Its Better Not to Stand First in Corruption – Dr Khondaker Golam Moazzem

Published in দৈনিক সমকাল on Sunday, 31 January 2016

সব ফার্স্ট ভালো নয়

– ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণা সূচকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির হেরফের হয়নি। দুর্নীতি বিষয়ে যারা অনুসন্ধান করেন, বাংলাদেশকে যারা এ কালান্তক ব্যাধির কবল থেকে মুক্ত করতে চান, তাদের মত ব্যক্ত হয়েছে এভাবে_ দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়ে গেছে। বার্লিনভিত্তিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-টিআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এখন আর বাংলাদেশ চিহ্নিত হচ্ছে না। কিন্তু সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকা করলে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩তম স্থানে। সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত। তার পর একে একে নাম বলতে থাকলে ১৩ সংখ্যাতেই নাম আমাদের দেশের। এভাবে আরও এগিয়ে গেলে ১ নম্বরে বলতে হবে ডেনমার্কের নাম। বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ হিসেবে চিহ্নিত ইউরোপের এ দেশটি। আমরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেই পারি_ ২০০১ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ১ নম্বর হয়েছি। সেই দিন কবে আসবে, কখন ডেনমার্কের মতো সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ হিসেবে ১ নম্বর হবো! আমরা পেছনে অবস্থানের দিকে ফার্স্ট ছিলাম; এখন রয়েছি নিচ থেকে ১৩তম অবস্থানে। ক্রমে ওপরে যেতে যেতে ওপরের প্রথম অবস্থানটি চাই যে।

দুর্নীতি ও অনিয়ম অনেক দেশেই হয়। ট্রান্সপারেন্সির ধারণা সূচকে কোনো দেশই ১০০ স্কোর করতে পারেনি। যে ডেনমার্ক সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে আবারও, তাদের এবারের স্কোর ৯১। আর বাংলাদেশের স্কোর ২৫। বিশ্বে গড় স্কোর ৪৩। উত্তর কোরিয়া ও সোমালিয়ার স্কোর ৮। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের তুলনায় খারাপ চিত্র আফগানিস্তানের। তারপরই বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে কম দুর্নীতি হয় ভুটানে। সার্বিক বিবেচনায় আমাদের অগ্রগতি না হওয়া কষ্টের বৈকি। আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে আরেকবার প্রমাণ হলো যে, সুশাসনের অভাব এখনও কতটা প্রকট। অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কাজটি এখন পর্যন্ত ঠিকভাবে করা যায়নি। উন্নয়নের পথে মস্ত বড় বাধা দুর্নীতি_ এটা সবাই স্বীকার করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি প্রতি বছর বিশ্ব প্রতিযোগিতা সক্ষমতার যে ধারণা উপস্থাপন করে, তাতে উন্নয়নের পথে প্রধান তিনটি বাধার মধ্যে দুর্নীতি থাকছেই। গত এক দশকে এ চিত্রে কোনো রদবদল নেই। আমাদের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুর্নীতিই প্রধান সমস্যা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত অন্যরাও বলছেন একই কথা। গণমাধ্যমেও বলা হচ্ছে_ সমাজের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ দুর্নীতি। ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না। কেউ কেউ বলেন, পরিস্থিতি অনেক স্থানে খুবই খারাপ। এটা ঠিক, ২০০১ সাল থেকে টানা চার-পাঁচবার শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সময় এ ব্যাধি নিরাময়ে ধারাবাহিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হতে থাকে। অ্যান্টি করাপশন ব্যুরোর পরিবর্তে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক গঠন তারই পরিণতি। এ সংস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করবে_ এটা শুরু থেকেই প্রত্যাশিত ছিল। তারা কিছু কিছু পদক্ষেপও নিচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করায় এখনও ঘাটতি প্রবল। দুর্নীতি করলে রেহাই মিলবে না_ এ ধারণা এখনও সৃষ্টি করা যায়নি। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্তরা প্রায়শ অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিছু লোক আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ভূমি, নদী ও জলাশয় দখলের ঘটনায় কমই শাস্তি হয়। বিদেশে অর্থ পাচারও নিয়মিত আলোচনার বিষয়। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশে কিছু লোক প্রচুর অর্থ জমা রাখছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে নিয়মিত। যারা স্বচ্ছতার সঙ্গে উপার্জন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে নিজের আয়ের একটি অংশ তুলে দিচ্ছেন, তারা কিন্তু এ পরিস্থিতিতে উৎসাহ বোধ করেন না।

