তৈরি পোশাক খাত: এগোনোর পথ – ফাহমিদা খাতুন

দৈনিক প্রথম আলো

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্প ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ শিল্পজাত পণ্য আমরা বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আসে এই তৈরি পোশাক খাত থেকে। মোট দেশজ আয়ের ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। সেখানে কারা কাজ করছেন? শ্রমিকশ্রেণী। তাঁদের মধ্যে আবার ৮০ শতাংশ হলেন নারী শ্রমিক। সেখানকার চ্যালেঞ্জগুলো ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের দিকে পোশাক কারখানার জন্য শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টা, কাজের পরিবেশ, কারখানার পরিবেশ, শিশুশ্রম ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা আমাদের ওপর এসেছে পশ্চিমা ক্রেতাদের কাছ থেকে।

আমরা দেখছি, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পক্ষ থেকে ২০০০ সালের পর থেকে কমপ্লায়েন্স মানার দাবি আরও শক্তিশালী হয়েছে। ২০১৩ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে এখনো বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। সে কারণেই রানা প্লাজা ধস, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। দুর্ঘটনাজনিত ভয়াবহতার মাত্রা যেন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এর কারণ হলো, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন বাস্তবায়িত না হওয়া। উপরন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অপরাধ ও দুর্নীতি সংঘটিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ আর রাজনৈতিক স্বার্থ মিলেমিশে সমাজকে কলুষিত করে তুলেছে। ফলে আমরা দেখছি, সমাজের দুর্বল অংশের ওপর শোষণের এবং অত্যাচারের কোনো বিচার হচ্ছে না। অপরাধীরা রয়ে যাচ্ছে আইনের ঊর্ধ্বে।

সরকার যে নীতিমালা তৈরি করে, সেগুলো সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যথাযথভাবে বাস্তবায়নকাজ করছে কি না, তা সঠিকভাবে তদারক করার ক্ষেত্রে গাফিলতি রয়েছে। কারখানার কমপ্লায়েন্সের জন্য যেসব দায়িত্বশীল বিভাগ রয়েছে, যেমন শ্রম অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কারখানা পরিদর্শন কর্তৃপক্ষ, অগ্নিনির্বাপণ কর্তৃপক্ষ, ভবন নির্মাণ কর্তৃপক্ষ—তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা করছে। পোশাকশিল্পের মালিকদের সংস্থা বিজিএমইএ যেভাবে কারখানার কমপ্লায়েন্স তদারক করছে, তাতেও ত্রুটি রয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত পোশাক কারখানাগুলোর বেশির ভাগই বিজিএমইএর সদস্য। কিন্তু প্রায়ই দুর্ঘটনার পর তারা দোষীদের চিহ্নিত করে না, তাদের সদস্যপদ বাতিল করে না। দেখা যাচ্ছে, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের অনেকে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। সুতরাং অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা ঘটার পরও পার পেয়ে যাওয়া তাঁদের জন্য বেশ সহজ।
উন্নত বিশ্বে এখন অনেক ধরনের প্রচারণা বা ক্যাম্পেইন চলছে। যেমন ‘ক্লিন ক্লোথ ক্যাম্পেইন’, ‘এথিকাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ’, ‘লেবার বিহাইন্ড দ্য লেভেল’ ইত্যাদি। অর্থাৎ যে কাপড়টা তাদের দেশের ভোক্তারা পরছে, সেটি কি উপায়ে তৈরি হয়েছে। পোশাক প্রস্তুতকারী কারখানায় শ্রমিক কী পরিবেশে কাজ করেছেন? বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তাঁরা ন্যায্যভাবে পেয়েছেন কি না? যে পরিমাণ শ্রমঘণ্টায় তাঁদের কাজ করার কথা, তা-ই করার সুযোগ পেয়েছেন কি না? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার শ্রম আইনগুলো মেনে পোশাকটি তৈরি করা হয়েছে কি না?

এ ধরনের অনেক প্রচারণা চলার পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি যে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পক্ষ থেকেও একধরনের অবহেলা রয়েছে। তাই আমাদের তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের ভূমিকা নিয়েও কথা রয়েছে। বলা হয় তারা জেনেশুনেই কমপ্লায়েন্ট নয়, এমন কারখানার পোশাকও কেনে শুধু সস্তায় পাওয়ার জন্য। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার পর একদিকে সরকার ও বিজিএমইএ বলে এটি একটি নাশকতামূলক ঘটনা। আর ক্রেতারা বলে, কারখানাটি যে কমপ্লায়েন্ট নয়, সেটি কারখানা পরিদর্শনকারী দল তাঁদের জানায়নি। আসলে আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংস্থাগুলো যেখান থেকে সস্তায় পোশাক পাওয়া যায়, সেখান থেকেই কিনছে। বাংলাদেশ থেকে সস্তায় পোশাক পাওয়া যায়। কারণ, এখানে শ্রমের মজুরি কম।

আর পশ্চিমা ক্রেতা সংস্থাগুলোর পোশাকের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনীহার কারণেও আমাদের দেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি কমপ্লায়েন্ট হয়ে উঠতে পারছে না। বাড়তি খরচের দায়টুকু তারা নিলে তাদের মুনাফা কমে যাবে, এমনকি উৎপাদন খরচও উঠবে না বলে আমরা শুনে থাকি। পশ্চিমা বিশ্বের ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স উন্নত করার আশ্বাস দিলে তারা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হবে। তা ছাড়া কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্ট করার জন্য যে অর্থ প্রয়োজন, তা আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নিজেরাও ভাগাভাগি করে দিতে পারে। তাদের নিজেদের দেশের সচেতন ক্রেতাদের কথা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি মাথায় রেখে এই বাড়তি ব্যয়টুকুর ভার তারা নিতেই পারে, যেটি সম্ভবত তাদের মুনাফার সামান্যই হবে।

আরেকটি বিষয় হলো, দুর্ঘটনার পর মালিকদের পক্ষ থেকে সভা, সংবাদ সম্মেলন করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়া হয়। কিন্তু শ্রমিকেরা অসংগঠিত। তাই আমরা দেখি, একদিকে তাঁরা স্বজন হারানোর বেদনায় বিষণ্ন, অন্যদিকে অসংগঠিতভাবে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেরা কয়েকজন রাস্তায় নেমে গাড়ি, ভবন ইত্যাদি ভাঙচুর করছেন, যা এ শিল্পটির ও প্রকারান্তরে নিজেদেরই ক্ষতি করছেন। তাঁদের এই নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য এখন শিল্প পুলিশ হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের দাবিদাওয়া, অধিকার আদায়ের ব্যাপারটি সংগঠিতভাবে আসছে না। ট্রেড ইউনিয়নের যে প্রভাব বাংলাদেশে ষাট ও সত্তরের দশকে ছিল, নানা কারণে সেই ঐতিহ্যটি আজ হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকনেতাদের রাজনৈতিক বা মালিকপক্ষের লেজুড়বৃত্তি করতে দেখা গেছে। ফলে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে তাঁদের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে।

বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক ইউনিয়ন করার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে চাপ রয়েছে। শ্রম অধিকার সুরক্ষা এবং কারখানার কমপ্লায়েন্স উন্নত করার জন্য শ্রমিক সংগঠনের গুরুত্ব কতখানি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একের পর এক এ ধরনের মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনার হাত থেকে শ্রমিক ও পুরো শিল্প খাতটিকে রক্ষা করতে হলে শ্রমিকদের পক্ষে সুশৃঙ্খল ও কার্যকরী ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা কোনো অংশেই কম প্রয়োজনীয় নয়।

আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আমরা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। শ্রম অধিকার-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়সহ অন্যান্য কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তারা বাংলাদেশের কাছে সঠিক জবাব চেয়েছে। তাদের প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক উত্তর না দিতে পারলে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য প্রবেশের সুযোগ হারাব।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজার যদি আমরা হারাই, তবে আমাদের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হবে, তা হলো, বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। অন্য দেশগুলোও তখন চিন্তা করবে, বাংলাদেশ থেকে তারা তৈরি পোশাক কিনবে কি কিনবে না। রানা প্লাজা ধসের পর ইতিমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে একটা প্রভাব ফেলবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানায়, ইউরোপের বাজারেও এর প্রভাব পড়বে। এই সংকেতগুলো আমাদের জন্য ভালো নয়।

আমাদের দেশে তৈরি পোশাক খাতটি দ্রুত বিকশিত করার ক্ষেত্রে আমরা আশির দশকে বেশ কিছু সুযোগ পেয়েছিলাম। একদিকে যেমন ছিল উদ্যমী ব্যক্তি খাত ও সরকারি সহযোগিতা, অন্যদিকে ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশসুবিধা। এর পাশাপাশি প্রতিযোগী দেশগুলোর বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা ছিল। যেমন, শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ চলছিল। তাদের বাজারটা আমরা পেয়েছিলাম। অন্যদিকে চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার বাজারে শ্রমিকের মূল্য বেশি। কিন্তু সেটা কত দিন? ক্রমেই যদি আমরা এ রকম দুর্ঘটনাকবলিত হতে থাকি, তাহলে পশ্চিমা ক্রেতারা কি আমাদের ওপর নির্ভর করতেই থাকবে? ইতিমধ্যেই আমরা বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়েছি। দু-একটি ক্রেতা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আর কিনবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
এখন বিদেশে অনেক জায়গায় প্রচারণা চলছে বাংলাদেশের রক্তমাখানো কাপড় না পরতে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো আক্রমণাত্মক আচরণ করছে। আমরা অপমানিত হচ্ছি, অস্বস্তিতে ভুগছি। কোনো কোনো ক্রেতা মিয়ানমারে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। সেখানে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি উদ্যোক্তারা সেখানে যাচ্ছেন বিনিয়োগের জন্য। পশ্চিমা ক্রেতারা এমনকি চলে যেতে পারে ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ায়। আমাদের জন্য এটি হবে একটি বিপর্যয়, যার ধাক্কা সজোরে এসে লাগবে অর্থনীতিতে। কেননা, তৈরি পোশাক খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ লোক কাজ করেন। এ খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁদের আমরা কোথায় কর্মসংস্থান দেব? শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, আমাদের বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, আর অর্ধবেকারত্বের হার প্রায় ২০ শতাংশ। তার ওপর প্রতিবছর শ্রমবাজারে নতুন করে ঢুকছে প্রায় ১৮ লাখ শ্রমশক্তি। অথচ আমাদের অর্থনীতির আকার সেই তুলনায় ছোট। মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ২০১২ অর্থবছরে ১১২ বিলিয়ন ডলার ছিল। আর বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থানের মূল ক্ষেত্র।

তাই তৈরি পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থানের অভাবে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই হবে না, সামাজিকভাবেও এর মূল্য দিতে হবে। সরকার, কারখানামালিক, শ্রমিক ও ক্রেতা—সব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই শিল্পটিকে ইতিবাচক দিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। একদিকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, অন্যায়ের শাস্তি বিধান এবং পর্যাপ্ত সম্পদ ও জনবলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগগুলোর দক্ষতা বাড়াতে হবে। অন্যদিকে সরকার, মালিক ও ক্রেতাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়ানোর মাধ্যমে শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা ও জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। শ্রমিক ও কারখানাসংক্রান্ত কমপ্লায়েন্সগুলো সঠিকভাবে মানতে পারলে তৈরি পোশাকশিল্প খাতটিকে আমরা সামনের দিনগুলোয়ও শুধু যে ধরেই রাখতে পারব, তা নয়, বিশ্ব রপ্তানিতে আমাদের অংশও বাড়াতে পারব।

– ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