পোশাকশিল্পে ওয়েকআপ কল: যথাযথ সাড়ায় সম্ভাবনার জানালা খুলে যাবে

দৈনিক সমকাল: সাক্ষাৎকার গ্রহণ :অজয় দাশগুপ্ত

অগ্রণী সিভিল সোসাইটি থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে স্বীকৃত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান রাশিয়ার মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্নাতক এবং সেখানেই উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ফুলব্রাইট ফেলো। গবেষণা কাজে চমকপ্রদ ফলের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাপূর্ণ ইব্রাহিম মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক জয়ী ড. রহমান বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত। কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা তিনি এবং দেশ-বিদেশের জার্নালে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। সমকালের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন রানা প্লাজা ধসের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে

সমকাল : বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান দেশ-বিদেশে স্বীকৃত। কিন্তু এখন এ শিল্পের মালিকরা কাঠগড়ায়…।

মোস্তাফিজুর রহমান: রানা প্লাজায় নিহতদের জন্য গোটা দেশ শোক প্রকাশ করছে। তারা কর্মস্থলে নিহত হয়েছেন। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা পোশাকশিল্পের অনিরাপদ কাজের পরিবেশের প্রতি আরেকবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করল। একই ঘটনা ঘটেছে তাজরীন কারখানায় অগি্নকাণ্ডের সময়। এ শিল্পের বহুমুখী প্রভাব আমাদের অজানা নয়। মাত্র ৩০ বছরের ইতিহাস এ শিল্পের। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় আমাদের শিল্প খাত ছিল একেবারেই দুর্বল। পাট, চামড়া ও চিনি কারখানা ছিল। কয়েকটি কারখানায় বস্ত্র-সুতাও তৈরি হতো। কুটির শিল্প হিসেবে ছিল তাঁত। তৈরি পোশাকশিল্পের অস্তিত্বই ছিল না। অথচ অল্প সময়েই সবকিছু বদলে যেতে থাকল। উন্মোচিত হলো নতুন দিগন্ত। এখন ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে পোশাকশিল্প থেকে। সংগঠিত শিল্প শ্রমিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কাজ করছে গার্মেন্টগুলোতে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান ভিত এ শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার ক্রমাগত সমৃদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার মান স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রেও অনন্য অবদান রাখছে। এ শিল্পের ক্রমউন্নতির পাশাপাশি আমাদের সার্বিক অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে চলেছে।

সমকাল :মাত্র তিন দশকে এত বড় শিল্প খাত কীভাবে গড়ে উঠল?

মোস্তাফিজুর রহমান :অনেক উপাদান কাজ করেছে। উদ্যোক্তাদের উদ্যম, উদ্যোগ ও বুদ্ধিমত্তা কাজ করেছে। সরকারের তরফে ছিল সর্বাত্মক সহায়তা। বিশ্ববাজারে যে সুবিধা রয়েছে সেটা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রেও সরকার ও উদ্যোক্তা উভয়ের সক্রিয়তা আমরা দেখেছি। সর্বোপরি রয়েছে বাংলাদেশের শ্রমিকদের দ্রুত কাজ শেখার ক্ষমতা। তারা একটানা দীর্ঘ সময় কাজ করে যেতে পারেন। দিনে ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করছে লাখ লাখ শ্রমিক। এভাবেই আমাদের অর্থনীতির একটি দৃঢ় ভিত গড়ে উঠতে শুরু করেছে। জিডিপি, কর্মসংস্থান, শিল্পায়ন_সবকিছুতেই এর প্রভাব। তলাবিহীন ঝুড়ি নয় বরং কয়েক বছরের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভানাময় দেশ_ এই যে ভাবমূর্তি তার পেছনেও তৈরি পোশাকশিল্পের অবদান বিপুল।

সমকাল :রফতানি আয় বেড়েছে। শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অবকাঠামো ভিত গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। এটা কি যথাযথভাবে গড়ে উঠেছে?

মোস্তাফিজুর রহমান :এখানে অসামঞ্জস্য রয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা প্রকট। শিল্প দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছে। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্ডার নিয়মিত বেড়েছে এবং এতে আয় বেড়ে চলেছে। শ্রমিক সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত হারে। কিন্তু কাজের পরিবেশ সব ক্ষেত্রে উন্নত হয়নি। শ্রমিকদের অধিকারও অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিত বা উপেক্ষিত। কমপ্লায়েন্স শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। এর ব্যাপকতা অনেক। শিল্পের প্রসারের সঙ্গে কমপ্লায়েন্স মেনে চলা হয়নি। আমরা বিশ্ববাজারের সুবিধা নিয়েছি, কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার ও কাজের পরিবেশ তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিশ্চিত করা যায়নি।

সমকাল :এ দায়িত্ব কার?

