খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে – রেহমান সোবহান

Published in Prothom Alo on Friday, 20 March 2015.

স্বাধীনতার মাস
খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে

রেহমান সোবহান

গেল শতকের ষাটের দশকে ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’র প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূচনাপর্বের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে বহির্বিশ্বে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন রেহমান সোবহান। ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলি তাঁর পর্যবেক্ষেণ উঠে এসেছে, যা প্রথম ছাপা হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত ফোরাম–এ। তিন কিস্তিতে তাঁর এই ধারাবাহিক রচনাটি প্রকাশিত হচ্ছে

জুলফিকার আলী ভুট্টো সংসদ বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই বাতাসে যুদ্ধের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এক সপ্তাহ আগে বিমানবন্দরের বাইরে গুরুত্বপর্ণ স্থানে বিমানবিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র বসানোর কারণে জনগণের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয় যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। বাতাসে একটি খবর ছিল যে সাবেক গভর্নর এস এম আহসান শেষ মুহূর্তে তাঁর পিন্ডি সফর বাতিল করেছেন। কিন্তু পরবর্তী দিন পিন্ডিতে অনুষ্ঠেয় গভর্নর-সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি রওনা হলে সব বিভ্রান্তির অবসান ঘটে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। আর সবকিছুর শিরোমণি হয়ে আসে মন্ত্রিসভা বরখাস্তের খবর।

সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নরদের বৈঠকের পর লে. জেনারেল ইয়াকুব, গভর্নর আহসান ও লে. জেনারেল পীরজাদা করাচিতে যান। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমত ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করা, তারপর শেখ মুজিবের সঙ্গে। তাঁরা যখন করাচিতে, তখন শেখ মুজিব ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টোর রাজনৈতিক অবস্থানের বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন মুলতবির যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সেটা আরও দীর্ঘায়িত করা হলে তার ফল বিপজ্জনক হবে। এর মধ্য দিয়ে ভুট্টোর কুশলী নাটকীয় আচরণ সম্বন্ধে শেখ মুজিব তাঁর দীর্ঘ নীরবতা ভাঙলেন। তাঁর ধারণা ছিল, ভুট্টোর অনমনীয় আচরণে প্রেসিডেন্ট এই মুলতবি আরও দীর্ঘায়িত করতে বাধ্য হতে পারেন।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, ঢাকায় গভর্নর আহসান শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর শেষ ও ভাগ্যনির্ধারণী বৈঠকে তাঁকে সম্ভাব্য মুলতবির বিষয়ে জানিয়েছেন। এর পরিণতি যে কতটা বিপজ্জনক হবে, মুজিব সেটা পরিষ্কারভাবেই বলেন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের এমএনএরা ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে আসছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এমএনএরাও ৩ মার্চের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকার পথে রওনা দিয়েছিলেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট হাউসের সামনে জরুরি ইলেকট্রিক্যাল জেনারেটর আনা হয়, এটা ছিল প্রেসিডেন্টের আগমনের ইঙ্গিত।

১ মার্চ বেলা ১টা ৫ মিনিটে পাকিস্তান রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি প্রচারিত হয়। সব প্রথা ভেঙে একজন ঘোষক তা পাঠ করেন। বিবৃতিতে অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল স্থগিতের ঘোষণা শোনার আধা ঘণ্টা পর ঢাকার মানুষ খেপে যায়। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারা পূর্বাণী হোটেলের দিকে আসা শুরু করে। সেখানে আওয়ামী লীগের এমএনএরা বৈঠক করছিলেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে তখন এক ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল, মুলতবির ঘোষণার পর সেই খেলাও বন্ধ হয়ে যায়।

সেদিন বেলা আড়াইটায় মুজিব দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে তড়িঘড়ি করে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন। তিনি বলেন, এই মুলতবির ঘোষণা বিনা বাক্যে মেনে নেওয়া হবে না। তিনি দুই দিনের হরতাল ডাকেন, ২ মার্চ ঢাকায় আর ৩ মার্চ সারা দেশে।

ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে গর্জে উঠল বাঙালি২ মার্চ ঢাকায় অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়। সেদিন রাস্তায় বাইসাইকেলও চলেনি। তেজগাঁও ক্যান্টনমেন্টের সামনে জনতা সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবন্ধক স্থাপন করে। সেখানে জনতা খুবই মারদাঙ্গা অবস্থানে ছিল। তেজগাঁও থানার পুলিশকে সেই প্রতিবন্ধক সরানোর কথা বলা হলে তারা জনতার রুদ্রমূর্তি দেখে তা সরানোর সাহস পায়নি।

কিছুক্ষণ পর বিমানবন্দরের দিক থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হয়। তারা প্রতিবন্ধকতা সরানোর চেষ্টা করলে জনতার সঙ্গে মারামারি লাগার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় তারা হঠাৎ করে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। ধারণা করা হয়, সেখানে দুজন মারা যায়, আর আহত হয় পাঁচজন। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। সেদিন রাতেও এখানে গুলিবর্ষণ হলে রাত আটটার দিকে কারফিউ জারি করা হয়।

শহরের বিভিন্ন স্থানেও এমন সংঘাত হয়েছে। জিন্নাহ অ্যাভিনিউয়ে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) কিছু গুন্ডা অবাঙালিদের দোকান লুট করার চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের নগর সভাপতি সেখানে গিয়ে কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরে উত্তম-মধ্যম দেন। সেই দিনজুড়েই শহরময় উত্তেজনা বিরাজ করেছে। প্রতিবন্ধক, স্লোগান ও গুলির শব্দে ঢাকা শহর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাতেও বিভিন্ন স্থানে গুলির শব্দ শোনা যায়।

পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানও একইভাবে স্থবির হয়ে পড়ে। ওদিকে পিআইয়ের কর্মীদের ধর্মঘটের কারণে পূর্ব পাকিস্তান কার্যত সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

পরের দিন মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা যায়, ৩৫ জন মারা গেছে, আহত হয়েছে ১১৩ জন। মিটফোর্ড হাসপাতালেও অনেক আহত ও নিহত ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, অনেককে নেওয়া হয়েছে ইকবাল হলে।

৩ মার্চ ঢাকা শহরে ছিল টান টান উত্তেজনা। মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যারিকেড দিয়েছে। পুরো পূর্ব পাকিস্তানই সেদিন স্থবির হয়ে পড়ে। ঢাকায় খবর ছড়িয়ে পড়ে যে শেখ মুজিব বিকেলে পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সমাবেশে বক্তব্য দেবেন। বেলা তিনটার মধ্যে পল্টন ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। সবাই যেন নরকে যাওয়ার আহ্বান পেলে সেখানেও যেতে প্রস্তুত। তখন যেন এক শ্রেণিসম্মিলন ঘটেছিল। ছাত্র, শ্রমিক, বস্তির সর্বহারা—সবার মনেই তখন একই চেতনা। আবহটা ছিল বিপ্লবের। সমাবেশে মধ্যবিত্তের পুতুপুতু ভাব ছিল না। মানুষ তখন লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।

ছাত্ররা তঁাদের বক্তব্যে ছয় দফাকে প্রতিক্রিয়াশীল স্লোগান বানিয়ে ফেললেন, ইতিবাচকভাবেই। শেখ মুজিব সত্যের মুখোমুখি হলেন। জনতাকে বাগে আনার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। তবে সেটা করতে গিয়ে তাঁর নিজের কারিশমারও চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে যায়। ব্যারোমিটারের পারদ তিনি নামিয়ে ফেললেন। আগের দাবি থেকে সরে গিয়ে তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহারপূর্বক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। কারফিউ তুলে নিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার নিশ্চয়তা দেন। লুটপাটকারীদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি সবার জানমালের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন।

শেখ মুজিব ৭ মার্চের মধ্যে সমঝোতার ডাক দেন। সে পর্যন্ত তিনি একটানা হরতালের আহ্বান জানান। আর জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ চালানোর আহ্বান জানান, কর না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

মুজিবের এই বক্তব্যের আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। সেদিন সকালেই আওয়ামী লীগের এমএনএ, চিফ হুইপ ও দলের প্রচার সম্পাদক টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নানকে নিরাপত্তা বাহিনী প্রহার করে। তাঁর কাঁধের হাড়ও ভেঙে যায়। তাঁর সঙ্গে থাকা দলের আশরাফউদ্দিন চৌধুরীকে বন্দুকের মুখে আউটার সার্কুলার রোডে ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য করা হয়। এমন আরও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই জনসভার পর পরিস্থিতি কিছুটা থিতিয়ে আসে।

এই পরিস্থিতিতে ১০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। ব্যাপারটা পরাবাস্তব মনে হয়। মুজিব যে এতে সাড়া দেননি, তা নিয়ে এমন একটা আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না। ১০ মার্চের মধ্যে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাদের ক্ষমতা বন্দুকের গুলির লক্ষ্যবস্তুর দূরত্বের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। হরতালে শুধু পূর্ব পাকিস্তান অচলই হয়ে যায়নি, প্রশাসনের লোকেরাও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। সরকারি চাকুরে, বিচারপতি ও নানা স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বেচ্ছায় কাজ বন্ধ করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে।

এর মধ্যে ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চের ভাষণে এই পরিস্থিতির জন্য নেতাদের দোষারোপ করেন। তিনি বিশৃঙ্খলার জন্য কিছু হাতে গোনা খুনি, দুষ্কৃতকারী ও গুন্ডাকে দায়ী করেন। কিন্তু তিনি সেই বক্তব্যে এই সংকটের হোতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে কিছুই বলেননি।

এদিকে মুজিবের ওপর তাঁর দলের কর্মীদের অনেক চাপ থাকলেও তিনি সৌহার্দ৵পূর্ণ পরিবেশে সমস্যা সমাধানের পথ খোলা রাখতে সক্ষম হন। জনগণের দাবি ছিল আলোচনার অধিক কিছু। মুজিবের নেতৃত্ব পরীক্ষার মুখে পড়ে। একদিকে ছিল মধ্যবিত্ত, যাদের জীবনে ইতিমধ্যে হরতালের প্রভাব অনুভূত হচ্ছিল, আরেক দিকে ছিল ছাত্র-শ্রমিকেরা, দেশের সড়কে তাদের দাবিই তখন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

মুজিবের বক্তব্য রণমুখী ছিল না, আবার সেটা কাপুরুষোচিত আত্মসমর্পণও ছিল না। তিনি সফলভাবেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে চ্যালেঞ্জ ফিরিয়ে দিয়েছেন, আবার গণহত্যা ও দেশ ভাঙার দায় ক্ষমতাসীনদের হাতেই অর্পণ করেছেন।

সে সময় বাংলাদেশে ছয় দফাও এক রকম অকেজো হয়ে গিয়েছিল। ভুট্টো নাকি বলেছেন, ছয় দফা ও দেশভাগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাঁকে এবার চাক্ষুষ প্রমাণ দেওয়া হলো, ছয় দফাপন্থীরাই প্রকৃত অর্থে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে। অস্ত্র দিয়ে তা রক্ষা করা যাবে না। মুজিব সেটা বুঝতে পেরে নিজের রাজনৈতিক জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে চূড়ান্ত উত্তরের অপেক্ষায় রইলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি জানান দিলেন, দেশ ভেঙে গেলে তার দায় বন্দুকধারীদের।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
সূত্র: ফোরাম, ৬ মার্চ ১৯৭১
আগামীকাল: অসহযোগ থেকে জনগণের রাজ
রেহমান সোবহান: অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান।