CPD study on banking and impact of political unrest on local enterprises cited

Published in Daily Manabzamin on Thursday, 13 February 2014.

ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত

আলী ইদ্‌রিস

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬২ দিন হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা ব্যাংকিং সেক্টরকেও দুর্বল করে দিয়েছে।  এফবিসিসিআই-এর এক প্রতিবেদন মতে তৈরী পোশাক, চামড়া, পোল্ট্রি, হিমায়িত খাদ্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পরিবহন ইত্যাদি খাতে হরতাল-অবরোধে প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, আবাসন খাতে ৫০% ছাড় দিয়েও ক্রেতা মিলছে না।

এসব খাতের মোট ব্যাংক লোন প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হতে পারে। এফবিসিসিআই বলেছে, ২০১৩ সালে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১,০০,০০০ কোটি টাকা। আর ব্যাংকসমূহে অলস পড়ে আছে প্রায় ১০০,০০০ কোটি টাকা (জানুয়ারিতে ছিল ৬০,০০০ কোটি টাকা)। এ থেকে বোঝা যায় যে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিপিডি’র  প্রতিবেদন মোতাবেক গত সাড়ে চার বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহে  প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ ও ১১,০০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এর আগে ৭ বছরে সুদ মওকুফ করা হয়েছিল মাত্র ৩,৬৪৫ কোটি টাকার। এসব করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত  ব্যাংকসমূহ, কৃষি ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও শিল্পঋণ সংস্থায়। এ বিশাল অংকের সুদ মওকুফ ও ঋণ অবলোপনের ফলে ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ কমে গিয়েছে এবং মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো  ২,২২৫ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছিল, তার বিপরীতে ২০১২ সালে  সেগুলো লোকসান গুনেছে। একই ভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ২০১১ সালে ১০.৯৬ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছিল, ২০১২ সালে মাত্র ১৫ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করেছে।

ব্যাংকের কু-ঋণ, খেলাপি ঋণ, মওকুফকৃত সুদ, ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ, সব মিলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নবম সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে জানা যায় ৪৭টি ব্যাংকে মোট ঋণখেলাপির সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজার।  মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪,৪০৩ কোটি টাকা। আরও আছে মূলধন এবং খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতি। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৯,৬৪৫ কোটি টাকা, প্রভিশন ঘাটতি ৭,৪৯৪ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক দু’দিকেই সবচেয়ে এগিয়ে আছে। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি  গ্রুপের কেলেঙ্কারির পর অবস্থা খারাপ হয়েছে। হল-মার্ক গ্রুপ নাকি আরও ঋণ চায়। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ২,১৭,৯৯২ কোটি ঋণের বিপরীতে ৪,৬৮০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এই নাজুক পরিস্থিতিতে এখন শুরু হয়েছে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার মহোৎসব।

২০১৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এই অজুহাত দেখিয়ে নতুন, পুরাতন খেলাপিরা দলে দলে কোন রকম ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল করার আবেদন করছেন এবং তা মঞ্জুর হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা এব্যাপারে অধিক বিবেচনা লাভ করলেও সিপিডি’র মতে স্থানীয় বা দেশীয় বাজার-নির্ভর শিল্প-কারখানা হরতাল-অবরোধে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে যে সমস্ত ঋণ অতীতে একাধিকবার  পুনঃতফসিল হয়েছে তা পুনরায় বিবেচনার অবকাশ নেই,  কিন্তু সে সব বিষয় বিশ্লেষণ-বিবেচনা না  করে  হ্রাসকৃত সুদে কু-ঋণ পুনঃতফসিল করলে যেমন সুবিচার করা হয় না তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে জনসাধারণের আর্থিক ক্ষতি করা হয়। কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন জনগণের করের টাকা থেকে দেয়া, সুদ মওকুফ বা হ্রাস করলে ব্যাংকের মুনাফা কমবে ও সরকারের কোষাগারে  লভ্যাংশ জমা হবে না যা জনস্বার্থে ও দেশের কল্যাণে ব্যয় করা যেতো। কোন ঋণের সুদ মওকুফ বা হ্রাস করা ও ঋণ অবলোপন করার অর্থ ব্যক্তিবিশেষের লাভ কিন্তু শেয়ার হোল্ডারদের ক্ষতি।

দ্বিতীয় খারাপ প্রভাবটি হলো- ভাল ঋণগ্রহীতারা  ঋণ খেলাপি হতে উৎসাহিত হবে। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাবে, মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়বে এবং ব্যাংকটি দেউলিয়াত্বের দিকে এগোবে। আইন ও নীতি সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ না হলে সামাজিক অবিচার ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তাই রাজনীতি অর্থনীতিকে যেন পঙ্গু না করে সেদিকে সরকারের দৃষ্টি দেয়া উচিত।