Dr Khondaker Golam Moazzem on pricing of gold

Published in Janakantho on Wednesday, 22 July 2015.

বিশ্ব বাজারে স্বর্ণের দর পতন, রিজার্ভ ধরে না রাখার পরামর্শ
দু’ একদিনের মধ্যে দেশে স্বর্ণের দাম পুনর্নির্ধারণ হবে

রহিম শেখ

বিশ্ববাজারে দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত রয়েছে স্বর্ণের দরপতন। বর্তমানে এশিয়ায় স্বর্ণের চাহিদা নিম্নমুখী। ফলে বিশ্ববাজারে সোনার দাম কমে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হলেও বাংলাদেশ এ ধাতব মুদ্রার দাম কমছে না। বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশে প্রতিভরি স্বর্ণের দাম প্রায় ১০ হাজার টাকা বেশি। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) জানিয়েছে, দু-একদিনের মধ্যে দেশের সোনার দাম নতুন করে নির্ধারণ করা হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম কমলেও বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ শক্ত অবস্থানে থাকবে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দরপতনে এই মুহূর্তে রিজার্ভের অর্থ আটকে না রেখে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের পরামর্শ দিলেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তালিকা অনুযায়ী, দেশীয় বাজারে মঙ্গলবার ২২ ক্যারেটের প্রতিভরি স্বর্ণের দাম ৪৪ হাজার ৫২১ টাকা, ২১ ক্যারেট ৪২ হাজার ৪২১ টাকা, ১৮ ক্যারেট ৩৫ হাজার ৭৭৩ টাকা এবং সনাতন মানের প্রতিভরি ২৪ হাজার ৮৬ টাকা বিক্রি হয়েছে। তবে মঙ্গলবারও এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে সোনার দামে তীব্র নিম্নগামী প্রবণতা দেখা গেছে। এশিয়ার নগদ টাকার বাজারে (স্পট) মঙ্গলবার সোনার আউন্স প্রতি দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১০০ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮৫ হাজার টাকা। ২০১০ সালের ২৬ মার্চের পর সোমবার সোনার ন্যূনতম দাম ১ হাজার ১০০ ডলারের নিচে নেমে আসে। এদিকে বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেশি হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণের কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। বাজুস নেতাদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে দেশের ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ কিনতে পারছে না। প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে সংগৃহীত স্বর্ণের দ্বারাই দেশীয় বাজারের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। ফলে দেশে চাহিদার বিপরীতে প্রয়োজনীয় যোগান হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক খান বলেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারে স্বর্ণের দামের ব্যবধান বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে বাজুস দুই একদিনের মধ্যে বৈঠকে বসবে। বৈঠকে দর একটু কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে এ ব্যবধান থাকবেই। তিনি আরও বলেন, শুধু একটি নীতিমালার অভাবে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছি না। নীতিমালা প্রণীত হলে সরকার বিশ্ববাজার থেকে নির্ধারিত মূল্যে স্বর্ণ কিনবে। ব্যাংকের মাধ্যমে নির্ধারিত মূল্যে ওই স্বর্ণব্যবসায়ীদের দেবেন। ব্যবসায়ীরা তখন আন্তর্জাতিক বাজারদরে বিক্রি করতে বাধ্য থাকবে।

জানা যায়, গত বছর দেশের বাজারে ১৪ বারের মতো স্বর্ণের দাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ সময়ে এ ধাতব পদার্থের (স্বর্ণ) দাম কমানো হয়েছে। তবে নতুন বছরে এসে গত ২১ জানুয়ারি একবার দাম বৃদ্ধি ও ১০ মার্চ আরেকবার দাম কমানো হয়। এ প্রসঙ্গে বাজুসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম শাহীন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যবহৃত পুরনো স্বর্ণ ও প্রবাসীসের নিয়ে আসা স্বর্ণের উপর দেশীয় জুয়েলারিগুলো নির্ভরশীল। তিনি বলেন, সাধারণত বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশেও সোনার দাম ঠিক করা হয়। এখন ঈদের ছুটির জন্য সব দোকান বন্ধ আছে। ছুটি শেষ হলেই বিশ্ববাজার পর্যবেক্ষণ করে দেশের সোনার দাম নতুন করে নির্ধারণ করা হবে। এজন্য দুয়েক দিন সময় লাগবে। ক্রেতারা বলেন, বিশ্বায়নের এ যুগে বাজার একটাই। অথচ আমরা ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ পাচ্ছি না। তারপরও নিম্নমানের প্রতিভরি স্বর্ণে প্রায় ১০ হাজার টাকা বেশি দিচ্ছি। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমলেও এ নিয়ে দেশীয় বাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কোন মাথাব্যথা নেই। বায়তুল মোকাররম মার্কেটের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের ঈদে স্বর্ণের বাজার খুব বেশি চাঙ্গা ছিল না। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমলেও দেশীয় বাজারে এর প্রভাব না থাকায় ক্রেতারা সোনা কিনতে আগ্রহী হননি। ঈদের আগে স্বর্ণের দাম কমানো হলে বিক্রি আরও বাড়ত বলে অধিকাংশ ক্রেতাই জানিয়েছেন। মঙ্গলবার বাইতুল মোকাররম মার্কেটে স্বর্ণ কিনতে আসেন রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা আয়েশা খানম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, শুনছি আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম কমছে। কিন্তু দেশীয় বাজারে এর কোন প্রভাব দেখছি না। বিশ্ববাজার থেকে বিচ্ছিন্ন এ স্থানীয় বাজারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কোন সরকারই এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছে না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের একটি অংশ রয়েছে সোনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ এ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনার মজুদ রয়েছে সাড়ে ১৭ টন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ এ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, সোনার গ্রেড যদি আন্তর্জাতিক মানের হয়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক বাজার দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে নেয়। সেই সোনা তখন রিজার্ভে জমা হয়। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমছে, আবার বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম কমায় কি পরিমাণ ক্ষতি হবে তা বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলে তিনি মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)’র অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমলেও আবার বাড়বে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সাময়িক সময়ের জন্য স্বর্ণের দাম কমছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে সোনার দাম কমলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা স্বর্ণ দীর্ঘমেয়াদে রাখার গুরুত্ব রয়েছে। কেননা এই স্বর্ণের মজুদের ওপর ভর করে রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে। তবে এখন সময় হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করার। আকু পেমেন্ট বাদে বাকি অর্থ ছেড়ে দিতে হবে। কেননা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও বেশি বাড়লেও রফতানি করাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গত ছয় বছরে প্রত্যাশার তুলনায় চীনে আমদানি কম এবং মার্কিন ডলারের মান শক্তিশালী হওয়ার কারণেই সোনার দরপতন হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর চীনে সোনার মজুদ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কমবে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা সোনা বিক্রি বাড়িয়েছেন। এতে বর্তমানে সোনার দাম চার শতাংশ কমেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, মঙ্গলবারও এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে সোনার দামে তীব্র নিম্নগামী প্রবণতা দেখা গেছে। এশিয়ার নগদ টাকার বাজারে (স্পট) মঙ্গলবার সোনার আউন্স প্রতি দাম দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১০০ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৮৫ হাজার টাকা। সোমবার সোনার আউন্স প্রতি দাম ছিল ১ হাজার ৮৮ ডলার ৫ সেন্ট। এটি ২০১০ সালের মার্চের পর সোনার সর্বনিম্ন দাম। উল্লেখ্য, এক আউন্স সমান ২ দশমিক ৪৩ ভরি। এ হিসাবে বিশ্ববাজারে বর্তমানে এক ভরি সোনার দাম আসে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। আন্তর্জাতিক কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়াতে পারে। মূলত এই অনিশ্চয়তা থেকে নিরাপদে থাকতে বিনিয়োগকারীরা সোনা বিক্রি করে নগদ অর্থ তুলে নিচ্ছেন। কিন্তু ২০১০ সালের ২৬ মার্চের পর সোমবার সোনার ন্যূনতম দাম ১ হাজার ১০০ ডলারের নিচে নেমেছে।

এর আগে গত শুক্রবার বিশ্বের বৃহত্তম সোনার ভোক্তা দেশ চীন জানায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশটি ৫৭ শতাংশের বেশি সোনা মজুদ করতে পেরেছে। তবে বিশ্লেষকরা যেমনটি প্রত্যাশা করেছিলেন, তার চেয়ে এই অঙ্ক অনেক কম। বর্তমানে চীনের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ রয়েছে সোনার মজুদ। তবে ২০০৯ সালের জুনে এর হার ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জ্যানেট ইয়েলেন গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় এই সংস্থা সুদের হার চলতি বছর বাড়াবে বলে কংগ্রেসকে নিশ্চিত করলে ডলার শক্তিশালী হতে থাকে। এতে সোনার দরপতন হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ান গোল্ড মাইনারসের শেয়ারের দামেও বড় পতন দেখা গেছে। দেশটির বাজারে গত কার্যদিবসের লেনদেনে এর দাম ১৩ শতাংশ কমেছে। আর রেগিস রিসোর্সেস, নর্দার্ন স্টার রিসোর্সেস ও নিউকেস্ট মাইনিংয়ের শেয়ারের দাম গড়ে আট শতাংশ কমেছে।