Theft at BB left a big lesson for us: Mustafizur Rahman

Published in যায় যায় দিন on Monday, 14 March 2016

আর্থিক খাতে অশনি সংকেত

আহমেদ তোফায়েল ও আবু সাইম

image_1487_227867উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাম্প্রতিক সময়ে দেশি-বিদেশি জালিয়াত চক্র ব্যাংকের এটিএম বুথ ও যুক্তরাষ্ট্রে সঞ্চিত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় আর্থিক খাতের জন্য একটি অশনি সংকেত বলে মত দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। রিজার্ভের টাকা খোয়া যাওয়ার পর ব্যাংকিং খাতের প্রযুক্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। এসব ঘটনাকে দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাতে বড় ধাক্কা হিসেবে মানছেন তারা।

প্রসঙ্গত, উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশি-বিদেশি জালিয়াত চক্র সম্প্রতি ৫টি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে প্রায় অর্ধ শতাধিক গ্রাহকের টাকা তুলে নেয়। এছাড়া স্কিমিং ডিভাইস ব্যবহার করে আরো প্রায় ৩ হাজার গ্রাহকের তথ্য চুরি করে জালিয়াত চক্র। আর উচ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতারক চক্র ‘হ্যাক’ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের প্রায় ৮শ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ ৫ ফেব্রুয়ারি হ্যাক করে চীনের হ্যাকার গ্রুপ।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ খুব বড় অঙ্কের না হলেও ঘটনাটি অনেক বড়। এতে আর্থিক খাতে এ মুহূর্তে নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। এটাকে সমূলে দূর করতে হবে। কিভাবে এটি ঘটেছে, কারা জড়িত তা খুঁজে বের করে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি নেতিবাচক দিক। এতে দেশের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন করবে। ব্যাংকের সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। তবে এটি বড় না হলেও একটি ধাক্কা বলা চলে। এ টাকা ৮৮০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অর্থ যদি ফেরত না আসে তা দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর ও অশনি সংকেত। কেননা, এটি প্রায় ১ মাসের রেমিট্যান্সের সমান। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

বিশ্ব ব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশ বা দেশের অর্থনীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা এখনো বলা যায় না। কেননা, মাত্র ঘটনা ঘটেছে। তবে, যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক, তাই সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটা কাম্য হতে পারে না। এখন দেখার বিষয় কিভাবে এ থেকে উত্তরণ ঘটে। এ ঘটনায় আরো বড় অঙ্কের জালিয়াতির চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। তার ওপর অন্য বিষয় হচ্ছে, এ ঘটনা হ্যাকিং না জালিয়াতি তাও তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষ। এ কথা ঠিক যে একটি চুরির ঘটনা ঘটেছে।

অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, হ্যাকিংয়ে চুরি হওয়া অর্থ রিজার্ভের তুলনায় বেশি না। এর মধ্যে কিছু টাকা রিকভারিও করা হয়েছে। তাই এতে আর্থিক খাতের ওপর তেমন কোনো প্রভাব নাও ফেলতে পারে। তবে তারা বড় অঙ্কের টাকা সরানোর চেষ্টা করেছিল। এ ঘটনা আমাদের জন্য একটা সতর্ক সংকেত। তবে সারপ্রাইজিং বিষয় হচ্ছে- সেন্ট্রাল ব্যাংকে এটা ঘটেছে। তারা তো পাবলিকের সঙ্গে লেনদেন করে না। বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিল করে। সে দিক দিয়ে এ ঘটনা খুবই ভয়ঙ্কর। এর আগে দু একটি প্রাইভেট ব্যাংকে এটা ঘটেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এটাই প্রথম। তিনি বলেন, আজকাল সাইবার ক্রাইম অনেক ধরনের হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের দিকেই বেশি নজর দিতে হবে। এ থেকে উত্তরণে এখনই সচেতন হতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এক্ষেত্রে দায় আছে বা নাই সেটা চিন্তা না করে কিভাবে এটা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যেন না ঘটে সে বিষয়ে সচেতনতাই বড় বিষয়। কেননা এখন থেকে শিক্ষা না নিয়ে যদি ভবিষ্যতে বড় কোনো ঘটনা ঘটে তখন দায়টা আরো বড় হয়ে দেখা দেবে। সাইবার সিকিউরিটির ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার আছে। এজন্য আলাদা বিশেষায়িত ব্যবস্থাপনার কথা চিন্তা করার দরকার বলে মনে করেন তিনি।

ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, হলমার্কসহ বিভিন্ন ভুঁইফোড় গ্রুপ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়াতে যে ধরনের ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়াতে। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে টাকা চলে যাওয়া। এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ঘটনা। এই ধরনের ঘটনা মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। কারণ, যারা বৈদেশিক মুদ্রা এদেশে পাঠায়, তারা এই ঘটনায় খুশি হবেন না। তবে ম্যাক্রো ইকোনমির জন্য এই ঘটনা খুবই খারাপ নজির স্থাপন করবে। এ জন্য ব্যাংক খাতের নিরাপত্তা বাড়ানো জরুরি। পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত হওয়া দরকার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সামগ্রিক আর্থিক খাতের নিরাপত্তাবিধান করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো সতর্ক হতে হবে। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংকই দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় অভিভাবক।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগে শিক্ষা নিতে হবে। কেননা এর আগে অভ্যন্তরীণ খাতে বিভিন্ন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। মাত্র কয়েক দিন আগে এটিএম বুথ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক জালিয়াতি ঘটেছে। সে ঘটনারও সম্পূর্ণ সুরাহা হয়নি। যদিও কয়েকজন সন্দেহভাজন ধরা পড়েছেন। এরই মধ্যে দেশের বাইরে গচ্ছিত রাখা রিজার্ভ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন হ্যাকাররা। এটা অবশ্যই উদ্বেগজনক। এ ধরনের ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তিগত সমস্যা থাকলে তার সমাধান করতে হবে।

এ ধরনের ঘটনার ফলে দেশের আর্থিক খাতের অভ্যন্তরে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ খাতে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। বরং এর আগে দেশের এটিএম থেকে টাকা চুরির ঘটনায় সাধারণ গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো সতর্ক হতে হবে। সমগ্র আর্থিক খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে বলে মনে করেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনা একটা বড় সমস্যা, তবে সংকট নয়। জাতীয় বিপর্যয়ও নয়। রিজার্ভ জনসাধারণের সম্পদ। এর মালিক জনগণের পক্ষে সরকার। তিনি বলেন, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১ সালে খুব দাবি উঠেছিল ই-কমার্স শুরু করতে। আমি খুব শক্ত ভাষায় এর বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ এখানে এ নিয়ে কোনো আইন নেই।

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে এটিএম কার্ড জালিয়াতি হলো। সারা পৃথিবী যখন ম্যাগনেটিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে চিপস ব্যবস্থায় গেল, তখন আমরা গেলাম না। গেলাম না যখন, তখন কেন এতগুলো বুথ চালুর অনুমোদন দেয়া হলো? কেন ম্যাগনেটিক ব্যবস্থা চালু রাখলাম? এটা তো গাফিলতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এখানে আরো বেশি যত্ন নেয়া উচিত ছিল। যেহেতু ঘটনা ঘটেছে, সে কারণে এখনো ম্যাগনেটিক কার্ড ব্যবহার করার যে এটিএম বুথ আছে, সেগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেয়া উচিত। বন্ধ না করলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হবে না ব্যবস্থা নিতে।

এদিকে রিজার্ভের টাকা খোয়া যাওয়ার পর ব্যাংকিং খাতের প্রযুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি নিরাপত্তা পণ্য নির্মাতা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইচপি (হিউলেট প্যাকার্ড এন্টারপ্রাইজ) সাইবার রিস্ক রিপোর্ট-২০১৬ এ উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি বছর সাইবার নিরাপত্তায় উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় সবচেয়ে বড় ঝুঁকি থাকবে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে। রিপোর্টে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এটিএম বুথগুলোতে পুরনো সংস্করণের উইন্ডোজ এক্সপি ব্যবহার করায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া রাশিয়ার প্রযুক্তি নিরাপত্তা পণ্য উৎপাদন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কির এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কম্পিউটার ভাইরাস আক্রান্ত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যবহৃত কম্পিউটারের মধ্যে ৬০ দশমিক ৫৩ শতাংশ ২০ ধরনের বিপজ্জনক ভাইরাস আক্রান্ত।

এদিকে শুধু বাংলাদেশ নয়, হ্যাকিং এখন বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে বড় উদ্বেগের নাম। প্রায়ই বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ও অন্যান্য অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক হ্যাক করে অর্থ চুরির সংবাদ মিলছে। গত দুই বছরে শুধু একটি সাইবার অপরাধী চক্র ৩০ দেশের ১০০ ব্যাংকের অন্তত ১০০ কোটি ডলার চুরি করেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। রাশিয়া, চীন ও ইউক্রেনের হ্যাকারদের একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ অত্যন্ত সুকৌশলে উন্নত প্রযুক্তির অপব্যবহার করে এ অপরাধ করেছে। তারা বিশ্বব্যাপী আন্তঃব্যাংক পরিশোধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ‘সুইফট’ নেটওয়ার্কে ঢুকেও অর্থ চুরি করছে।