চামড়া থেকে সর্বোচ্চ মূল্য সংযোজন নিশ্চিত করা চাই – ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in সমকাল on Wednesday, 21 September 2016 

চামড়া থেকে সর্বোচ্চ মূল্য সংযোজন নিশ্চিত করা চাই

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

leather-industryবাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ও জনবহুল। এ বছর কোরবানি হয়েছে আনুমানিক ৮০ লাখ থেকে এক কোটি পশু। কেউ বলেন, কোরবানি হয় আরও বেশি। বহুদিন ধরে গরু ও খাসি কোরবানির চল রয়েছে এ ভূখণ্ডে। হাল আমলে যুক্ত হয়েছে উট। কেন কোরবানি সংখ্যা বাড়ছে? একটি কারণ, টানা কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে থাকা। এর ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের আয় বাড়ছে। আরেকটি বড় কারণ, বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আয়। শহর ও গ্রাম সর্বত্র বিপুলসংখ্যক পরিবারে বিদেশ থেকে অর্থ আসে এবং দুই ঈদের প্রাক্কালে তার পরিমাণ বছরের অন্য সময়ের তুলনায় বেশি থাকে। কোরবানির ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা অবশ্যই রয়েছে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামাজিক কারণ। সাধারণ নির্বাচনের আগের ঈদে কোরবানি বেড়ে যায়, এমন খবর গণমাধ্যমে আসে। আগামীতে দেশে কোরবানি আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়।

কোরবানির সময় দেশের চামড়া শিল্পের কাঁচামালের প্রধান অংশ সংগ্রহ করা হয়। এ শিল্পের প্রধান বাজার দেশের বাইরে। ফলে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অনেক দেশের ক্রেতাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। বিশ্ববাজারের ওঠানামার প্রভাবও তাদের ওপর পড়ছে। রফতানি বাজার মন্দা হলে দেশে কাঁচা চামড়ার দাম পড়ে যায়। এ বছর বাজারে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা ভালো দাম না পাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ বলা হয়েছে বিশ্ববাজারে কম চাহিদা। তবে বাংলাদেশেও চামড়ার বড় বাজার রয়েছে। এর পূর্ণ ব্যবহার এখনও হচ্ছে না।

এবার কোরবানির পশুর বড় অংশের জোগান এসেছে দেশীয় সূত্রে। ব্যক্তিগতভাবে অনেক পরিবার কোরবানির বড় বাজারকে সামনে রেখে পশু পালন করেছে। আবার কিছু পশু এসেছে ‘আমদানি-সূত্রে’। দেশের সর্বত্র বসে কোরবানির বাজার। অনলাইনেও এখন পশু কেনাবেচা হচ্ছে।

আমাদের চামড়া শিল্পের প্রধান কেন্দ্র ঢাকার হাজারীবাগে। এক সময় সেখানে ওয়েট ব্লু উৎপাদন হতো এবং সেটাই রফতানি বাজারে চামড়া খাতের প্রধান পণ্য ছিল। এক পর্যায়ে সরকার ওয়েট ব্লু রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। মালিকদের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করায় এ সময়ে নানা সহায়তাও দেওয়া হয়। একই সঙ্গে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন বাড়াতে এগিয়ে আসেন একদল উদ্যোক্তা। তবে দেশে যে পরিমাণ পাকা চামড়া মেলে তার বড় অংশ রফতানি হয়ে যায়। চীনের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশের পাকা চামড়া কাজে লাগিয়ে পণ্য উৎপাদন করে প্রচুর মুনাফা করছে।

বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের কেনাবেচা এখন বছরে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলারের। এর মাত্র ০.৪ শতাংশের হিস্যা আমাদের। বছরে এ খাত থেকে আমরা ১১০-১২০ কোটি ডলারের মতো আয় করে থাকি। অথচ স্বাধীনতার পর আমাদের পোশাক শিল্প ছিল না। সে সময়ে রফতানি পণ্য বলতে বোঝাত পাট, চামড়া ও চা। দুর্ভাগ্য, এখনও চামড়া প্রায় সেই চার দশকের মাত্রায় রয়ে গেছে। এ খাত থেকে মূল্য সংযোগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ধারেকাছেও নেই। শিল্পে পরিবেশগত নিয়ম-কানুন মেনে চলার বাধ্যবাধকতাও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়েও তেমন ভাবা হয় না।

কোরবানির সময় কাঁচা চামড়ায় গ্গ্নাভস ছাড়া লবণ লাগাচ্ছে শ্রমিক, এমন দৃশ্য টিভি পর্দায় দেখানো হয়। কাঁধে-পিঠে চামড়া বহনের দৃশ্যও বিরল নয়।

কোরবানির চামড়ার ব্যবসার জন্য ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়। এ ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে শহর ও গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ী, পাইকার, আড়তদার ও শিল্পপতি। অনেক স্থানে ছাত্র-যুবকরাও কয়েক দিনের জন্য চামড়ার ব্যবসায়ে যুক্ত হয়ে পড়ে। মাস্তান-সন্ত্রাসীরাও বাজার থেকে ফায়দা লুটতে সক্রিয় হয় বলে অভিযোগ ওঠে। হাল আমলে চামড়ার বাজার চলে গেছে বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণে, এমনটিই বলা হচ্ছে। তারাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম ৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা গত বছরের তুলনায় পাঁচ টাকা কম। কেন গতবারের তুলনায় দাম কম, তার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে_ বিশ্ববাজারে চাহিদা কম। অনেক প্রতিষ্ঠানে গত বছরের স্টক রয়ে গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণের অপরিহার্য উপকরণ লবণের দাম বেশি। তবে রফতানি বাজারের তথ্যে দেখা যায়, গত বছর বিশ্ববাজারে মন্দাভাব ছিল। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কেনাবেচা কিছুটা কম হয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে আগের বছরের তুলনায় রফতানি বেড়েছে ৮ শতাংশ।

চামড়া শিল্পের কাঁচামাল যেহেতু দেশের বাজারেই পাওয়া যায়, তাই এ নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন তুলনামূলক সহজ। প্রতি বছর রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়। শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য উপকরণের জোগান কীভাবে আসবে এবং কোনো সমস্যা থাকলে তার সমাধান কীভাবে হবে, সেটা আগেভাগেই নির্ধারিত হওয়া সম্ভব। লবণের ঘাটতি হওয়ার যুক্তি তাই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে কেন সময়মতো মনোযোগ প্রদান করা হবে না?

দেশেও এ শিল্পের বড় বাজার রয়েছে। আবার বিশ্ববাজারের সুযোগের সামান্যই আমরা কাজে লাগাতে পারছি। যেহেতু আমাদের কাঁচামাল রয়েছে এবং আগামীতে তার সরবরাহ বাড়বে; তাই শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্পোদ্যোক্তা, চামড়ার ব্যবসায়ী-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্যই করণীয় রয়েছে।

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে একটি প্রস্তাব আমরা রাখতে পারি_ যতদিন পাকা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির জন্য দেশে প্রাপ্ত চামড়ার পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না, ততদিন ওয়েট ব্লু রফতানির সুযোগ প্রদান। এটা অবশ্যই সীমিত পরিসরে হতে হবে। এ সময়ে চামড়া শিল্পের বিকাশের প্রয়োজনে ওয়েট ব্লু রফতানি বন্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হযেছিল এবং তার সুফল মিলেছে। এখন পশু কোরবানি বেড়েছে এবং বছরের অন্যান্য সময়েও চামড়ার সরবরাহ সন্তোষজনক। এ কারণে সম্ভবত সংগঠিত শিল্পের চাহিদার বাইরে কিছু সংখ্যক চামড়া থেকে যাচ্ছে। এর প্রভাবে কাঁচা চামড়ার দাম পড়ে যাচ্ছে, যা এ চামড়ার ওপর নির্ভরশীল লোকদের ক্ষতি করছে। এ পদক্ষেপ চোরাপথে চামড়া পাচার বন্ধেরও সহায়ক হবে।

কোরবানি ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য অংশ। একই সঙ্গে পশু কেনাবেচা ও চামড়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুয়ের সমন্বয় সাধনে তাই সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া চাই। সব পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ। কোরবানি কিংবা অন্য সময়ের একটি চামড়াও যেন নষ্ট না হয় এবং প্রতিটি চামড়া থেকে সর্বোচ্চ মূল্য সংযোজন সম্ভব_ এটা নিশ্চিত করায় আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

এ শিল্পের সঙ্গে পরিবেশের বিষয়টিও জড়িত। এর উন্নতি না ঘটলে চামড়া শিল্পে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্ভব নয়। আমাদের হাজারীবাগ কিংবা পোস্তার যে পরিবেশ তাতে উন্নত বিশ্বের কেউ সেখানে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন না। চামড়া শিল্প সাভারে স্থানান্তরের জন্য যেসব বিষয় বিবেচনায় ছিল তার মধ্যে অন্যতম এই বিদেশি বিনিয়োগ। আমাদের এ খাত থেকে অবশ্যই মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে। এ শিল্পের বিশাল বাজার ছড়িয়ে আছে সমগ্র বিশ্বে। অন্যদিকে, আমাদের রয়েছে পর্যাপ্ত কাঁচামাল। শিল্পেও আমাদের দক্ষতা বাড়ছে। তাহলে কেন আমরা বাজারে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে পারব না?

 

অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)