বাংলাদেশে সুশীল সমাজের বিবর্তন ও কতিপয় বিতর্ক – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

The Martyred Intellectual Memorial Lecture on “Evolution of the Civil Society in Bangladesh and Some Debates”, was originally given at the Serajul Islam Lecture Hall on 11 August 2014, organised by the Department of History, University of Dhaka.

Published in Prothom Alo on Monday, 29 September 2014,

স্মারক বক্তৃতা

সুশীল সমাজের বিবর্তন ও কিছু বিতর্ক

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

বাংলাপিডিয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে এক হাজার ১১১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর হিসাব আছে। তাঁদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষক, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, সাহিত্যিক-শিল্পী-প্রকৌশলী ১৬ জন। অন্যদিকে ‘জেনোসাইড বাংলাদেশ’-এর উৎস থেকে জানতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকের সংখ্যা ১৯। প্রয়াত শিক্ষকদের কয়েকজনকে যেমন অধ্যাপক জি সি দেব ও অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী বাঙালি জাতির বরেণ্য সন্তানদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন করে, ঘটায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধে জীবনদানকারী এসব বুদ্ধিজীবীই ছিলেন বাংলাদেশের সুশীল সমাজের শিরোমণি।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৫৪-এর নির্বাচন, ১৯৫৮-এর পর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফার জন্য সংগ্রাম এবং ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান—বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধিকার ও পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক বুদ্ধিজীবী চিন্তাভাবনা-বিশ্লেষণ দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনকে পুষ্ট করেছেন। বিভিন্নভাবে মানুষকে সংগঠিত করেছেন, স্বীকার করেছেন নির্যাতন, হয়েছেন বৈষম্যের মুখোমুখি, এমনকি জীবনও দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ অধ্যাপক শামসুজ্জোহার কথা আমাদের সবার স্মরণ আছে। তাঁরা হলেন বর্তমান বাংলাদেশের সুশীল সমাজের গৌরবোজ্জ্বল পূর্বসূরি।

শব্দবিভ্রাট

প্রথমেই স্বীকার করতে হবে, ‘সুশীল সমাজ’ শব্দযূথ ‘সিভিল সোসাইটি’ নামের প্রত্যয়টির জুতসই অনুবাদ নয়। ‘সিভিল সোসাইটি’র বঙ্গমাত্রিক ধারণাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করে এ রকম বাংলা শব্দ খোঁজার প্রচেষ্টা কম হয়নি। আশির দশকের দ্বিতীয় ভাগে নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন (এনজিও) শব্দটি বাংলা করতে বহু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়েছিল। এনজিওর বাংলা এখন ব্যবহৃত হয় বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ আক্ষরিক অনুবাদ কাজে দেয়নি। আর সম্প্রতি আমরা আদিবাসী শব্দটি নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে লিপ্ত। আসলে শব্দ তো শব্দ নয়, এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক চিন্তা বা দুশ্চিন্তা। সে জন্য সঠিক শব্দচয়ন গুরুত্বপূর্ণ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) যখন ২০০৬ সালের মার্চ মাসে ‘জবাবদিহিমূলক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সুশীল সমাজের উদ্যোগ’ শীর্ষক কর্মসূচিটি শুরু করে এবং নাগরিক কমিটি ২০০৬-এর নেতৃত্বে ‘রূপকল্প ২০২১’ প্রস্তুত করে, তখন দুটি প্রত্যয়ের সঠিক বাংলা নির্ণয়ের চেষ্টা হয়। একটি ছিল ইংরেজি ‘ভিশন’ শব্দটির সঠিক বাংলা কী হবে। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে নাগরিক কমিটি ২০০৬-এর প্রথম বৈঠকের মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে ভিশনের বাংলা হবে রূপকল্প। পরবর্তী সময়ে ২ মে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়। এই অনুবাদে পৌঁছাতে আমাদের সাহায্য করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সুখের বিষয়, পরবর্তী সময়ে শব্দটি জাতীয় পর্যায়ে বহুল প্রচলন পায়; ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেরও নাম দেয় ‘রূপকল্প ২০২১’। প্রাসঙ্গিক মনে করে রূপকল্প শব্দটি ব্যবহারের উৎসটি উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করলাম।

কিন্তু ‘সিভিল সোসাইটি’র বাংলা নিয়ে কোনো ভালো নিষ্পত্তি করা যায়নি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রস্তাব করেছিলেন ‘জনসমাজ’ বা ‘আত্মজ সমাজ’। কেউ কেউ ‘সুধী সমাজ’ বা ‘পুর সমাজ’ পছন্দ করলেন। তবে অনেকেই ‘নাগরিক সমাজ’-এর পক্ষে মত দিলেন। সেটাই আমরা তখন আমাদের উদ্যোগের জন্য গ্রহণ করি, তবে ‘নাগরিক’ শব্দটিকে নগরবাসীর সঙ্গে সমার্থক করে দেখে অনেকেই আবার একমত হলেন না। তাই লক্ষ করবেন, সিপিডির ২০০৬ সালের নামকরণে একই সঙ্গে ‘সুশীল সমাজ’ ও ‘নাগরিক কমিটি’ স্থান পেয়েছে। পরে অবশ্য বিভিন্ন কারণে ‘সুশীল সমাজ’ শব্দযূথ প্রচলন পায়। যথাযথ বাংলা শব্দের অভাবে আমি সুশীল সমাজ শব্দযুগলের অসম্পূর্ণতাকে স্বীকার করে নিয়েই তা এই নিবন্ধের শিরোনামে স্থান দিয়েছি।

স্মরণ আছে, সে সময় এক বড় রাজনীতিবিদ, যিনি এখন যুদ্ধাপরাধে বিচারাধীন, আমাকে শ্লেষ করে বলেছিলেন, ‘সুশীল মানে তো নাপিত, তোমরা সবাই নাপিত।’ আমি সহাস্যে উত্তর দিয়েছিলাম, নাপিতের আরেক নাম নরসুন্দর, সুশীল সমাজ মানুষকে সুন্দর করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।

সঠিক বাংলা শব্দচয়নের সমস্যাই বলে দেয় ‘সুশীল সমাজ’ প্রত্যয়টি কতখানি জটিল। তাই এর কোনো একক ও অনন্য সংজ্ঞা আছে বলে মনে করি না। আর্থসামাজিক বিবর্তন, পরিবর্তনশীল রাষ্ট্রকাঠামো, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রবণতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সুশীল সমাজের একটি বর্গীয় সংজ্ঞা (জেনেরিক ডেফিনেশন) নিরূপণ করা গেলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রেক্ষিত নির্দিষ্ট (কনটেক্সট স্পেসিফিক)৷ সে অর্থে এটি এখনো একটি বিকাশমান প্রত্যয় (এভলভিং কনসেপ্ট), যা অনেকাংশে জাতীয় পরিস্থিতি দ্বারা নির্ণায়িত হয়।

তাত্ত্বিক বিবেচনা

সুশীল সমাজের সংজ্ঞা সন্ধানের ক্ষেত্রে প্রায়ই আমরা িখ্রষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের লেখাকে উৎসবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করি। সেই ধ্রুপদি যুগের অন্য যাঁরা ব্যক্তিসত্তার মুক্তি ও একটি ন্যায়পরায়ণ সমাজের আন্তসম্পর্ক নিয়ে আরও চিন্তা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো ও সিসেরো। সে সময় সুশীল সমাজ, রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সমাজের সমার্থক ছিল, যা বর্তমানে প্রচলিত ধারণার ঠিক বিপরীত। সে সময় সাম্রাজ্য বিস্তার দ্বারা রাষ্ট্রকাঠামোর বিকাশকে সভ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং সেটিই ছিল সুশীল সমাজের অবস্থানের নির্ণায়ক। পরবর্তী সময়ে যুক্তিবাদের যুগে রাষ্ট্র ও সমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের ধারণাটি ইউরোপীয় চিন্তকদের রচনায় বড়ভাবে স্থান করে নেয়। জন লক, জ্যাঁ জ্যাক রুশো, ইমানুয়েল কান্ট প্রমুখ সমাজবিদ দার্শনিক এই চিন্তার নেতৃত্ব দিয়েছেন।

অষ্টাদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সুশীল সমাজ নিয়ে ঔৎসুক্য নতুন মাত্রা লাভ করে। স্কটিশ নবজাগরণের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অ্যাডাম ফার্গুসন সম্ভবত সিভিল সোসাইটি প্রত্যয়টি প্রথম ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, সিভিল সোসাইটির কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে মানবজাতি তার শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর তুলে ধরতে পারে এবং সম্প্রীতির সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটাতে পারে। তিনি অর্থনৈতিক কার্যকলাপের বাইরে মানুষের একটি সামাজিক অস্তিত্বের কথা বলেন। স্কটিশ নবজাগরণের অন্য তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড হিউমের লেখার মধ্যেও ফার্গুসনের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে।

উনিশ শতকে ফরাসি সমাজবিদ অ্যালেক্সিস টকভিলের মতো অনেকেই সুশীল সমাজের সনাতনী ধারণাকে অবলম্বন করেই প্রত্যয়টির নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতা চিহ্নিত করেন। টকভিলের মতবাদের আধুনিক প্রকাশ দেখি আমরা মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট পাটনামের লেখায়। সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি ভেঙে পড়া ও শিল্পপঁুজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিধিকে চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সুশীল সমাজের প্রত্যয়গত বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়টি দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম দিকপাল জর্জ হেগেলের রচনা দ্বারা সূচিত। হেগেলের চিন্তায় সুশীল সমাজ পরিবার ও রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থার চলক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তিনি বাজারব্যবস্থা বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রেণি ও সংগঠনকে বস্তুগত স্বার্থের ধারক হিসেবে মনে করতেন। ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত উদ্যোগকেও এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের অংশ মনে করা হতো। পুঁজিবাদের পরিপক্বতা লাভের পরিপ্রেক্ষিতে ও হেগেলীয় চিন্তার ওপর ভিত্তি করে মহামতি কার্ল মার্ক্স সুশীল সমাজের ধারণাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজকে প্রতিস্থাপন না করে তিনি এ দুটিকে পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী সহযোগী হিসেবে দেখেছেন। তাই তিনি প্রাক্কলন করেছিলেন শ্রমিকশ্রেণি, আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বহারার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে, জিম্মি রাষ্ট্রকে মুক্ত করবে। সে ক্ষেত্রে সুশীল সমাজও সর্বহারার নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রে যুক্ত হয়ে প্রকৃত জনমঙ্গলে নিবিষ্ট হবে।

সুশীল সমাজসম্বন্ধীয় তাত্ত্বিক চিন্তার আধুনিক পর্যায়ে হেগেলীয় ও মার্ক্সীয় চিন্তার সংশ্লেষণ ঘটে অকাল প্রয়াত ইতািলর সুবিখ্যাত চিন্তাবিদ অ্যান্তনিওনি গ্রামিসের লেখনীতে। গ্রামিস আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘রাজনৈতিক সমাজ’ ও ‘সুশীল বা নাগরিক সমাজ’ এই দুটি প্রত্যয়ের অবতারণা করেন। এখানে প্রথমটি প্রত্যক্ষভাবে এবং প্রায়ই নিবর্তনমূলকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে (ব্যাপক অর্থে) ব্যবহার করে তার আধিপত্য বিস্তার করে। অন্যদিকে, সুশীল সমাজ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বেচ্ছামূলকভাবে সংগঠিত হয়ে তার অধিকারের জায়গাটুকু রক্ষা করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রসম্পর্কিত ও রাষ্ট্রবহির্ভূত (নন-স্টেট) কর্মের কর্তারা একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ভেতর দিয়ে বাজার, পরিবার ও সমাজের চৌহদ্দি নিরন্তরভাবে নির্ধারণ করতে থাকেন। গ্রামিস অবশ্য নিজেই বলেছেন, দুই সমাজের এই বিভাজন নিতান্তই একটি বিশ্লেষণী কাঠামো; কারণ বহু ক্ষেত্রেই এরা আংশিকভাবে হলেও একে অন্যের অপ্রকৃত (ভার্চুয়াল) বেষ্টনীতে ক্রিয়াশীল হয়।

সুশীল সমাজসম্পর্কিত গ্রামিসয় বিশ্লেষণী কাঠামোর বিপরীতে ইদানীং পাটনামের বিশ্লেষণী ধারা বহুল প্রচলন পেয়েছে। তাঁর ধারণা অনুযায়ী সরকারের দক্ষতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন—এ দুটিই ‘নাগরিক সম্প্রদায়’-এর তৎপরতার ফলে অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। পাটনাম একে বলেছেন ‘সামাজিক পুঁজি’ (সোশ্যাল ক্যাপিটাল), যা ‘নাগরিক শক্তি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং এ দুটো যখন পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের দ্বারা অনুবিদ্ধ (এমবেডেড) হয়, নাগরিক শক্তি তখনই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। লক্ষণীয়, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের বিশ্লেষণে গ্রামিসয় কাঠামো মৌলিকভাবে প্রাসঙ্গিক হলেও নব্য টকভেলীয় (পাটনাম প্রবর্তিত) ধারণাগুলোও বাস্তবতা অনুধাবনে বেশ সহায়ক।

রাষ্ট্রজীবনে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার এই দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে উপনিবেশবাদবিরোধী বহু মুক্তিসংগ্রামকে প্রভাবিত করে। গ্রামিস সুশীল সমাজের মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে সংলগ্ন-বুদ্ধিজীবীর (অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল) উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখেছেন। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকায় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বহু নেতা এ ধরনের বুদ্ধিজীবী হিসেবে ভূমিকা পালন করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ ৬ দফা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত বুদ্ধিজীবীদের যেমন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রমুখকে অর্গানিক বুদ্ধিজীবী বলতে চাইবেন। বাংলাদেশের বামপন্থী অনেক নেতাই ছিলেন এ দলের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে মনে পড়ে শ্রমিক হিসেবে আদমজী পাটকলে কর্মরত অবস্থায় নিহত উচ্চশিিক্ষত কমিউনিস্ট সংগঠক শহীদ তাজুলের কথা।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত শহীদ বুদ্বিজীবী স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত।)

আগামীকাল: সুশীল সমাজ: সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।


Published in Prothom Alo on Tuesday, 30 September 2014,

স্মারক বক্তৃতা
সুশীল সমাজ: সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনে মার্কোসবিরোধী ‘হলুদ বিপ্লব’ নাগরিক আন্দোলনের নতুন পর্যায়ের সংকেত দেয়। নব্বইয়ের দশকে অবশ্য পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনার কারণে সুশীল সমাজের সংজ্ঞা, প্রকাশ ও ভূমিকা নতুন রূপ নেয়, নতুন বিতর্কেরও জন্ম দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ থেকে নব্য গণতন্ত্রের যে প্রসার আমরা দেখতে পাই, সেখানে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের নবোদ্ভিন্ন সুশীল সমাজের ভূমিকা নজর কাড়ে বিশেষভাবে। ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামোগত বিপর্যয়ের মুখে ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’, ‘আমরাই শতকরা ৯৯ ভাগ’—এসব স্লোগান নিয়ে যে জনবিস্ফোরণ লক্ষ করি, তারও নেতৃত্ব দেয় সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংগঠন। হয়তো বাংলাদেশের গণজাগরণ মঞ্চের অভিজ্ঞতাকেও এই আলোকে দেখার সুযোগ আছে।

বলা বাহুল্য, এসব আঞ্চলিক ও জাতীয় অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সুশীল সমাজের ভূমিকা স্থান, কাল ও পাত্রভেদে বৈচিত্র্যময়। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুশীল সমাজ গোষ্ঠীচিন্তা দ্বারা তাড়িত হয়ে রাষ্ট্রের একক প্রাধান্য বিস্তারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। তাই দ্বন্দ্বের মূল জায়গাটা ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক। এই দ্বন্দ্বের চরিত্রটি গ্রামসির ‘দুই সমাজের’ তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে (স্বল্পোন্নত দেশে) সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের সামাজিক পুঁজিবাজারের উদ্যোগও বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় সহায়তা করে। লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সম্প্রদায় গ্রামসির চিন্তার বিপরীতে নব্য-টকভেলীয় ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে।

আগের আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে ‘সুশীল সমাজ’ এক দিকে যেমন একটি প্রত্যয়, অপর দিকে একটি প্রক্রিয়া। প্রত্যয়টি সম্পর্কে গভীরতর উপলব্ধি প্রক্রিয়াটির গতিপথে বেগ এনেছে; অপর দিকে প্রক্রিয়ার অগ্রাভিমুখী যাত্রা প্রত্যয়টিকে আরও বাস্তবমুখী করেছে। সুশীল সমাজ তথা নাগরিক আন্দোলনের বহুমাত্রিকতা সহজবোধ্য হয়, যখন আমরা তার কর্মভিত্তিক প্রকাশকে বিবেচনায় নিই। এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সংঘসহ পেশাজীবীদের সংগঠন, নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা গোষ্ঠীর লক্ষ্যে সমর্থনমূলক উদ্যোগ, বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত সম্প্রদায়গত উদ্যোগ, প্রচারমাধ্যম, জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংস্থা ইত্যাদি। রয়েছে নারী অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আন্দোলন।

বাংলাদেশে সুশীল সমাজে কতগুলো প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত, তার কোনো হিসাব আমাদের জানা নেই। অনেক গবেষক এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের আয়তন নিরূপণ করেছেন, যা নিতান্তই একটি সংকীর্ণ প্রচেষ্টা। অনেকে আবার আরও সংকীর্ণ সংজ্ঞার ভিত্তিতে এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেই শুধু সুশীল সমাজ ভেবেছেন। তবে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সবচেয়ে দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী অংশটি দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের জন্য সচেষ্ট, রাষ্ট্রীয় নীতি–পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক করে, মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকে। এরা মূলত উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিকামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের সুশীল সমাজের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকারের কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। সে সময়টি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের এক ক্রান্তিকাল, যেখানে রাজনৈতিক সমাজ আর সুশীল সমাজ অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করেছে। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরে ফেরা সুশীল সমাজের এই অনন্য ব্যক্তিরা শরণার্থী পুনর্বাসন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে যুক্ত হন। এই প্রবণতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ব্র্যাক, যা আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। অপর উদাহরণ হলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, যেটি বিশ্বে গণমুখী চিকিৎসাসেবার একটি মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

এরপর আমরা লক্ষ করি, ওই সব সংগঠন ও ব্যক্তি জরুরি পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রম থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন তথা একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র গড়ে তোলায় সচেষ্ট হয়। ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন সামাজিক শক্তি তখন ‘দেশ গড়ার’ আন্দোলন সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও শ্রমিকশ্রেণির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গ্রামীণ ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষমতায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই পরিবর্তনের চেষ্টায় অগ্রণী হয়। এই প্রবণতারই ধারাবাহিকতায় কিছু প্রতিষ্ঠান আইনি সহায়তা প্রদান তথা মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে ব্রতী হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতীয় রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসে, তার ফলে সুশীল সমাজকে জনমানুষের অর্থনৈতিক দুর্গতি মোচনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বিভিন্নভাবে যুক্ত হতে হয়। আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে একতাবদ্ধ করতে ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে ৩১ জন বুদ্ধিজীবী যে যুক্ত বিবৃতি দিয়েছিলেন, তৎকালে তা কী সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিল। পরবর্তীকালে সাংবিধানিক পথে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে তিন জোটের যে যুক্ত ঘোষণা আসে, তার রূপরেখাটিও কিন্তু একটি সুশীল সমাজের গোষ্ঠীর কাছ থেকেই আসে, যেখানে প্রয়াত ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আর আশির দশকজুড়ে ‘ঢাকা অবরোধ’সহ রাজপথের আন্দোলনে সংস্কৃতিসেবীরা, পেশাজীবীরা ও ছাত্র-যুবকর্মীরা তো ছিলেনই। তাই ১৯৯১-এর পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে নবযাত্রা সূচিত হয়, তাকে মূর্ত রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকা অবশ্যই স্মরণীয়, বিশেষ করে ছাত্র-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক কর্মী-পেশাজীবীদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আর সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতে হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের অসমাপ্ত দায়—পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধী দোসরদের বিচারের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের কথা। স্মতর্ব্য, গণ-আদালতের প্রত্যেক সদস্যই ছিলেন সুশীল সমাজের অংশ। তাই ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আজ যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আমরা দেখি, তাকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের অনেক ত্যাগ ও অবদান রয়েছে। আর এর মাঝে বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের দুর্দশা মোচনে বিভিন্ন উদ্যোগ তো ছিলই। ছিল একটি তথ্য অধিকার আইন পাসের এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন গঠনের সফল আন্দোলন। আরও ছিল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী উদ্যোগ। ছিল তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা কমিটির কার্যক্রম।

সাম্প্রতিক প্রবণতা

তত্ত্ব যতই পরিপক্ব হোক না কেন এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা যা-ই বলুক না কেন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের সংজ্ঞা নিয়ে জাতীয়ভাবে স্বচ্ছ ঐকমত্য এখনো লক্ষ করা যায় না। এখানে সুশীল সমাজ ও সুশীল সমাজের সংগঠন—এ দুটির মাঝে পার্থক্য করতে হবে। কারণ, সুশীল সমাজ সর্বদা কাঠামোগতভবে সংগঠিত না–ও হতে পারে। অনেক দেশেই বা অনেক পরিস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক উদ্যোগ আন্দোলন পরিচালনা করে থাকে, যার প্রথাগত অর্থে কাঠামো, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ও কর্মপন্থা থাকে না, থাকে না স্বীকৃত নেতৃত্ব। সেই অর্থে সুশীল সমাজের অভিপ্রকাশে লক্ষ করা যায় তারল্য ও নমনীয়তা।

