মোজাফ্ফর আহমদ – ফাহমিদা খাতুন

Published in বণিক বার্তা on Sunday, 4 September 2016 

muzaffar-ahmedঅধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদদের একজন। তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৭ মার্চ এবং মৃত্যু ২২ মে ২০১২। সরকারি কর্মকর্তা বাবা নাজির আহমদ ও গৃহিণী মা জাহানারা বেগমের সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতায় জন্ম হলেও তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে পূর্ব বাংলায়। ঘুরে বেড়ান মাগুরা, গোপালগঞ্জ, মঠবাড়িয়া, ফরিদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল ইত্যাদি জায়গায়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হয় বরিশাল জিলা স্কুলে। তার পর মঠবাড়িয়া কেএম লতিফুল ইনস্টিটিউশন, ফরিদপুর জিলা স্কুল ও নোয়াখালী জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। বরিশাল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে পড়তে যান ফ্রান্স ও আমেরিকায়।

শিক্ষকতাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে। ছয় মাস সেখানে শিক্ষকতা করেন। তার পর প্রভাষক হিসেবে ১৯৫৭ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালের একই দিনে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান

সোবহান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক শেখ মাকসুদ আলী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সতীর্থদের মধ্যে আরো রয়েছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ১৯৫৯ সালে ফ্রান্স সরকারের বৃত্তি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে যান এমফিল করার জন্য। সেখানে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন মরেশাল, মরিন বিয়ে, ফ্রাঁসোয়া পেরু প্রমুখ। অর্থনীতির প্রায়োগিক গবেষণা করার সময় আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফ্রান্সে এক বছর থাকার পর সেখান থেকে রকেফেলার ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পিএইচডি করতে যান। তখন মিল্টন ফ্রিডম্যান ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান। অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন হ্যারি জনসন, আরনল্ড হারবার্গার ও থিয়োডোর সুলজ। এদের প্রত্যেকেরই প্রভাব রয়েছে তাঁর জীবনে। মিল্টন ফ্রিডম্যানের কল্যাণে তখন তাঁর মধ্যে তাত্ত্বিক ও গাণিতিক ভিত্তি তৈরি হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে আটজন নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে রবার্ট লুকাস যাকে বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ বলা হয়, তিনি ১৯৯৫ সালে নোবেল প্রাইজ পান। তাঁর পিএইচডি সুপারভাইজার মার্টন মিলার ও নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯০ সালে। মোজাফ্ফর আহমদের পিএইচডি থিসিস ছিল ‘Demand for Life Insureance’, যা permanent income hypothesis-কে উপজীব্য করে লেখা হয়েছিল। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকদের পরিদর্শক হিসেবে এবং সাউথ আশিয়ান বিভাগে বাংলার শিক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করেন। ১৯৬০-এর দশকে জন এফ কেনেডি প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকা থেকে ১৫ জন শ্রেষ্ঠ বিদেশী ছাত্রছাত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। এর মধ্যে মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন একজন। শিকাগোয় শিক্ষাকালীন ৫০টি দেশের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তিনি থাকতেন ইন্টারন্যাশনাল হাউজে। সেখানে রওশন জাহানের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি তখন ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে রওশন জাহান তাঁর জীবনসঙ্গী হয়েছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মোজাফ্ফর আহমদের উদ্যোগে পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার গড়ে ওঠে। তিনি পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন অব শিকাগোর সভাপতিও ছিলেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি শেষে অনেক আকর্ষণীয় চাকরির প্রস্তাব পেলেও পরিবারের কথা বিবেচনা করে দেশে চলে আসেন ১৯৬৫ সালে। যোগ দেন পুরনো কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন স্পষ্টভাষী ও প্রতিবাদী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি নিজের স্বার্থও জলাঞ্জলি দিয়েছেন অনেক সময়। ষাটের দশকের শেষ দিকে দেশ উত্তাল, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা, এনএসএফের দোর্দণ্ড প্রতাপ। সে সময় অধ্যাপক আবু মাহমুদের গায়ে হাত তোলে এনএসএফ সমর্থক ছাত্ররা। তিনি মোজাফ্ফর আহমদেরও শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক লাঞ্ছনার এমন ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয় শিক্ষক সমাজ। ক্ষুব্ধ শিক্ষকদের মধ্যে মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন অন্যতম, যিনি সুবিচার চান তত্ক্ষণাত্। বিচার মনঃপূত না হওয়ায় প্রতিবাদী অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে মোজাফ্ফর আহমদও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। কিন্তু তাঁর প্রত্যয় ছিল তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসবেন। সে সময় তিনি করাচিতে তাঁর শিক্ষক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমানের প্রস্তাবে যোগ দেন ইউনাইটেড ব্যাংকে। করাচিতে অবস্থানকালে তিনি বুঝতে পারেন পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের মানুষকে কোন দৃষ্টিতে দেখে, কতটা বৈষম্য বিরাজ করছে দুই দেশের মধ্যে। তিনি সবসময়ই দেশপ্রেমিক ছিলেন। কিন্তু করাচি বসবাসের অভিজ্ঞতার পর তাঁর পক্ষে আর দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি থাকা সম্ভব ছিল না। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যোগ দেন East Pakistan Industrial Corporation (EPIDC)-এর প্ল্যানিং বিভাগে, যা পরে Bangladesh Industrial Development Corporation নাম ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়জুড়ে ছিলেন তিনি সাতমসজিদ রোডের পৈতৃক বাড়িতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যায়, তখন ধানমন্ডির বাড়ির ছাদে বসে উনি এবং উনার স্ত্রী বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানের অবসান ঘনিয়ে আসছে। স্ত্রীর সহযোগিতায় ও অনুপ্রেরণায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ান; সরাসরি না হলেও মনেপ্রাণে, অর্থ দিয়ে ও তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি EPIDC কাজ করতেন। ফলে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করাটা সহজ ছিল। স্বাধীনতার পর যোগ দেন পরিকল্পনা কমিশনে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। সেটি ছেড়ে ১৯৭৪ সালে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট আইবিএতে। ব্যাংক, EPIDC, পরিকল্পনা কমিশন ইত্যাদি শেষ করে তাঁর সংকল্পমতো তিনি ফিরে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কৈশোর থেকেই তিনি রাজনীতি-সচেতন ছিলেন। এর পরিমণ্ডল দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে রাজনৈতিক কোনো দলের সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলেন না, এমনকি ছাত্রজীবনেও রাজনৈতিক কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না তাঁর। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ তাঁঁর যা ছিল, তা বুদ্ধিবৃত্তিক। হয়তোবা তাঁর বাবার সরকারি চাকরি এবং নিজের ভেতরে শিক্ষকতা ও গবেষণার তাগিদ বেশি থাকার কারণে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। তাঁর নির্মোহ ও বাস্তবমুখী সমালোচনা করার অভ্যাসের কারণেও তিনি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের দর্শন গ্রহণ করতে পারেননি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তাঁকে তত্ত্বগতভাবে শানিত করেছিল। তবে প্রথম জীবনে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজের আন্তঃসম্পর্কের ব্যাপারে তিনি তেমন গভীরভাবে চিন্তা করেননি। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট হয় ধীরে ধীরে। তাই ছাত্রজীবনে যেসব অর্থনীতিবিদের পছন্দ করতেন, পরবর্তী জীবনে সেই পছন্দ বদলে গিয়েছিল। অর্থনীতির প্রথম জীবনে তাত্ত্বিক ও গাণিতিক দিকে বেশি মনোযোগী হলেও সময়ের সঙ্গে প্রায়োগিক দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে এবং সরাসরি জড়িত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার

