Dr. Subir Bairagi on Jute Industry

Published in দৈনিক জনকন্ঠ  on Sunday, 13 December 2015

ফিরে আসবে পাটের সুদিন

এমদাদুল হক তুহিন

পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সোনালি অতীত। আন্তর্জাতিক পাটের বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশের দখলে। তবে তা এখন কেবল হারানো ঐতিহ্য! আর হারানো সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতেই সরকার নিয়েছে একাধিক পদক্ষেপ। দেশীয় বাজারে সঙ্কট দেখা দেয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে কাঁচাপাট রফতানিতে। শুধু রফতানি বন্ধই নয়, একই সঙ্গে পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার বৃদ্ধি করতে বস্তার দাম কামানো হয়েছে ১০ শতাংশ। সরকার ঘোষিত দ্বৈত নীতির প্রভাবে পাটের দাম হ্রাসের কোন শঙ্কা নেই। পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে চাঙ্গা হবে পাটশিল্প। এমনকি বন্ধ পাটকলগুলোও চালু হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার ঘোষিত এসব প্রভাবে উপকৃত হবেন কৃষক।

পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে পরিচালিত হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। চলছে সাঁড়াশি অভিযান। পাট শিল্পের উন্নয়নে গঠিত হয়েছে ১২টি টাস্কফোর্স। এর সবকিছুই হারানো ঐতিহ্যকে ফিরেয়ে আনতে। সুদিন ফিরিয়ে আনতে। ধারণা করা হচ্ছে সরকার ঘোষিত এসব সিদ্ধান্তে সুদিন ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণত পণ্য রফতানি বন্ধ হলে বাজারে দাম হ্রাসের যে শঙ্কা থাকে, পাটের ক্ষেত্রে সে আশঙ্কা খুবই ক্ষীণ বলে মনে করেন একাধিক অর্থনীতিবিদ। মানভেদে প্রতি মণ কাঁচা পাটের বর্তমান মূল্য ১ হাজার ৮শ’ থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা। গত বছর এ মূল্য ছিল ১ হাজার ২শ’ থেকে ১ হাজার ৮শ’ টাকা। অর্থাৎ গত একবছরে পাটের দাম বেড়েছে ৪শ’ থেকে ৬শ’ টাকা। একাধিক তথ্য থেকে জানা গেছে, টানা কয়েক বছর ধরেই পাটের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পাট চাষে বাড়ছে কৃষকের আগ্রহ। এমনকি অনেক গ্রামেই পূর্বের তুলনায় অধিকহারে আবাদ হচ্ছে পাট। অন্যদিকে, বর্তমানে দেশে গড়ে ৭৫ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ৯ থেকে ১০ লাখ বেল কাঁচাপাট রফতানি হয়। বাকি পাট দিয়ে সরকারী-বেসরকারী ৮০টি পাটকল বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে। কিন্তু দেশীয় চাহিদার তুলনায় তা খুব নগণ্য। কোন কোন ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় সঙ্কট।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত ‘জুট এ্যান্ড বাংলাদেশ ইকোনমি’ শীর্ষক এ গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন বাস্তবায়ন সম্ভব হলে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের বার্ষিক চাহিদা ৮৪ কোটি পিসে উন্নীত হবে। বর্তমানে এ চাহিদা মাত্র ৯০ হাজার পিস। এছাড়াও সরকার ঘোষিত ধান, চাল, সার ও চিনিতে পাটের মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত করলে বছরে ৫০ থেকে ৫৫ কোটি পাটের বস্তা প্রয়োজন পড়বে। সবদিক বিবেচনা করেই সরকার কাঁচাপাট রফতানিতে আরোপ করেছে নিষেধাজ্ঞা। দাম কমানো হয়েছে পাটের বস্তার। সরকার ঘোষিত দ্বৈতনীতির প্রভাব সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে পাটের দাম যতটা দাম হ্রাস পাওয়ার কথা ঠিক ততটা কমবে না। বরং সরকার একই সঙ্গে কয়েকটি নীতি গ্রহণ করায় বাজারে পড়বে ইতিবাচক প্রভাব। ফলে উপকৃত হবেন কৃষক। আইনের প্রয়োগ সম্ভব হলে দীর্ঘমেয়াদী সময়ে দেশীয় বাজারে পাট শিল্পের প্রসার ঘটবে বলে মত তাদের।

বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজিএমসি) টানা ২২ বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে। তবে নতুন সিদ্ধান্তে লোকসানের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া এ সংস্থাটিরও সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করছেন অনেকেই। এমনকি চালু হতে পারে বন্ধ মিলগুলোও। তাহলে বৃদ্ধি পাবে কর্মসংস্থান, উপকৃত হবে দেশ। মূলত সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তারই ধারাবাহিকতায় পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার সারাদেশে চলছে সাঁড়াশি অভিযান। এরই মধ্যে বেড়েছে পাটের কদর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বাস্তবায়ন পুরোপুুরি সম্ভব হলে পাটের সোনালি দিন ফিরে আসতে খুব বেশি দিন লাগবে না। সরকার ঘোষিত নীতি প্রসঙ্গে সরকারী তিতুমীর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক তা. শা. শামীম সিদ্দিকী জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাট রফতানি বন্ধের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাবই রয়েছে। রফতানি বন্ধ হওয়ায় কৃষকের জন্যে বাজার সঙ্কুচিত হবে। অভ্যন্তরীণ বাজারে যোগান বেড়ে যাওয়ায় দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে পাট শিল্পের প্রসার ঘটলে উৎপাদন ক্ষেত্রে উৎসাহ বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু তা খুব বেশি ইতিবাচক নয়। দীর্ঘমেয়াদে পাট রফতানি বন্ধ রাখা হলে পাটের অতীত ঐতিহ্য ক্রমান্বয়ে আরও হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কৃষকরাও পাট উৎপাদন থেকে সরে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. সুবীর বৈরাগী জনকণ্ঠকে বলেন, কাঁচা পাটের রফতানি বন্ধ হওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ বাড়বে। তবে একই সঙ্গে পাটজাত মোড়ক বাধ্যতামূলক করায় বাজারে পাটের দাম যতটা কমার কথা ছিল ঠিক ততটা কমবে না। বরং পাটের বস্তার ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে জুট মিলগুলো উপকৃত হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পাটের সোনালি দিন ফেরানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরোপুরি সোনালি দিন ফেরা সম্ভব নয়। তবে পরিবেশবান্ধব পাটজাত মোড়ক ব্যহবার বৃদ্ধি পেলে অনেকাংশেই হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, সাধারণত কোন পণ্য বা দ্রব্যের রফতানি নিষিদ্ধ হলে দেশীয় বাজারে সে পণ্যের মূল্য হ্রাস পায়। তবে পণ্য বা দ্রব্যটির বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত হলে চাহিদানুয়ী যোগান বেশি না হলে বাজার চাঙ্গা হতে বাধ্য। এমনকি দেশীয় বাজারেও যোগান বেশি নয় বলে কয়েকটি তথ্যে প্রতিয়মান। অন্যদিকে সরকার বহু বছর ধরেই মোড়ক হিসাবে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছিল। ফলে কাঁচাপাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে প্রকান্তরে মোড়ক শিল্পে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে। এর প্রভাবে বাজারে দামের কিছুটা তারতাম্য ঘটলেও সত্যিকার অর্থে পাটশিল্প প্রসারিত হবে। উপকৃত হবেন কৃষক। ফিরে আসতে পারে পাটের সোনালি দিন।