অনানুষ্ঠানিক নাগরিক উদ্যোগের চরম প্রকাশ হচ্ছে, ব্যক্তি নাগরিক যখন একাই নৈতিক অবস্থান থেকে কোনো অন্যায় বা বৈষম্যের প্রতিবাদ করে। একাই পোস্টার হাতে (কখনো বা পরিবার-বান্ধবদের নিয়ে) দাঁড়িয়ে যায় প্রেসক্লাবের সামনে অথবা শহীদ মিনারে। ২০১৪ সালের ৫ মে গুম-হত্যার বিরুদ্ধে সংসদ ভবনের সামনে নাগরিকেরা যে মানববন্ধন করেন, সেটা ছিল এ রকমই এক অনানুষ্ঠানিক উদ্যোগ। তবে নাগরিক হলেই সে সক্রিয়ভাবে সুশীল সমাজের অংশ হয় না। নাগরিক তখনই সমাজ হয়, যখন সে নির্দিষ্ট বিষয়ে তার অবস্থান ও মতামতকে প্রকাশ্যভাবে উপস্থাপন করে, সামান্য হলেও তার অবস্থানের জন্য ঝুঁকি নেয়। তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের যুগে অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ব্লগারদের আমরা সুশীল সমাজে নবতম অন্তর্ভুক্তি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

সুশীল সমাজের এই ব্যাপকতর সংজ্ঞা তাকে চিহ্নিতকরণ ও দায় নির্দিষ্টকরণে বিপত্তি সৃষ্টি করে বলে অনেকে মনে করেন। সে ক্ষেত্রে যেটা উল্লেখ্য সেটা হলো, গোটা কয়েক ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য আছে, যা দিয়ে সুশীল সমাজ ও তার অন্তর্ভুক্ত সংগঠনকে দ্রুত চেনা সম্ভব। প্রথমত, সে রাষ্ট্রের অংশ হতে পারবে না। এমনকি অর্থায়নসহ স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না সরকারের সঙ্গে। অবশ্য বেশ কিছু বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশীদার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় সুশীল সমাজের এই বৈশিষ্ট্যটি অনেক সময় প্রশ্নের মুখোমুখি হয়।

দ্বিতীয়ত, সুশীল সমাজ কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। এটার অর্থ এই নয় যে সুশীল সমাজের কোনো রাজনৈতিক চিন্তা বা মূল্যবোধ থাকবে না। বিষয়টি হচ্ছে, সুশীল সমাজের কোনো সক্রিয় ব্যক্তির রাজনৈতিক দলীয় সদস্যপদ থাকাটা সমস্যাজনক। এটা আরও সমস্যা সৃষ্টি করে, যখন সেই ব্যক্তি শাসক দলের কোনো দায়িত্বে থাকেন। এর ফলে সংগঠন বা আন্দোলনের স্বাধীন চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়ে যায়।

তৃতীয়ত, সুশীল সমাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ হতে হবে। একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে সুশীল সমাজ প্রকাশ্যভাবে, রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতিমালার আওতায় তার ইচ্ছাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই কাম্য। সেই জন্য সে প্রচার ও সমাবেশের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করবে, জনসম্পৃক্ততা বাড়াবে।

সাধারণভাবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের তিনটি মৌলিক ও ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য হলো: রাষ্ট্রবহির্ভূত সংগঠন, রাজনৈতিক দলের বাইরে অবস্থান এবং ঘোষিত কর্মসূচির পক্ষে প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ কর্মকাণ্ড পরিচালনা।

সুশীল সমাজ তার মেধা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও শক্তি সমাজের কোন শ্রেণির পক্ষে ব্যবহার করে, তার ওপর নির্ভর করে তার চরিত্র—তারা যেমন সুরক্ষিত মূলধারার ক্ষমতাবানদের পক্ষে তদবির করতে পারে, আবার ক্ষমতাহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্যও লড়াই করতে পারে—এই অবস্থানগত পার্থক্যই নির্ধারণ করে সুশীল সমাজের ঐতিহাসিক ভূমিকা।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত শহীদ বুদ্বিজীবী স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত।)

পরবর্তী পর্ব: বাংলাদেশের সুশীল সমাজ: বিতর্কসমূহ

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিশেষ ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।


Published in Prothom Alo on Wednesday 1 October 2014,

স্মারক বক্তৃতা
সুশীল সমাজ: সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

কর্মপরিধি

সুশীলসমাজের কর্মপরিধি নিয়েও অনেক সময় বিভ্রা‌ন্তি লক্ষ করা যায়। অনেকেই অভিযোগ করেন, এরা প্রায় ‘সব বিষয়ে’ কথা বলে। এই বিষয়সূচি বেশ দীর্ঘ। মূলত তা হচ্ছে সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রায়ণ, দুর্নীতিমুক্তকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, সমাজের অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কমানো ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ সংগঠনের মধ্যে তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথম ধারায় আছে সেই সব প্রতিষ্ঠান, যারা তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী উদ্যোগ পরিচালনা করছে। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা সদস্য সংগ্রহ করে থাকে। তাদের অনেকেরই আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ে সংগঠন থাকে। তাদের প্রচলিত ভাষায় ইমপ্লেমেন্টিং সিএসও/এনজিও বা (উন্নয়ন) কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থা বলে। বাংলাদেশের কয়েক হাজার বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বা এনজিও এরা।

দ্বিতীয় ধারার সংগঠনগুলো হচ্ছে, যারা মূলত গবেষণা ও নীতি পর্যালোচনা করে। এরা যে শুধু থিংক ট্যাংক তা নয়; বিজ্ঞান চক্র, সাক্ষরতা আন্দোলন ইত্যাদি এর অংশ। এদের প্রায়ই নলেজবেজড সিএসও বলে। সিপিডি এই কাতারে অন্তর্ভুক্ত।

