Professor Mustafizur Rahman on regional trade and export

Published in Alokito Bangladesh on Sunday, 9 February 2014.

রফতানি বাণিজ্য
পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ

অবকাঠামো উন্নয়নের সুফল প্রতিবেশীদের ঘরে

জাহিদুল ইসলাম

আঞ্চলিক বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি কমে আসছে। অন্যদিকে এ সব দেশ থেকে বাড়ছে আমদানি। সবকিছুর প্রভাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুব বেশি ভালো না হওয়ায় এসব দেশে বাংলাদেশের রফতানি আয় বাড়ছে না। তাছাড়া কিছু দেশের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক থাকলেও তা একপেশে। সুসম্পর্কের জেরে এসব দেশ বিভিন্ন সুবিধা নিলেও আমরা তা আদায় করতে পারছি না। তবে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে সব দেশের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সার্কের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয় নিজেদের মধ্যে। আমদানি-রফতানি ব্যয় কমাতে হলে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে হবে। এজন্য অবকাঠামো সঙ্কট বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে গুরুত্ব না দেয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্যেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করেন তিনি। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দেশের সমুদ্রসীমা ও নদীপথ প্রতিবেশী দেশগুলোকে ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয়েছে নৌপ্রটোকলের আওতায়। কয়েকটি দেশকে স্থলপথ ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার বিষয়টিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তাছাড়া বেশ কয়েকটি স্থল বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নেও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে এসব কিছুর সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিগত ৫ বছরে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত অনেক কাছাকাছি। স্বাধীনতার পর দুই দেশের মধ্যে এমন অনুকূল পরিবেশ আগে হয়নি। পণ্য চলাচল ও বিনিয়োগ বেড়েছে, চালু হয়েছে সীমান্ত হাট। উভয় দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পথে রয়েছে। এরপরও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে ভারত থেকে ৪৭৪ কোটি ৭ লাখ ডলার মূল্যমানের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর আগের বছর ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল ৩৭৬ কোটি ৪২ লাখ ডলার মূল্যমানের পণ্য। তবে ভারত সরকারের হিসাবে ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫১৩ কোটি ৩ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করে দেশটি। একই সময়ে দেশটি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ৬৩ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪৪৯ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এর মূলে রয়েছে বাংলাদেশের রফতানি কমে আসা। সরকারি প্রতিষ্ঠান রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে।

এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ভারত থেকে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে পণ্য রফতানি হয়েছে ১৮ কোটি ২৫ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে দেশটিতে রফতানি হয়েছিল ২৬ কোটি ৭২ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসাবে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। ভারত ছাড়া বাংলাদেশের স্থলসীমা রয়েছে শুধু মিয়ানমারের সঙ্গে। এ গন্তব্যেও অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানি কমেছে ৬ শতাংশ। একই সময়ে অপর প্রতিবেশী দেশ নেপালে বাংলাদেশের রফতানি আয় কমেছে ৫২ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১ কোটি ১৭ লাখ ডলারের রফতানি আয় এলেও চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে এসেছে মাত্র ৫৬ লাখ ডলার। পাকিস্তানে রফতানি আয়ও কমেছে ১৫ শতাংশ। দেশটিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানি হয়েছে ২ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের পণ্য। গত বছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৩ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য। একইভাবে সার্কভুক্ত দেশ ভুটানের সঙ্গে রফতানি আয় কমেছে সাড়ে ২৫ শতাংশ। সার্কের সাতটি দেশের মধ্যে শুধু শ্রীলঙ্কায় পণ্য রফতানি বেড়েছে ১২ শতাংশ। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে নতুন ফোরাম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থার (আসিয়ান) রিজিওনাল ফোরাম সদস্য বাংলাদেশ। মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল গঠন করায় এসব দেশের আঞ্চলিক বাণিজ্য অনেক বেড়েছে। তবে এখানেও সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ। এ ফোরামের সদস্য সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের রফতানি কমেছে ২৪ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে ৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে তা ৬ কোটি ৪৯ লাখে নেমে এসেছে। একইভাবে আঞ্চলিক বাণিজ্যে অপর বড় বাজার থাইল্যান্ডে রফতানি কমেছে সাড়ে ৪৬ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি আয় হয়েছিল ৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার। ছয় মাসে রফতানি আয় কমেছে আসিয়ানভুক্ত দেশ ফিলিপাইনেও।

ইপিবি সূত্র জানায়, রফতানি আয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না বিদেশে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক মিশনগুলো। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানি আয়ের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে ২৫ বাণিজ্যিক মিশন। এর মধ্যে ভারত, বেইজিং, কুয়ালালামপুর, হংকং, দুবাই, মস্কো, রিয়াদ, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, তেহরান, ইসলামাবাদ, জাকার্তা, ম্যানিলা, কাঠমান্ডু ও রাবাতের নাম রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট সবুর খান বলেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন না হওয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে না। ভারত-নেপালের বাইরে কোনো দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। ভারতের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক থাকলেও তার সুফল এ দেশের উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন না। বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশ কয়েকটি স্থলবন্দরের উন্নয়ন করলেও এক্ষেত্রে ভারতের গরজ কম। রফতানি আয় বাড়াতে আন্তর্র্জাতিক বাণিজ্যে দুই পক্ষের স্বার্থ দেখা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ভুক্ত দেশগুলো মোট বহিঃবাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ করে নিজেদের মধ্যে। নাফটা, আসিয়ানসহ কোনো শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক এলাকায় তা ৩০ শতাংশের নিচে নয়। তবে সার্ক অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য মাত্র ৫ শতাংশ। আঞ্চলিক উন্নয়নে তা অবশ্যই বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রফতানি মূলত পোশাক শিল্পনির্ভর। সঙ্গত কারণে দেশটির গুরুত্ব ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে। তবে অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন হলে অঞ্চলিক বাণিজ্যও বাড়বে। এক্ষেত্রে সব দেশের আন্তরিকতা থাকতে হবে।