মোস্তাফিজুর রহমান :শিল্প মালিকের দায়িত্ব অবশ্যই রয়েছে। নতুন নতুন ব্যবসা পেয়ে অনেকে কারখানা সম্প্রসারণ করেছেন বা নতুন ইউনিট করেছেন। কোম্পানির আয় বেড়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের স্বার্থ সব ক্ষেত্রে দেখা হয়নি। সরকারও সবকিছু দেখভাল করেনি। কারখানা ভবন মানসম্পন্ন কি-না, শ্রমিকদের কী কী সমস্যা_ এসব দেখা হয়নি। শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার জন্য যেসব দফতর সরকারের রয়েছে, সেখানে জনবলের সমস্যা রয়েছে। তবে জনবল কমের অজুহাতে কোনো কাজই করা হবে না, সেটা হতে পারে না।

সমকাল :আমাদের পোশাকশিল্পের বিকাশে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের ভূমিকা বিপুল। বায়িং হাউসের ওপরেই এ শিল্প নির্ভরশীল। শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে তাদের দায়দায়িত্বের প্রশ্ন উঠছে…।

মোস্তাফিজুর রহমান :শ্রম নিরাপত্তার প্রশ্নটি তারা বিভিন্ন সময় তুলেছে। তবে তারা একটি চেইনের মাধ্যমে অগ্রসর হয়। এর এক প্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা। শ্রমিকের বেতন-ভাতাসহ আর্থিক সুবিধা এবং কাজের ক্ষেত্রে, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা রয়েছে, সেটা নিয়ে যত কথা হয়েছে তত কাজ হয়নি। এক প্রতিষ্ঠান অর্ডার এনেছে এবং তারা সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। প্রধান গুরুত্ব পায় সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করা। একই সঙ্গে বিবেচনা থাকে কত কম মূল্যে তারা এখান থেকে পোশাক কিনতে পারে। ইথিকাল বায়িংয়ের কথা অনেক প্রতিষ্ঠান বলে। উন্নত বিশ্বে এ ইস্যুতে নাগরিক আন্দোলনও রয়েছে। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, আন্তর্জাতিক ব্রান্ড ও বায়িং হাউসগুলো যেখানে সস্তায় পোশাক পেয়েছে, সেখানেই গিয়েছে।

সমকাল :বাংলাদেশের অনেক কারখানায় কাজের উপযুক্ত পরিবেশ নেই_ এ অভিযোগ তো দীর্ঘদিনের…।

মোস্তাফিজুর রহমান :বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে চার হাজারের বেশি ইউনিট রয়েছে। কারখানার মান অভিন্ন নয়। সাব-কন্ট্রাক্টের কারখানাগুলোয় কাজের পরিবেশে অনেক দুর্বলতা। ভবন মানসম্পন্ন নয়। কাজের সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। জরুরি সিঁড়ি নেই। আগুন নেভানোর আয়োজন দুর্বল। প্রকৃতপক্ষে ব্যয় কমানোর প্রতিই মালিকদের প্রধান মনোযোগ।

সমকাল : মজুরিও কম বলে শ্রমিকরা অভিযোগ করছেন।

মোস্তাফিজুর রহমান :বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ও প্রবৃদ্ধি হারের সঙ্গে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সচ্ছল জীবন তো নয়ই, মোটামুটি ভালোভাবে চলার মতো মজুরি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেই। বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, মালিকরা মোটামুটি লাভ রেখেই শ্রমিকদের আরও কিছু আর্থিক সুবিধা দিতে পারেন। এ জন্য তাদের মনোভাবে পরিবর্তন চাই। অন্যদিকে, সরকার অবকাঠামো সুবিধা সৃষ্টির প্রতি মনোযোগ বাড়ালে পোশাক উৎপাদন ব্যয় কিছুটা কমানো সম্ভব। এর ফলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা যেমন সহজ হয়, তেমনি শ্রমিকদের সুবিধা বাড়ানো যায়। কারখানায় জেনারেটর ব্যবহার হলে ব্যয় বাড়ে। হরতাল-ধর্মঘটে কাজ বিঘি্নত হয়, খরচ বাড়ে। সেন্ট্রাল ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করা গেলে ব্যয় কমানো যায়। বিদেশি ক্রেতারাও বাংলাদেশে আসে সস্তায় কেনার চিন্তা থেকে। তারা এখানের তুলনায় অন্য কোনো দেশে কম টাকায় কিনতে পারলে চলে যাবে, এমন শঙ্কা থাকে। তাদের কাছ থেকে মজুরি বাবদ বাড়তি অর্থ আদায় করা গেলে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো সহজ হয়। আবার দেশীয় মালিকদেরও বুঝতে হবে, শ্রমিকদের যথাযথ মজুরি দিলে উৎপাদনশীলতায় তার প্রভাব পড়ে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী নূ্যনতম মজুরি ধার্যের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। প্রধান ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে দুর্ঘটনা ঘটলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে কাজের পরিবেশ, মজুরি প্রভৃতি ইস্যুতে আলোচনা শুরু হয়। তাদের মাধ্যমে প্রধান ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ রাখার জন্য আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত।