তৃতীয় ধারায় রয়েছে, যাদের আমরা অ্যাডভোকেজ সিএসও বলি। দুর্নীতি, বৈষম্য, বঞ্চনা, অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এরা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সোচ্চার থাকে এবং প্রতিরোধ সৃষ্টিতে সক্রিয় থাকে। এই ধারার অগ্রণী উদাহরণ হলো আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। যেহেতু এই ধারা তাদের কাজের চরিত্রের কারণে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, অনেকেই সুশীল সমাজ বলতে এদেরই বোঝেন। যেহেতু এই ধারার সংগঠনগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূল মূল প্রতিষ্ঠানের ওপর সামাজিক নজরদারির দায়িত্ব পালন করে, তাই বাহ্যত মনে হতে পারে যে তারা রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে অযাচিতভাবে মতামত দিচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাস্তবে অনেক সংগঠনই একই সঙ্গে একাধিক (বা তিনটি) ধারাতেই কাজ করে। সুশীল সমাজের সংগঠিত অংশের এই কাঠামোগত সংহতি নিঃসন্দেহে তাদের কণ্ঠস্বরকে আরও উচ্চকিত করে। আর যাদের স্বার্থে তা আঘাত করে, তারা বিচলিত ওÿ ক্ষুব্ধ হয়। উপরোল্লিখিত তিনটি শ্রেণিবিভাগে, বাংলাদেশে সুশীল সমাজের মূলধারাটি এখনো উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিকামী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত।

রাজনীতি

সুশীল সমাজ সামগ্রিকভাবে না হলেও তার কিছু কিছু নেতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সামাজিকভাবে সচেতন ও সক্রিয় ব্যক্তির জন্য দেশের আর দশজন নাগরিকের মতো রাজনৈতিক ভূমিকা পালনের ইচ্ছা থাকাটা অযৌক্তিক নয়। অনেক সময় আবার এই উপলব্ধি আসতে পারে যে রাজনৈতিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে না পারলে মানুষের দুঃখ-কষ্ট স্থায়ীভাবে নিরাময় করা সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, ১৯৭২-এর জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংশোধনের মাধ্যমে বিদেশি সাহায্য লাভকারী কোনো উন্নয়নধর্মী প্রতিষ্ঠানের প্রধানের জাতীয় নির্বাচন করার অধিকার চাকরি ছাড়ার তিন বছর পর্যন্ত রহিত করা হয়েছে। এই বিধান সরকারি কর্মচারীদের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য।

রাজনীতিতে নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংগঠনকে ব্যবহার করা অবশ্যই অনুচিত। প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে তাদের ‘সমাজ’ বদল করা উচিত। তবে সুশীল সমাজে রাজনীতি প্রবেশের অপর মাধ্যম হচ্ছে যখন রাজনৈতিক দলগুলো পেশাজীবীদের সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দলীয় ছত্রচ্ছায়ায় নিয়ে আসে, কোনো সময় তা করে সংগঠনগুলোকে বিভক্ত করে। এতে তারা নামে সুশীল সমাজ থাকলেও কার্যত রাজনৈতিক সমাজের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়। বাংলাদেশের একটি অন্যতম বড় বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা যখন পদে থেকেই সক্রিয় দলীয় রাজনীতি শুরু করেন, তখন তাঁর সংগঠনে বিপর্যয় নেমে আসে।

তবে সাম্প্রতিক কালে ভারতের আম আদমি পার্টির (এএপি) আবির্ভাব অনুধাবনীয়। তথ্য অধিকার আইন ও জন লোকপাল আইনের জন্য আন্দোলন করতে করতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁর সহকর্মীরা নাগরিক আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি করেন। একই সঙ্গে জনমানুষের মধ্যে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে কোনো একটি বিকল্প ধারার আকাঙ্ক্ষাকে অনুভব করেন। সৃষ্টি হয় এএপি, যেখানে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যোগদান করেন এবং দলটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। তাঁরা দিল্লি অঞ্চলের সরকারও গঠন করেন। যদিও তাঁরা প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে নতুন ধারার রাজনীতি পরিচালনার সমস্যাগুলো দ্রুতই টের পান। যা-ই হোক, এএপির অভিজ্ঞতাটি হলো সুশীল সমাজ থেকে রাজনৈতিক সমাজে পরিণত হওয়ার একটি ধ্রুপদি উদাহরণ। বাংলাদেশে কেউই এ ধরনের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে নিতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

বিরাজনৈতিকীকরণ

বাংলাদেশের সুশীল সমাজ দেশে বিরাজনৈতিকীকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত বলে কেউ কেউ অপবাদ দেন। অনেক সময় তথাকথিত এক-এগারোর সরকারের প্রতি কথিত সমর্থনকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আমাদের মনে থাকার কথা, ২০০৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিবদমান দুই রাজনৈতিক পক্ষ, নিজস্ব অভিন্ন গোষ্ঠী স্বার্থ বিস্মৃত হয়ে, শা‌ন্তিপূর্ণভাবে সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যর্থ হয়। সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক শূন্যতা, জাতীয় জীবনে অনিশ্চয়তা। নিঃসন্দেহে এই পরিস্থিতি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক উচ্চবর্গীয়দের অপরিপক্বতার ফল। স্মরণ রাখতে হবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চারজন সদস্য—ড. আকবর আলি খান, আইনজীবী সুলতানা কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শফি সামী ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান হাসান মাসুদ চৌধুরী—সংবিধানের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন সুশীল সমাজের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। যে শক্তি পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে, তা সংবিধানের প্রলম্বিত ব্যাখ্যা দিয়ে উচ্চ আদালতের অনুমোদনে দুই বছরের শাসনা‌ন্তে একটি সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এর মধ্যবর্তী সময়ে সেই সরকার (যার ভেতর একাধিক সরকার ছিল বলে মনে করা হয়) বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলেও তার অকার্যকর ও কলুষিত প্রয়োগ তাকে জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

বাংলাদেশের সাংঘর্ষিক রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ সুশীল সমাজ, তথা জনগণের একটা বড় অংশ হয়তো মনে করেছিল, এক-এগারোর সরকার যেসব দুর্নীতিবিরোধী ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, তা আপাতদৃষ্টিতে সুশীল সমাজের বহু দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গকে শক্তিশালী করে উন্নততর ভিত্তিতে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন যাত্রা শুরু হবে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা স্পষ্ট হয়, এটি ছিল একটি ভ্রান্ত প্রত্যাশা। কারণ, চলমান রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বদাই নতুন নতুন স্বার্থগোষ্ঠীর জন্ম দেয়, যারা এসব সংস্কারের সম্ভাবনায় ভীত হয়ে প্রতিশ্রুত কার্যক্রমকে বিপথগামী করে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদেরা যে দোষে দুষ্ট বলে মনে করা হয়, তারাও সে রোগে দ্রুত আক্রান্ত হয়। উপরন্তু, সংস্কার যদিও কিছু হয়, তা যে পরবর্তী সরকারের আমলে টেকসই হবে, তারও নিশ্চয়তা থাকে না। তাই অনির্বাচিত সরকার দ্বারা সুশাসন অর্জনের ক্ষেত্রে টেকসই পরিবর্তন আনা যায় না—এই অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের পথচলায় ভবিষ্যতে উপকারী হবে। তবে যথা সময়ে নির্বাচনের দাবিতে সুশীল নেতারা ছিলেন একনিষ্ঠ। তাই গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়া যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেই লক্ষ্যে ক্ষমতায় থেকে দল গঠনের মতো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তাঁরা সর্বদাই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ।

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ার মূল কারণ হলো দুর্বল রাষ্ট্রীয় অঙ্গসমূহ, অনুন্নত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং অনুপযুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই পরিস্থিতিতে অরাজনৈতিক শক্তি বা ভিনদেশি শক্তির জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। তাই ঐতিহাসিক উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব যে বিরাজনৈতিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রকৃত উৎস সুশীল সমাজে নয়, রাজনৈতিক সমাজে নিহিত। উপরন্তু, রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতিমালাকে লঙ্ঘন করে যখন শাসকশ্রেণি, যখন ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থকেই অন্যায় আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তখনই সমাজে বিরাজনৈতিকীকরণের ধারা বেগবান হয়।

বৈধতা ও প্রতিনিধিত্বশীলতা: বিভিন্ন জাতীয় বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের বৈধতা ও তার প্রতিনিধিত্বশীলতাকে প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সক্রিয় সংগঠনই সরকারের কাছে তার কর্মপরিকল্পনা ও অর্থায়নের উৎস সম্বন্ধে তথ্য দিয়ে, অনুমতি নিয়ে তাদের তৎপরতা পরিচালনা করে।তাই মাঝেমধ্যে কোনো বিরূপ সরকারি কর্তাব্যক্তি যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন তা নিতান্তই অজ্ঞানতাপ্রসূত।

তবে সুশীল সমাজের মূল বৈধতা কোনো সরকারি আমলা দ্বারা নির্দিষ্ট হয় না। সেটা হয় তার লক্ষ্যনির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা অংশীজনদের সামাজিক অনুমোদনের মাধ্যমে। তাই সুশীল সমাজের বৈধতার প্রয়োজনীয় শর্ত যদি হয় সরকারি অনুমোদন, তার বৈধতার যথেষ্ট কারণটি (সাফিশিয়েন্ট কন্ডিশন) জনমানুষের নীরব সম্মতিতে প্রোথিত। তাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে কোনো সুশীল সংগঠনের বিবাদে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম থাকে।

শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে মতপার্থক্য হলেই সুশীল সমাজের নেতাদের প্রতিনিধিত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বলা হয়, ‘যোগ্যতা থাকলে নির্বাচন করে আসুন।’ মনে হয়, দেশ নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করতে হলে সবাইকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় জীবনে বৈধতার একমাত্র রূপ নির্বাচনী বৈধতা নয়। যদিও এখানে জনপ্রতিনিধিদের অধিকারকে খাটো করে দেখা হচ্ছে না। বিকাশমান সমাজে সুশীল সংগঠনের সামাজিক প্রতিনিধিত্বশীলতার উৎস হচ্ছে তাদের সদস্য ও অংশীজনেরা। তবে সমাজে সব প্রতিনিধিত্বশীলতাই আংশিক। এরূপ আংশিক প্রতিনিধিত্বশীলতা নিয়ে বিরাজ করেন স্কুলের শিক্ষক, স্থানীয় চিকিৎসক, গ্রামীণ সমাজপতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী উদ্যোক্তা ও ধর্মগুরুরা। মিডিয়ার ক্ষেত্রে একজন সম্পাদক যখন তাঁর লেখনী ধরেন, তখন বৈধতা আসে প্রত্যেক পাঠকের কাছ থেকে, যাঁরা পয়সা দিয়ে প্রতিদিন সকালে পত্রিকা কেনেন। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন টিভি দর্শক অন্য চ্যানেলে চলে না যাচ্ছেন, ততক্ষণ তিনি একটি টক শোকে বৈধতা দিচ্ছেন, এমনকি অংশগ্রহণকারীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত না হলেও।

তবে শেষবিচারে সুশীল সমাজের বৈধতা ও প্রতিনিধিত্বশীলতা নিরূপিত হয় তার নৈতিক শক্তির দ্বারা। তাই লক্ষ করা যায়, অনেক সময় চরিত্র হনন করে জনমানসে সুশীল সমাজের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নৈতিক অবস্থান দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়।

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত শহীদ বুদ্বিজীবী স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত।)

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)


Published in Prothom Alo on Thursday 2 October 2014,

স্মারক বক্তৃতা
রাজনীতিক ও সুশীল সমাজ প্রতিপক্ষ নয়

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

তিনটি দুর্বলতা: তাহলে সুশীল সমাজ এবং এর অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলোর মূল দুর্বলতা কোথায়? যেহেতু এই সমাজ বৈচিত্র্যময়, সেহেতু এসব সংগঠনের সমস্যাগুলোও বিভিন্ন। তবু আমার বক্তব্যের শেষে তিনটি নির্বাচিত অভিন্ন সমস্যা উল্লেখ করছি।

ক. সুশীল সমাজের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থানকে সংহত করা। যেহেতু চলমান রাজনীতি আমাদের সমাজকে গভীরভাবে দ্বিখণ্ডিত করেছে, সেহেতু বিশ্বাসযোগ্যভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে নিরপেক্ষতা রক্ষা করা কঠিনতর হয়ে উঠছে। পেশাদারত্বের সঙ্গে কর্ম সম্পাদন দুরূহ হয়ে উঠছে। উল্লেখ্য, সুশীল সমাজের নেতারাও অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চবর্গের মানুষ হয়ে থাকেন। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা কোনো ঝুঁকি নিতে উৎসাহী হন না। কেউ কেউ হয়তো এটা তাঁদের যথোপযুক্ত নাগরিক সাহসিকতার অভাব বলে অভিহিত করবেন।

খ. সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর একটি বড় অংশে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ভঙ্গের ঘটনা ঘটে, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, যদিও দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে একটি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তার পরও অনেক গ্রামীণ এনজিও প্রকৃতপক্ষে শোষণমূলক সুদের ব্যবসায় নিয়োজিত। তবে এদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করপোরেট এনজিওগুলোকে এক করে দেখা ঠিক হবে না।

গ. সুশীল সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। নেতৃত্বের হস্তান্তর ঘটে না। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ-প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়, প্রতিষ্ঠানের টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ে। নেতৃত্বের উত্তরাধিকার সৃষ্টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিকাঠামো শক্তিশালী করে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা দরকার।

সমাপনী মন্তব্য

বাংলাদেশের সুশীল সমাজ তার দীর্ঘ পথ চলায়, সিঁড়ি ভাঙায় আজ এক বিশেষ মুহূর্তে উপনীত হয়েছে। রাজনৈতিক সমাজ ও সুশীল সমাজের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থার সম্পর্কটি এই মুহূর্তে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ভঙ্গুর। সম্প্রতি ঘোষিত সম্প্রচার নীতিমালা এই আস্থার ভিতকে আরও একটু দুর্বল করে দিয়েছে।

স্বাধীনতা–পূর্বকালের স্বাধিকার আন্দোলনে, প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে, স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গড়ার উদ্যোগে এবং দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ প্রায়ই রাজনৈতিক সমাজের সঙ্গে পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। লক্ষণীয়, গত দুই দশকে গণতন্ত্রের নবযাত্রায়, এই সম্পর্ক পরিপূরকতা থেকে ক্রমান্বয়ে প্রতিযোগিতামূলক এবং অনেক সময় বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলে রাজনৈতিক সমাজ সর্বদাই অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার সুশীল সমাজকে পাশে পেতে চায়। আর রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করলে সেই রাজনৈতিক গোষ্ঠীই জবাবদিহির দাবির মুখে সুশীল সমাজকে প্রতিপক্ষ মনে করছে। কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সুশীল সমাজের সঙ্গে এই বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক আরও প্রকটভাবে অনুভূত হচ্ছে।

গ্রামসীয় বা নব্য টকভেলীয়—যে ব্যাখ্যাকাঠামোই প্রয়োগ করি না কেন, তাতে দেখা যায়, জাতীয় অগ্রগতির ধারাকে ধাবমান রাখার ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি সহায়ক নয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থা টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত—এটি একটি স্বীকৃত সত্য। এর বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব যখন সুশীল সমাজকে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে অপারগ করে, তখন রাজনৈতিক সমাজ তার আলোকিত আত্মস্বার্থ রক্ষায় পর্যুদস্ত হয়। তখন সমাজে, অর্থনীতিতে ও বৈদেশিক সম্পর্কে যে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা দেখা দেয়, তা শান্তিপূর্ণ ও ফলপ্রসূভাবে নিরসনের কোনো জায়গা থাকে না। সৃষ্টি হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। বিপর্যস্ত হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের যৌথ লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমাজ ও সুশীল সমাজের মধ্যে উদার ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রীয় মনোভঙ্গির বাতাবরণে একটি আস্থা প্রবর্ধক নীতি-সংলাপ দেশে আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। শহীদ স্মৃতির প্রতি আবারও শ্রদ্ধা জানিয়ে আশা করব, সংশ্লিষ্ট পক্ষরা চিন্তার আদান-প্রদানের এই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আন্তরিকতা ও পরিপক্বতা প্রদর্শন করবে। (শেষ)

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত শহীদ বুদ্বিজীবী স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত।)

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।


Published in The Daily Sangbad during 30 August – 1 September 2014

Click here to read more about the lecture