Dr Khondaker Golam Moazzem on remittance

Published in দৈনিক ইনকিলাব  on Monday, 7 December 2015

অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসায় বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

ইনকিলাব ডেস্ক

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। তবে এ অর্থের প্রায় ২৫ শতাংশই আসছে অবৈধ পথে। আর অবৈধ ও রেকর্ডবিহীন এসব লেনদেনের ফলে সরকার প্রতি বছর বিদেশী মুদ্রার পাশাপাশি হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্বও। মূলত বিদেশী মুদ্রার বিনিময় মূল্য, অর্থ পেতে দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের অসহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে প্রবাসীরা বৈধ পথে অর্থ না পাঠিয়ে হুন্ডিসহ বিভিন্ন অবৈধ উপায় বেছে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সউদি আরবই বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকের সবচেয়ে বড় বাজার। আর দেশটি থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রায় ২৫ শতাংশই আসছে অপ্রচলিত বা অবৈধ পথে। এর মধ্যে কেবল হুন্ডির মাধ্যমেই আসছে ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ অর্থ।

এছাড়া বন্ধুর মাধ্যমে ৮ দশমিক ৩, পরিচিতদের মাধ্যমে ৩ দশমিক ৯৫ এবং অন্যান্য অপ্রচলিত মাধ্যমে দশমিক ৭৮ শতাংশ অর্থ আসছে। সাধারণত ব্যাংক, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, মানিগ্রাম এবং পোস্ট অফিস ব্যবহার করে যখন প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠান; সেটাকে তখন বৈধ চ্যানেল বলা হয়। আর এর বাইরে অপ্রচলিত কোনো মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হলেই সেটা অবৈধ মাধ্যম। এসব অবৈধ মাধ্যমের অন্যতম হুন্ডি। এছাড়া বিদেশে অবস্থান করা বন্ধু অথবা পরিচিত কেউ দেশে ফিরলে তার মাধ্যমেও অর্থ পাঠান প্রবাসীরা, যেগুলো অপ্রচলিত বা অবৈধ পথ হিসেবে গণ্য। কারণ এ অর্থের কোনো হিসাব থাকে না সরকারের কাছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে (২০০৫-১৪) বিভিন দেশ থেকে বৈধ পথে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার ৭৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা দেশে আসা মোট রেমিট্যান্সের ৭৫ শতাংশ। সেই হিসাবে প্রায় ৪ হাজার ২৬০ কোটি ডলার এসেছে অবৈধ পথে। বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। এছাড়া বন্ধুর মাধ্যমে ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ, পরিচিতদের মাধ্যমে ২ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং অন্যান্য অপ্রচলিত মাধ্যমে দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ আসছে দেশটি থেকে। একইভাবে মালয়েশিয়া থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ হুন্ডির মাধ্যমে, ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ বন্ধুর মাধ্যমে, ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ পরিচিতদের মাধ্যমে এবং ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ অন্যান্য অপ্রচলিত মাধ্যমে আসছে। কুয়েত থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৭ দশমিক ২২ শতাংশ হুন্ডির মাধ্যমে, ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বন্ধুর মাধ্যমে, ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পরিচিতদের মাধ্যমে এবং দশমিক ৬২ শতাংশ অন্যান্য অপ্রচলিত মাধ্যমে আসছে। আর কাতার থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ হুন্ডির মাধ্যমে, বন্ধুর মাধ্যমে ৩ দশমিক ৯৯, পরিচিতদের মাধ্যমে ১ দশমিক ১৬ এবং অন্যান্য অপ্রচলিত মাধ্যমে দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ আসছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে মুদ্রার বিনিময় হার বেশি পাওয়া যায়। আর অভিবাসীর পাঠানো অর্থ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যান স্বজনরা। অন্যদিকে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে গেলে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রবাসীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেন। প্রবাসী শ্রমিকদের অবজ্ঞার পাশাপাশি টাকা পাঠাতে প্রচুর সময় নেয় ব্যাংক। এসব কারণে অল্প আয়ের প্রবাসীরা ব্যাংক বা বৈধ পথে না গিয়ে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠান। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রবাসীরা যে সুবিধা পান, সে সুবিধা যদি সরকার না দেয়, তাহলে অবৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠানো কমবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে প্রবাসী শ্রমিকরা লাভবান হন। সরকার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নগদ প্রণোদনা ও রেমিট্যান্স পাঠানোর কমিশনটা ভর্তুকি হিসেবে দিলে প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হবেন। এছাড়া প্রবাসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা শ্রমিকদের কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো করলে হুন্ডি কমে আসবে। তিনি বলেন, রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্যাংকিং বা প্রচলিত যেসব পন্থা রয়েছে, সেগুলোর বাইরে হুন্ডি ছাড়া অন্য পন্থাগুলোকে আসলে অবৈধ বলা ঠিক হবে না। কারণ বিদেশ ফেরত একজন প্রবাসী ব্যাগেজ রুলের আওতায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার আনতে পারেন। এভাবে অনেক অর্থ আসছে; যার হিসাব থাকছে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত, বিকাশ বা এ ধরনের মাধ্যমগুলোকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সঙ্গে সংযুক্ত করা।

জানা গেছে, প্রবাসী শ্রমিকরা হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে বিদেশী মুদ্রা দেন। আর ওই হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করলে তার দেশীয় এজেন্টরা প্রবাসী শ্রমিকের আত্মীয়স্বজনের কাছে বিদেশী মুদ্রা টাকায় রূপান্তর করে পরিশোধ করে। এ ধরনের অবৈধ লেনদেনের জন্য একটি ফোনকলই যথেষ্ট। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যায় বিদেশী মুদ্রার বিনিময়ে দেশীয় টাকা।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বাংলাদেশ কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘ইন দ্য করিডোর অব রেমিট্যান্স : কস্ট অ্যান্ড ইউজ অব রেমিট্যান্স’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আসে বৈধ পথে। আর বাকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আসে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। যদিও বাংলাদেশ গৃৃহস্থালি রেমিট্যান্স জরিপ-২০০৯-এ বলা হয়েছে, মোট রেমিট্যান্সের ৮২ শতাংশ এসেছে বৈধ উপায়ে। আর অবৈধ পথে এসেছে ১৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৩৮ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে, আগস্টে এসেছিল ১১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর সেপ্টেম্বরে আসে ১৩৫ কোটি ও নভেম্বরে ১১৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন।