Professor Mustafizur Rahman on reduced global oil price vis-à-vis Bangladesh

Published in Prothom Alo on Thursday, 29 January 2015.

বিশ্ববাজারে তেলের দাম অর্ধেক, দেশে কমাচ্ছে না

অরুণ কর্মকার

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের ব্যাপক দরপতন হলেও দেশে দাম কমছে না। দাম কমানো কিংবা মূল্যসংস্কারের মাধ্যমে তেলের দাম বাজারনির্ভর করার বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে সরকার।

সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, গত জুলাই থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার প্রবণতা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল বুধবার বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের যে দাম ছিল, সে হিসাবে দেশে প্রতি লিটার ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম পড়ছে যথাক্রমে ৪৪ ও ২৮ টাকা। আর দেশে ডিজেল ও ফার্নেস তেল বিক্রি হচ্ছে আগের দরেই, প্রতি লিটার যথাক্রমে ৬৮ ও ৬০ টাকা। পেট্রল ও অকটেনের দামও লিটারপ্রতি যথাক্রমে ৯৬ ও ৯৯ টাকাই আছে।

সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই একাংশের মত, সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার যে নীতি নিয়েছে তা বাস্তবায়নের এখনই উপযুক্ত সময়। তারা মনে করে, যে রাজনৈতিক সমীকরণে তেলের দাম কমছে আগামী দু-এক বছরে তার নিরসন হবে না। কাজেই মূল্যসংস্কারে ঝুঁকি নেই। তবে ভিন্নমতও আছে। কেউ কেউ মনে করেন, দেশের অর্থনীতি ঘন ঘন জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামার অভিঘাত সহ্য করার পর্যায়ে এখনো যায়নি।

বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের সর্বশেষ অবস্থান জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এ এম বদরুদ্দোজা প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমানো কিংবা মূল্যসংস্কারের বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তাঁর কাছে কোনো নির্দেশনা নেই।

তবে জ্বালানি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিষয়টি সরকারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছে। আরও অন্তত ছয় মাস পর্যবেক্ষণের পর মূল্য সমন্বয় কিংবা মূল্যসংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, প্রথমে তেলের দাম কমতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টির যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ছিল এটি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে যখন বিপুল পরিমাণ ‘শেল অয়েল’ উৎপাদন শুরু করে তখন বিশ্বজাজারে তেলের চাহিদা কমে গিয়ে দাম পড়তে থাকে।

‘শেল অয়েল’ হচ্ছে খনিতে তেলের ছোট ছোট আধারগুলো ভেঙে বের করে আনা তেল। কয়েক বছর আগেও এই প্রযুক্তি ছিল না। তেলের ওই আধারগুলো অব্যবহৃতই পড়ে থাকত। এখন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব তেল উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। এতে প্রতি ব্যারেল তেল উত্তোলনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০ ডলার।

এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তেল রপ্তানিকারক (ওপেকভুক্ত) দেশসমূহ তেলের দাম কমিয়ে দেয়। ওপেকভুক্ত দেশগুলোতে তেলের উত্তোলন ব্যয় গড়ে ১৫ ডলারেরও কম। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র উল্টো চাপে পড়ে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করাও তেলের দাম কমানোর অন্যতম কারণ। এই বহুমুখী জ্বালানি রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা না পাওয়া পর্যন্ত তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা কম বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক বিদ্যুৎ সচিব, বর্তমানে ফ্রিল্যান্স পরামর্শক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ের গবেষক ফাওজুল কবির খান বলেন, বাংলাদেশে এখন জ্বালানি তেলের মূল্যসংস্কার করতে কোনো সমস্যা নেই। বরং এটাই উপযুক্ত সময়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম আদৌ আর কখনো আগের পর্যায়ে যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অন্তত ২০২০ সালের মধ্যে যে যাবে না তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

জনাব কবির বলেন, এখন মূল্যসংস্কার করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি উৎপাদনসহ সব ধরনের উৎপাদন ব্যয় কমবে। সমগ্র অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তির সুবাতাস বইবে। তবে ভারত ও মিয়ানমারের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মূল্যসংস্কার করতে হবে। তার চেয়ে দাম কম হলে চোরাচালানের আশঙ্কা আছে।

এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দাম বাড়লে তা সমন্বয় করা সব সময়ই কঠিন হয়। আর এখন দাম কমালে সাধারণ মানুষ তার কতটা সুবিধা পাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তিনি বলেন, উৎপাদন খাত, কৃষি, পরিবহন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ সরাসরি জ্বালানি তেল কেনে না। তারা কেনে সেবা। তেলের দাম কমলে ওই সব সেবার (বাস-ট্রাক ভাড়া, সেচের পানি প্রভৃতি) মূল্যহারও সেই অনুযায়ী কমবে কি না বলা যায় না। অতীতে নানা অজুহাতে তা কমেনি। কিন্তু তেলের দাম বাড়লে সেবার মূল্যহার তার চেয়ে বেশিই বৃদ্ধি পায়। তাই ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

তা ছাড়া জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাস একসঙ্গে হিসাবে নিয়ে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করা সবচেয়ে যৌক্তিক হবে। এই ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষকে দাম কমার সুবিধা দেওয়া সম্ভব।

তেলের দাম কমার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেবার দাম যে নাও কমতে পারে এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন মত পোষণ করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা ম. তামিম। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস তেলের দাম কমানো যায় বলে মনে করেন তিনি।

ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়া ফার্নেস তেলের ব্যবহার এখন আর তেমন নেই। তাই ফার্নেসের দাম কমালে অন্য ক্ষেত্রে তার তেমন প্রভাব পড়বে না। অন্যদিকে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় অনেক কমবে। নতুন করে বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে না। তাতে দেশের সব মানুষ সুবিধা পাবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে তেলের দাম বর্তমান পর্যায়ে রেখে সরকার মুনাফা করতে পারে। সেই মুনাফা দিয়ে ভবিষ্যতে দরকার হলে ভর্তুকিও দিতে পারবে।