় পাঁচ থেকে ২৫ বছর মেয়াদি পলিসি খোলার পর বিভিন্ন কারণে তামাদি হয়ে পড়ে ৫০-৭০ শতাংশ। অনেকেই মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর কোম্পানিগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থ পান না। কোনো কোনো বীমা এজেন্ট গ্রাহকের টাকা জমা না করে আত্মসাত্ করেন। ফলে একবার এ সেবা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে খুব কম সংখ্যক পরিবার নতুন করে আগ্রহ ফিরে পায়।

জরিপের তথ্যমতে, জাতীয় পর্যায়ে বীমা বিষয়ে সচেতন রয়েছে ৫২ দশমিক ৮৩ শতাংশ পরিবার। এর মধ্যে ১০ শতাংশ পরিবার জীবন বীমা ও ২ দশমিক ৬১ শতাংশ পরিবার সাধারণ বীমা সেবা নিচ্ছে। আর এ সেবার বাইরে রয়ে গেছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। গ্রামীণ পর্যায়ে বীমার বিষয়ে সচেতন ৪৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ পরিবার। এর মধ্যে সেবা গ্রহণ করে ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ পরিবার। শহুরে পরিবারের মধ্যে বীমার বিষয়ে সচেতন ৬৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ পরিবার। এর মধ্যে সেবা গ্রহণ করে ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ পরিবার। ধনীদের মধ্যে বীমা-সচেতনতা ৫৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, যার মধ্যে সেবা গ্রহণ করে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বীমার বিষয়ে সচেতনতা ও সেবা গ্রহণের দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে দরিদ্র পরিবারগুলো। যাদের জন্য বীমা সেবা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের মধ্যে বীমা সম্পর্কে ধারণা রাখে ৪৫ দশমিক ৬০ শতাংশ মানুষ। আর সেবা নিয়ে থাকে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশের বীমা পলিসি দরিদ্রবান্ধব নয়। দরিদ্র পরিবারের লোকদের টাকা জমানোর মতো আর্থিক অবস্থা থাকে না। ধনীদের হাতে টাকা থাকলেও তারা আস্থার সংকটে বীমার দিকে ঝুঁকছে না। তাছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে সঠিক উদ্যোগ নিয়ে কাজ না করায় এ সেবার আওতা বাড়ছে না।

বীমার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি বাংলাদেশের (আইডিআরএ) তথ্যমতে, দেশে মোট ৭৭টি বীমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ বীমা কোম্পানি ৪৫টি ও জীবন বীমা কোম্পানি ৩০টি এবং বিদেশী কোম্পানি একটি। এসব কোম্পানি সাধারণ, অগ্নি, নৌ, দুর্ঘটনা, মোটর যান, শস্য ও পুরনো বীমাসহ নানা ধরনের পলিসি করে থাকে। ২০১৪ সালে সারা দেশে বীমা সেবা নিয়েছেন ১ কোটি ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৩৯০ জন। এর মধ্যে জীবন বীমা সেবা নিয়েছেন ৯১ লাখ ৭৩ হাজার ৮১৮ জন। ২০১৩ সালে উভয় খাতে মোট পলিসিধারী ছিলেন ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার ৫৯০ জন। ২০১৪ সালে এ পলিসি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। সরকারের উদ্যোগ ও মানুষের সতর্কতার অভাবে বীমা সেবা নেয়ার হার কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বাড়ছে না বলে দাবি করছেন বীমাসংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম বলেন, মূলত বীমা নিয়ে মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকেই মনে করেন বীমা করলে মৃত্যুর আগে টাকা পাওয়া যাবে না। কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প বিনিয়োগের পলিসি নেয়ায় তা কিছুদিন পর তামাদি হয়ে পড়ে। তাছাড়া আমাদের দেশে বীমা বাধ্যতামূলক না হওয়ায় মানুষ এ সেবার আওতায় আসে না।