Proper tendering process was necessary for Meghna-Gumti bridge toll collection: Dr Moazzem

Published in প্রথম আলো on Friday, 1 July 2016

বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়

দরপত্রহীন ঠিকাদারে বাড়তি যাবে ২৪ কোটি টাকা

আনোয়ার হোসেন

সেবা একই। কিন্তু সেই সেবা নিতে খরচ হবে ১৮ গুণ বেশি অর্থ। বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায় ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সেতু কর্তৃপক্ষকে এই বাড়তি ব্যয় করতে হবে। প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে টোল আদায়ের কাজ দিতে যাচ্ছে সেতু বিভাগ। তাতে আগামী ছয় মাসে ২৪ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হবে সরকারকে। কিনতে হবে ১২৫ কোটি টাকার বাড়তি যন্ত্রপাতি।

দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতুর টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদারের পেছনে খরচ হচ্ছে মাসে ২৩ লাখ টাকা। আর সিএনএস চেয়েছে আদায় করা টোলের সাড়ে ১২ শতাংশ। সেতু থেকে বর্তমানে প্রতি মাসে টোল আদায় হচ্ছে গড়ে ৩৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে সিএনএস পাবে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসেই প্রতিষ্ঠানটি বাড়তি চার কোটি টাকা নেবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেতু বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে এখনো আলোচনা চলছে। কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। এভাবে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া ক্রয় আইনের পরিপন্থী কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক মাস ধরে কোনো টোল আদায়কারী নেই। সেতু বিভাগ নিজেই আদায় করছে। নতুন ঠিকাদার নিয়োগের আগে ছয় মাসের জন্য সিএনএসকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা এসেছে। এ জন্য ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে বিশেষ অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।

কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) প্রতিষ্ঠানটি মূলত সফটওয়্যার উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। টোল আদায়ে তাদের আগের অভিজ্ঞতা বলতে গত মার্চ থেকে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়ের কাজ। সেই কাজটিও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া পাওয়া। আদায় করা টোলের ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানটি পাবে—এই শর্তে চুক্তি করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।

সওজ সূত্র জানায়, মেঘনা-গোমতী সেতু দুটি থেকে বর্তমানে মাসে গড়ে টোল আদায় হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে সিএনএস মাসে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। এর আগে টোল আদায়ে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমেই ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। সর্বশেষ ঠিকাদারের পেছনে যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ মাসে গড়ে ২৬ লাখ টাকারও কম খরচ হচ্ছিল।

জানতে চাইলে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সব সময় প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়াই অগ্রাধিকার। তবে প্রতিযোগিতা একেবারেই অসম্ভব বা অবাস্তব হলে এককভাবে করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই নির্বাচিত ঠিকাদারের কারিগরি যোগ্যতা বিবেচনায় নিতে হবে। আর্থিকভাবেও লাভজনক হতে

হবে। আর এ ধরনের নিয়োগ স্বল্প সময়ের জন্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, আয়ের একটা অংশ ঠিকাদারকে দিয়ে দেওয়া হলে অনেক সময় মোট আয় বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে মেঘনা-গোমতী সেতুতে আয় কত বেড়েছে, সেটা দেখার বিষয়। আর আয় বাড়ার অর্থ হচ্ছে, আগে সরকারের তরফ থেকে নজরদারিও কম থাকতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে প্রতিযোগিতা ছাড়াই একজনকে কাজ দিতে হবে। একাধিক ঠিকাদারের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে আরও কমে একই সেবা পাওয়া যেতে পারত।

তবে এ প্রসঙ্গে সিএনএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনীর উজ জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি উন্নত ও প্রকৌশলীরা ভালো মানের। এ জন্য ব্যয় বেশি। মেঘনা-গোমতীতে টোল আদায় তাঁরা দ্বিগুণ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধু সেতুতেও টোল প্রায় ৩৮ শতাংশ বাড়বে বলে তিনি দাবি করেন।মুনীর উজ জামান বলেন, ‘ভালো সেবা পেতে হলে তো টাকা বেশি দিতেই হবে।’

ছয় মাস দিয়ে শুরু: দরপত্র আহ্বান না করে প্রাথমিকভাবে ছয় মাসের জন্য সিএনএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এভাবে একক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া সরকারের ক্রয় আইনের পরিপন্থী। তবে আইনে এ-ও বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো বিকল্প না থাকলে দরপত্র ছাড়া কাজ দেওয়া যায়। সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে গত এপ্রিলে অন্তর্বর্তীকালের ঠিকাদার নিয়োগ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে সেতু বিভাগ।

১৯৯৮ সালে চালুর পর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়, সেতুর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নিয়োগ করে আসছে সেতু বিভাগ। এর মধ্যে টোল আদায়ের যাবতীয় যন্ত্রপাতিও বসিয়েছে সরকার। এখন সাধারণ যন্ত্রপাতি ছাড়া টোল আদায়ে বড় বিনিয়োগ করতে হয় না।

সর্বশেষ পাঁচ বছর টোল আদায় করেছে জিএসআইসি-সেল-ইউডিসি। এর জন্য তারা পেয়েছে মোট ১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে টোল আদায় বাবদ প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ২৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। গত ৩০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির চুক্তি শেষ হয়েছে।

এর মধ্যে নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দুবার দরপত্র আহ্বান করে সেতু বিভাগ। কিন্তু দুবারই অন্য অংশগ্রহণকারীরা অভিযোগ করে যে দরপত্র দলিলে যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে সিএনএস বাদে আর কারও এই কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) এই অভিযোগ গেলে দরপত্র বাতিল করা হয়। পুনরায় দরপত্র আহ্বানের কাজ চলছে। তবে স্থায়ীভাবে সিএনএসকেই কাজ দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগেরই একাধিক কর্মকর্তা।

মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়েও দরপত্র আহ্বান করেছিল সওজ। কিন্তু পরে তা বাতিল করে ছয় মাসের জন্য সিএনএসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিয়ে দরপত্র ছাড়াই সিএনএসকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ করা হয়।

সিএনএস দায়িত্ব পেলে নতুন যন্ত্র বসাতে হবে: গত মে মাসে সিএনএস সেতু বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তারা টোল আদায়ের জন্য নতুন যন্ত্র বসাবে। ছয় মাস পর যদি তারা স্থায়ীভাবে কাজ না পায়, তাহলে এই যন্ত্র সেতু বিভাগকে ১২৫ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নিতে হবে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ইন্টারন্যাশনাল রোড ডায়নামিকের (আইআরডি) কানাডা স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থার মাধ্যমে টোল আদায় হচ্ছে। ২০১১ সালে এই ব্যবস্থার জন্য সাত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বসায় সেতু বিভাগ। ১৯৯৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময় যন্ত্রপাতি কিনেছে সেতু বিভাগ। এখন সিএনএসের চুক্তির শর্ত ২০১১ বা এর আগে কেনা সব যন্ত্রপাতি বাতিল করতে হবে।

এর বাইরে সিএনএস বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকিট বিক্রি কার্যক্রম চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই কাজে আর কেউ আসতে পারছে না। রেলের অনেক কর্মকর্তা চাকরি শেষ হওয়ার পরই সিএনএসে যোগ দিয়েছেন।

এর বাইরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর ও ফি সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছে সিএনএস। প্রায় প্রতিদিনই কারিগরি ত্রুটির কারণে বিআরটিএর অনেক কার্যালয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের। গত সপ্তাহে সার্ভার সমস্যার কারণে সারা দিন কোনো টাকা জমা দিতে পারেননি গ্রাহকেরা। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহে দীর্ঘদিন ধরেই টাকা নেওয়া বন্ধ বলে বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে।