CPD study on BBIN MVA cited

Published in Jai Jai Din on Saturday, 27 June 2015.

ঋণের বাড়তি ঝুঁকিতে সরকার

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে অবকাঠামো উন্নয়নে এসব ঋণের ইঙ্গিত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করলেও সঠিক প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে না পারলে নতুন ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ

মেসবাহুল হক

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য চীন উন্নয়ন ব্যাংক (সিডিবি) থেকে ৭৯৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। এছাড়া সদ্য সমাপ্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরে বাংলাদেশকে ২০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে অবকাঠামো উন্নয়নে এসব ঋণের ইঙ্গিত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করলেও সঠিক প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে না পারলে নতুন ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা ভৌগোলিক, সবকিছুর বিচারেই বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী ভারত। কিন্তু এই সুবিধা যতটা বাড়িয়েছে সম্ভাবনা, তার চেয়ে বেশি তৈরি করেছে সংকট। বড় উদাহরণ, সীমান্ত, বাণিজ্য ঘাটতি, ভিসা জটিলতা কিংবা অভিন্ন নদীর যৌক্তিক হিস্যা।

সই ও বিনিময় হওয়া ১৯টি চুক্তি এবং সমঝোতার মধ্যে অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক দিয়ে বড় ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের নতুন ক্রেডিট লাইন। কিন্তু পুরনো ঋণের অর্ধেকের বেশি পড়ে আছে অব্যবহৃত। হাতে নেয়া প্রকল্পগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি সময় মতো। তাই, নতুন ঋণ বাংলাদেশর ওপর তৈরি করতে পারে নতুন বোঝা এমন শঙ্কা আর্থনীতিবিদদের।

ভারতের সাথে নতুন দু্ই বিলিয়ন ডলারের ঋণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, ভারতের ঋণে কোনো শর্ত নেই। তবে ভারতীয় গণমধ্যামে উঠে আসে জটিল শর্তের জাল। তাই অর্থনীতিবিদরা এই চুক্তিতে যে সব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তা বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা বলে উল্লেখ করেছেন।

ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ১৫ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা) ঋণ দেবে ভারত। ভারতীয় বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ঋণ সরবরাহ করা হবে।

চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঋণের অর্থ যে সব প্রকল্পে খরচ করা হবে তার কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে। অর্থাৎ ঋণের দায় বাংলাদেশের আর সুদাসল ছাড়াও রপ্তানি ব্যবসা হবে ভারতের।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয় নতুন ঋণের টাকায় বাংলাদেশে নেয়া প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে ভারতে নতুন করে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই ঋণের ফলে অনেক খাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য রপ্তানি করতে পারবে। এর মধ্যে অবকাঠামো খাতের ইস্পাত (স্টিল) ও সিমেন্ট উল্লেখযোগ্য। চুক্তির শর্তানুযায়ী, ঋণের অর্থে নেয়া প্রকল্পগুলোর অন্তত ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে নিতে হবে। এ সব পণ্য ও সেবার উৎপাদন প্রক্রিয়া হবে ভারতেই।

এসব বিষয়ে সেন্টার ফর ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মনিত ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ভারতের সাথে চুক্তির শর্তগুলোর সমালোচনা করে বলেছেন, আন্তর্জাতিক ঋণের ক্ষেত্রে এই রকম শর্ত থাকে না। এই শর্তের ফলে বাংলাদেশের সামনে বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা থাকবে না। ঋণের ক্ষেত্রে সাধারণত যে সংস্থা ঋণ দেয় তারা প্রকল্পগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে, যাতে টেন্ডার থেকে শুরু করে অন্যান্য বিষয়ে কোনো অনিয়ম থাকে কিনা তা দেখতে। আর প্রকল্পের উপাদান ক্রয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে সর্বনিম্ন দরদাতার মাধ্যমে ক্রয় করা হয়। এর ফলে প্রকল্প খরচ কম থাকবে। কিন্তু যে শর্তে চুক্তি করা হয়েছে তার ফলে বাংলাদেশের সামনে বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা নেই।

এছাড়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য চীন উন্নয়ন ব্যাংক (সিডিবি) থেকে ৭৯৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। গত সমবার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত বিদেশি ঋণ অনুমোদন কমিটি এ ঋণের অনুমোদন দেয়। এ ঋণের ক্ষেত্রে শর্তের বিষয়টি এখনো সুস্পষ্ট নয়।

এদিকে সরকার বড় আকারের বাজেট করতে গিয়ে বেশি মাত্রায় ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এতে বাড়ছে ঋণের পরিমাণ। বর্তমানে এর পরিমাণ বেড়ে সাড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে- যা মোট বাজেটের প্রায় ২৮ শতাংশ। এই মাত্রাতিরিক্ত ঋণ সরকারের জন্য এক ধরনের ফাঁদ তৈরি করেছে। এই ফঁদে পড়ে বেড়ে যাচ্ছে মূল ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ। গত পাঁচ বছরে ঋণ ও সুদ পরিশোধে খরচ হয়েছে গড়ে মোট বাজেটের ২২ থেকে ২৫ শতাংশ। এই ঋণের একটি বড় অংশই সরকারের অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হচ্ছে। যা দেশের মানুষের ওপর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাজেটের ঋণের বোঝা এভাবে বাড়তে থাকলে এক সময়ে মূল বাজেটের অর্ধেকের বেশি চলে যাবে ঋণ ও সুদ পরিশোধে। ফলে বাজেট বাড়বে, কিন্তু তা জনকল্যাণে ব্যবহৃত না হয়ে ব্যয় হবে অনুৎপাদনশীল খাতে- যা মূল্যস্ফীতির হারকে উস্কে দেবে। ঋণ নিলে তা অবশ্যই উৎপাদন খাতে ব্যবহার করতে হবে। নয়তো ঋণ কমাতে হবে। তা না হলে বাজেটের শৃঙ্খলা রক্ষা করা যাবে না।

সূত্র জানায়, বাজেটে ঋণের বোঝা বেড়ে বর্তমানে নতুন ঋণের পরিমাণ আগের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের প্রায় কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। ঋণের অঙ্ক বাড়তে থাকলে হয়তো অচিরেই এটি সমান সমান হয়ে যাবে। এই ধরনের হলে ঋণভারে আক্রান্ত হয়ে পড়বে বাজেট।

চলতি অর্থ বছরের এখন পর্যন্ত সরকার আগের বছরের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে। কিন্তু সংশোধিত বাজেট সমন্বয় করতে গিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ। সঞ্চয়পত্র বেশি পরিমাণে বিক্রি হওয়ায় এ খাতেও ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। আর ব্যাংক ঋণের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ অনেক বেশি। ফলে সরকার চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। কেননা, গ্রাহকদের সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রিকে উৎসাহিত করছে। ফলে এই খাতে ঋণের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এ খাত থেকে ঋণ কমাতে সমপ্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন অর্থনীতিবিদ জানান, সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সব সময়ই ঋণের পরিমাণ কমাতে বলা হয়। এখন সরকার ব্যাংক ঋণ কম দিলেও সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। এটি সরকারের ঋণের খচর বাড়িয়ে দিচ্ছে- যা আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষতিকর।

সূত্র জানায়, এ সরকারের শুরুর দিকে ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজেটে ঋণের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭১ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে ঋণ শোধের খরচও ১৭ হাজার থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরু থেকে শেষ সময়ে এসে ঋণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার কথা ছিল ১৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। নেয়া হচ্ছে ১৫ হাজার ৪২২ কোটি টাকা- যা প্রায় ২ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা কম। ব্যাংক থেকে নেয়ার কথা ছিল ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। নেয়া হচ্ছে ৩২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। এর পরিমাণ বাড়ছে ১ হাজার ২১১ কোটি টাকা। সঞ্চয় প্রকল্প থেকে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নেয়া হচ্ছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বেশি। অন্যান্য খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর কাছাকাছি থাকছে। ঋণ ও সুদ পরিশোধের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৯ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি নেয়ার কারণে এর পরিমাণও বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ফলে মোট বাজেটের প্রায় ২৪ শতাংশ খরচ হবে এ খাতে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারের ঋণের অংক যেভাবে বাড়ছে, তা বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। ঋণের ব্যবহার সঠিকভাবে না হলে তা বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে। তাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে ঋণের টাকা যথাযথভাবে ব্যবহার করার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।