জন্য মাঠে নেমে যান। শিক্ষকতা জীবন শেষে সক্রিয় হয়ে ওঠেন দুর্নীতিবিরোধী, সুশাসন ও পরিবেশ-সম্পর্কিত নানা সংগঠনের সঙ্গে। আশির দশকেও যিনি পরিবেশ নিয়ে তেমন ভাবতেন না, একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হয় না। তাই বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেন। বস্তুত যেকোনো র্স্পশকাতর, কিন্তু দেশের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন নির্ভীকভাবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনেরও সভাপতি ছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। তাঁর মতে, দুর্নীতির মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি সবচেয়ে খারাপ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন। নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার ছিলেন।

প্রায় দুই দশক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) গভর্নিং বোর্ডে দায়িত্ব পালন করেন। স্বল্পভাষী কিন্তু স্পষ্টভাষী মোজাফ্ফর আহমদ বিভিন্ন সময় তাঁর স্পষ্টভাষিতার কারণে অযৌক্তিক সমালোচনার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েও গিয়েছেন। বিভিন্ন সরকারের সময়ে তাঁকে নানাভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার বরাবরই বিরোধিতার নিদর্শন হিসেবে দেখেছে তাঁকে। নেতৃত্ব গুণাবলিসম্পন্ন স্বাধীনচেতা এ শিক্ষাবিদ এসবের তোয়াক্কা না করে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। যেসব সংগঠনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে সেই সংগঠনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির জন্য। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা তখন এক আলোচনাচক্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেন। ফলে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের যে কক্ষে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের দপ্তর ছিল, তাতে তালা লাগানো হয়। নারী ও শিশু অধিকারের বিষয়েও তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনায় তিনি একাই ফেস্টুন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অবস্থান করেছিলেন। কে তাতে কী মনে করল তাতে তাঁর কিছু এসে যায়নি।

মোজাফ্ফর আহমদের গবেষণা ক্ষেত্র ছিল শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পাবলিক এন্টারপ্রাইজ, শ্রমিক সম্পর্ক ইত্যাদি। তবে অর্থনীতি-সম্পর্কিত নানা বিষয়েও তাঁর কাজ রয়েছে। ১৯৮০ সালে অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও মোজাফ্ফর আহমদ মিলে লেখেন ‘Public enterprise in an intermediate regime: a study in the political economy of Bangladesh’ বই। ৬২১ পৃষ্ঠার সুবিশাল এ বইতে public enterprise গঠনের লক্ষ্য ও তার সঙ্গে কর্মদক্ষতার সামঞ্জস্যতা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। বাংলাদেশে এ বিষয়ে এ ধরনের নিগূঢ় বিশ্লেষণ এই প্রথম। ১৯৮১ সালে তিনি লেখেন ‘Organizational framework, institutional relationships and management of public industrial enterprises’ নামক বইটি। ১৯৮৭ সালে ‘State and Development: Essays on Public Enterprise’ বইয়ে পাবলিক এন্টারপ্রাইজের যৌক্তিকতা ও অর্থনৈতিক পবৃদ্ধিতে অবদান তুলে ধরেন। ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সের ওপর ১৯৯৭ লেখা তাঁর বই The Political Economy of Loan Default: A Quest for a Social-Political Explanation. ২০০২ সালে লেখেন ‘Investing in ourselves: giving and fund raising in Bangladesh’। তাঁর লেখা মোট ১০টি বই ও শতাধিক প্রবন্ধ রয়েছে দেশ ও বিদেশের বিখ্যাত জার্নালে। স্বীকৃতির আশায় কাজ করেননি। তবে নিরলস কাজের পেছনে মাঝে মাঝে স্বীকৃতি এসে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৮ সালে একুশে পদক পান। জাতীয় পরিবেশ পদক পান ২০১০ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৩। এছাড়া অর্থনীতি সম্মাননা ১৯৮৮, অতীশ দীপঙ্কর পদক ১৯৮৯, অর্থনীতি শিক্ষক সমিতি সম্মাননা ১৯৯৩, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন সম্মাননা ২০০২, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সম্মাননা ২০০৩ ও মানিকগঞ্জ সমিতি অমর্ত্য সেন পদক ২০০৭ পেয়েছেন। তাঁর সম্মানে বিআইবিএমে ‘অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ চেয়ার প্রফেসর’ প্রবর্তন করা হয়।

নীতি ও আদর্শে অবিচল স্বনামধন্য এ অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পরিবর্তনের জন্য। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর কাছে যখন যেটি সঠিক মনে হয়েছে তাই করেছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন দেশের জন্য কিছু করার আশায়। কিন্তু সে সময় বস্ত্র খাতে যেসব সংস্কার তিনি আনতে চেয়েছিলেন, তা করতে পারেননি অন্য প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের বাধার মুখে। তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, রাজনৈতিক দল গঠন করলে তিনি তাঁর বাইরে থাকতেই পছন্দ করবেন। ফলে উপদেষ্টার পদ হারান। ১৯৮৭ সালে মার্চ মাসে ৩১ জন নাগরিক তত্কালীন স্বৈরাচারী শাসনের অবসান দাবি করে যে বিবৃতি দেন তাঁর খসড়া তৈরি করেছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সচেতন। তাই প্রথাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি থাকাকালীন তিনি কখনো স্বৈরশাসক এরশাদকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাননি। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মেধা ও মননশীলতার প্রকাশ ঘটেছে শিক্ষকতা, গবেষণা ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। তাঁর আদর্শ আমাদের ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে থাকবে।

(রওশন জাহান ও শাহিদা পারভীনের কাছে লেখক কৃতজ্ঞ)

 

লেখক: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)