দুর্নীতি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে_ এটা বিশ্বজনীন সত্য। বেসরকারি খাতকেই আমরা উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি। উদ্যোক্তাদের পদে পদে যেতে হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। আমরা কমান্ড ইকোনমির জোয়াল ছিন্ন করেছি, কিন্তু দুর্নীতির নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বারবার অঙ্গীকার করছেন_ ওয়ান স্টপ সার্ভিস। অর্থাৎ এক অফিসেই মিলবে সবকিছুর ছাড়পত্র। কিন্তু কথা ও কাজের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশের কিংবা আন্তর্জাতিক, যে বাজারের জন্যই পণ্য উৎপাদন হোক না কেন, এখন প্রতিযোগিতা তীব্র। প্রতিযোগিতা নিজের দেশের উৎপাদকের সঙ্গে, অন্য দেশের উৎপাদকের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দাম কমিয়ে রাখা ও সর্বোচ্চ মানের পণ্য ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া। ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি থাকলে এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়া কঠিন। উদ্যোক্তাদের চাই সর্বোত্তম সেবা। বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস_ সেবার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যা। অনুমতি-অনুমোদনেও সমস্যা। শুল্ক-করের ক্ষেত্রে সমস্যা। বন্দরে সহজে পণ্য খালাস করা যায় না। বন্দরে মালপত্র আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা। অনেকেই বলবেন এবং দৃঢ়তার সঙ্গে_ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। যে কোনো সময়ের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরে ভালো সেবা মিলছে। নতুন সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার কাজ চলছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় পুরোটা এখন ডবল লাইনের। সড়কপথ বড় হচ্ছে। গতি বাড়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু যুগের চাহিদা যে আরও বেশি।

আমাদের অবকাঠামো খাতে সরকার প্রতি বছর বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। বেসরকারি খাতও বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নেও সরকারি-বেসরকারি খাত কাজ করছে। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা অবকাঠামোর উন্নয়ন থেকে লাভবান হন। কিন্তু তারা কমবেশি সবাই বলেন, অবকাঠামো খাতে সরকার যত বিনিয়োগ করে, তা থেকে প্রত্যাশিত সুবিধা মেলে না। এর একটি কারণ সরকারি বিনিয়োগের প্রকল্পের কাজ সময়মতো সম্পন্ন হয় না। আরেকটি কারণ বিনিয়োগের অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতার অভাব। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায় এবং তার দায় চাপে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের ওপর। মগবাজার এলাকাকে ঘিরে যে ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, তাকে আমরা এর নজির হিসেবে ধরে নিতে পারি। অনেকেই বলেন, দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টির জন্যই অনেক সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে সময়মতো কাজ শেষ করা হয় না।

বাংলাদেশের বহু বছর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নিরঙ্কুশ নির্ভরতা ছিল উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার ওপর। প্রতি বছর বাজেট প্রণয়নের আগে প্যারিসে বৈঠক বসত দাতাদের। এর সমন্বয়ে থাকত বিশ্বব্যাংক। এখন চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশ নিজেই উন্নয়নের অর্থের সিংহভাগ জোগান দিচ্ছে। নিজস্ব অর্থে আমরা নির্মাণ করছি পদ্মা সেতুর মতো ২৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ের প্রকল্প। এসব প্রকল্পে অর্থ ব্যয় ঠিকভাবে হচ্ছে কি-না তার তদারকি গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো কাজও শেষ করা চাই। অন্যথায়, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দে সমস্যা হবে। দারিদ্র্য দূর ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো অগ্রাধিকার খাতে বরাদ্দ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাখা যাবে না। নিজের অর্থে কাজ করতে পারা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এটা কেবল বাহবা নেওয়ার বিষয় নয়; আমাদের সক্ষমতারও প্রমাণ দিতে পারছি। দাতাদের খবরদারি ও অনাবশ্যক শর্ত থেকেও রেহাই মেলে। কিন্তু কাজ হওয়া চাই মানসম্পন্ন ও যথাসময়ে। আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের সারিতে উঠছি। মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পেতে উদগ্রীব। এ সময়ে ছোট-বড় যে কোনো প্রকল্প সম্পন্ন করা চাই নতুন মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। এখন বিশ্বসমাজ নতুন চোখে দেখছে বাংলাদেশকে। উন্নয়নশীল বিশ্বে এক ধরনের মডেল বলা হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হলে ও দুর্নীতি দমনে সাফল্য দেখাতে পারলে সেটাই হবে নতুন মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ সুশাসন। জাতীয় সংসদ প্রাণবন্ত রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক বিশ্বে সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষ একে অপরের দর্পণ হিসেবে কাজ করে। একের ভুল অন্যরা ধরিয়ে দেয়, একের ভুল বা সঠিক পথে চলা দেখে অন্যরা শিক্ষা নেয়। আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সিঁড়িতে উঠতে পারিনি।

অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি