Professor Mustafizur Rahman on leather industry

Published in Naya Diganta on Friday, 24 July 2015.

চামড়া শিল্পনগরীর উন্নয়ন কাজের গতিহীনতায় উদ্যোক্তারা হতাশ
তিন বছরের প্রকল্প শেষ হয়নি ১৩ বছরেও; ডিসেম্বরের মধ্যে স্থানান্তরের সম্ভাবনা কম; কোরবানির চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা

জিয়াউল হক মিজান

সাভারে চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল তিন বছর। কাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০০৫ সালে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে ১৩ বছর। দীর্ঘ এ সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে বহুবার। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে আটবার। ব্যয়ও বেড়েছে ছয় গুণের বেশি। সর্বশেষ গত জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সব চামড়া কারখানা চলে যাওয়ার কথা সাভারে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চলতি বছরের মধ্যেও স্থানান্তরের আশা করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। অথচ কোরবানির ঈদের আগে সাভারে কারখানাগুলো চালু করা সম্ভব না হলে চামড়া পাচারের পাশাপাশি চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, রাজধানীর লালবাগ-হাজারীবাগ এলাকার লাখ লাখ মানুষকে মারাত্মক স্বাস্থ্যহানি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকে নিস্তার দিতে ২০০৩ সালে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সরকার। এ লক্ষ্যে তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তার বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তারই অংশ হিসেবে সাভার ও কেরানীগঞ্জের মাঝামাঝি হরিণধরায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। জমির ক্ষতিপূরণ, মাটি ভরাট, রাস্তাঘাট ও কালভার্ট তৈরি, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ শেষ হয়েছে ২০০৫ সালের মধ্যেই; কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় নেমে আসে অন্ধকার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর পছন্দের লোকদের কাজ দিতে প্রকল্পের ব্যয় অবিশ্বাস্যরকম বাড়ায়। চারপর্যায়ে ৬১৪ শতাংশ বাড়িয়ে প্রকল্পের ব্যয় ধার্য করা হয় এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে বিদায়ের আগে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে পারেনি সেই সরকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে আগের প্রক্রিয়া বাতিল করে এবং নতুন কোনো কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে; কিন্তু একাধিক পক্ষের একাধিক পছন্দ এবং বাড়তি বরাদ্দ দেয়া অর্থের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের কারণে বছরের পর বছর ঝুলে আছে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কাজ। এভাবেই কাটে শিল্পমন্ত্রী হিসেবে জোটের শরিক দিলীপ বড়–য়ার পুরোটা সময়। আর উদ্যোক্তারা ভাসতে থাকেন হতাশার মহাসমুদ্রে।

চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের কারণে পুরো শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, পুঁজির অভাবে ইতোমধ্যে ৪০ থেকে ৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো আমাদের নতুন করে কোনো ঋণ তো দিচ্ছেই না, বরং পুরনো ঋণের টাকা আদায়ে চাপ অব্যাহত রেখেছে। সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা, তাও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ ১০ বছর ধরে আমরা কিস্তির টাকা দিয়ে যাচ্ছি। তিন বছরের প্রকল্প ১৩ বছরেও শেষ না হওয়ায় সম্ভাবনাময় এ সেক্টরে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেভাবে কাজ চলছে তাতে এ বছরের ডিসেম্বরেও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও সেটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না জানিয়ে শহীন আহমেদ নয়া দিগন্তকে আরো বলেন, চামড়া বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাত। এ খাতে রয়েছে মূল্য সংযোজন, কর্মসংস্থান ও রফতানি আয়ের অপার সুযোগ। তা ছাড়া দেশেও গুণগতমানের জুতা ও চামড়াজাত পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার এটিকে অগ্রাধিকার শিল্প খাত হিসেবেও চিহ্নিত করেছে; লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে রফতানি সাত গুণ বৃদ্ধি করার। কিন্তু সে আলোকে কাজ না করায় সব সম্ভাবনাই মুখ থুবড়ে পড়ছে। রফতানি সাত গুণ বাড়ানো তো দূরের কথা, এখন আমরা গত বছরের একই সময়ের সমানও রফতানি করতে পারছি না। রফতানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সরকারের সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করে শাহীন আহমেদ বলেন, চামড়া শিল্পনগরী চালু না হওয়ায় অনেক দেশই আমাদের কাছ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। সরকারের সাথে আমাদের দফায় দফায় চুক্তি হয়েছে; কিন্তু এসব চুক্তি অনুযায়ী সরকার কোনো কাজ করেনি।

অবশ্য প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি কম হয়েছে মানতে নারাজ প্রকল্প পরিচালক সিরাজুল হায়দার। অষ্টম পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া এ কর্মকর্তার দাবি, তাকে দায়িত্ব দেয়ার পর থেকে যে অগ্রগতি হয়েছে তা দৃশ্যমান এবং সন্তোষজনক। নয়া দিগন্তকে তিনি জানান, বরাদ্দ দেয়া ২০৫টি প্লটে যে ১৫৫টি কারখানা স্থাপিত হওয়ার কথা সেগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিরই নির্মাণকাজের কোনো না কোনো অংশ শুরু করেছে। অনেকটির এক তলার কাজও শেষে হয়েছে। যে সিইটিপির কারণে প্রকল্পের কাজে সবচেয়ে বেশি বিলম্ব হয়েছে সেটির কাজও শেষের দিকে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, দীর্ঘ তিন দশকে হাজারীবাগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা চামড়া শিল্প কারখানাগুলো ভালোই চলছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চাপ, হাজারীবাগের পরিবেশ ও বুড়িগঙ্গার পানি রক্ষা এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতাদের চাহিদার কথা চিন্তা করে এ শিল্পকে একটি পরিকল্পিত শিল্প সেক্টরে রূপদানের উদ্যোগ নেয় সরকার। সে অনুযায়ী কাজ এগিয়ে যায়। ২০০৪ সালে প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলাকালে প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শনে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী বহুবার সাভারের হরিণধরায় যান। ২০০৬ সালের মধ্যে মাটি ভরাট, লে-আউট, বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপনসহ প্রায় সব কাজই শেষ হয়ে যায়। যদিও বিপত্তি দেখা দেয় শুধু সিইটিপির কাজ নিয়ে। যে প্রতিষ্ঠানকে সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেয়া হয় তারা কাজ করতে পারছিল না নানামুখী প্রতিবন্ধকতার কারণে। এরই মধ্যে ওয়ান-ইলেভেনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে বিপর্যয় নেমে আসে পুরো শিল্পের ওপর।

জানা যায়, ২০০৭ সালের শুরুতে সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় এসে চামড়া শিল্পনগরীর কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। অনিয়ম খুঁজতে গিয়ে নিজেরাই অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। আগের কার্যাদেশ বাতিল করে নতুন কোম্পানিকে সিইটিপি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই প্রক্রিয়ায় অনিয়মের আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ এলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জোটের শরিক দলের নেতা দিলীপ বড়–য়া। আদালতের জট খোলার পর অনিয়মে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধেও। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরে কোনো কাজ না করেই বিদায় নেন দিলীপ বড়–য়া। অবস্থা এমন হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে একে একে আটজনকে বসানো হয় প্রকল্প পরিচালকের পদে। এ সময় শুধু বরাদ্দ বেড়েছে, সময় বেড়েছে আর প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের পকেট ভরেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

নতুন করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর কার্যক্রম জোরদারের উদ্যোগ নেন আমির হোসেন আমু। নতুন করে প্রকল্পব্যয় ও মেয়াদ বাড়ান তিনি। ট্যানারি স্থানান্তরের ব্যাপারে শিল্পমালিকদের সাথে নতুন করে চুক্তিও করান তিনি। সে আলোকে এখন কাজ চলছে। তিনি নিজেই একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন, জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কবে নাগাদ হস্তান্তর সম্ভব হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলতে অপারগতা জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক সিরাজুল হায়দার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। আশা করছি যেকোনো সময় হস্তান্তরপ্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।

চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প এ দেশের চামড়া শিল্পের জন্য আশীর্বাদ হওয়ার কথা ছিল মন্তব্য করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ও অতি লোভী কিছু লোকের জন্য চামড়া শিল্পনগরী আমাদের সামনে অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সময়মতো এ শিল্পনগরীর কাজ শেষ করা সম্ভব হলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি এত দিনে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেত। ১ জানুয়ারির পর থেকে ইউরোপের বাজার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প বাজার ধরতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বায়ারদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে রফতানিকারকদের পাশাপাশি সরকারেরও অনেক কিছু করার আছে। এ জন্য এখনি কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। পাশাপাশি চামড়া শিল্পনগরীর কাজ দ্রুত শেষ করে সম্ভব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তরের ওপর গুরুত্বারোপ করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।