সমকাল :তাজরীনের পর সাভারের রানা প্লাজায় ধস। মেড ইন বাংলাদেশ ব্রান্ড তো এখন হুমকির মুখে…।

মোস্তাফিজুর রহমান : এ ধরনের হুমকি রয়েছে। তবে এটা হবেই, সেটা বলা চলে না। শ্রমিকদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে, এ অভিমত যথার্থ। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে চলেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দার মধ্যেও বছরের পর বছর আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ভালো থাকছে। দারিদ্র্যের হার কমছে। এ অবস্থায় উন্নত বিশ্বের উচিত হবে আমাদের প্রচেষ্টায় সহায়তাদান। আমাদের অবশ্যই এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আর কোনো ‘রানা প্লাজা নয়, আর কোনো তাজরীন কিংবা স্পেকট্রাম নয়’।

সমকাল :এটা কে করবে?

মোস্তাফিজুর রহমান :প্রথম কাজ অবশ্যই মালিকের। তাদের সংগঠন রয়েছে বিজিএমইএ। সদস্যদের প্রশ্নে তাদের জিরো টলারেন্সের মনোভাব নিতে হবে। কোনো সদস্য নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সদস্যপদ বাতিল করতে হবে। কারখানার কাজের পরিবেশ এবং শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের বিষয়ে যেসব অঙ্গীকার রয়েছে সেটা রক্ষা করা হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে বিজিএমইএর সার্বক্ষণিক মনিটরিং চাই। এমনও শোনা যায় যে, কোনো কোনো কারখানা মালিক বিজিএমইএর নির্দেশনা মানে না। এ ধরনের সদস্যদের দায়ভার কেন বিজিএমইএ নেবে? তাদের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সরকারকেও এ বিষয়ের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে।

সমকাল : শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের দাবি মালিকরা ক্রমাগত উপেক্ষা করছেন। সরকারের অবস্থানও মালিকদের পক্ষে। বিষয়টির সমাধান কীভাবে হতে পারে?

মোস্তাফিজুর রহমান :শ্রমিকদের সমষ্টিগত স্বার্থ দেখার জন্য ট্রেড ইউনিয়নের বিকল্প নেই। মালিকদের স্বার্থ দেখার জন্য ইউনিয়ন অর্থাৎ বিজিএমইএ রয়েছে। শ্রমিকদের কেন থাকবে না? সম্প্রতি শ্রম আইনের সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ১০০ জনের বেশি শ্রমিক থাকলেই ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দিতে হবে। এ অধিকার বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়ায় অসহযোগিতা, হেনস্তা, হয়রানি যেন না হয় সেটা সরকারকেও নিশ্চিত করতে হবে।

সমকাল :রানা প্লাজা ধসের কারণে জিএসপি সুবিধা বাতিল হতে পারে, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। আবার এটাও বলা হচ্ছে, এ গার্মেন্টে সুবিধাই তো নেই। এ বিষয়টিতে মালিকপক্ষ ও সরকারের মনোভাব কী হওয়া উচিত?

মোস্তাফিজুর রহমান : রানা প্লাজা ধসের আগেও যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধার বিষয়ে শুনানি হয়েছে। তাদের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। আরও কিছু ইতিবাচক উদ্যোগও সরকারের তরফে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাকশিল্পকে এখনও জিএসপি সুবিধার আওতায় আনেনি। এ জন্য আমাদের দাবি আছে। তবে অনেক পণ্যে এ সুবিধা বাংলাদেশ পেয়ে থাকে। রানা প্লাজা ধসের পর এ সুবিধা নিয়ে শঙ্কা বেড়েছে। অন্য পণ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তখন শুল্ক দিয়ে আমাদের পণ্য সে বাজারে প্রবেশ করবে এবং এর ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। তারা যদি এ সুবিধা বহাল না রাখার ঘোষণা দেয়, তাহলে রফতানি বাজারে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। বাংলাদেশের পোশাকের খুচরা ক্রেতাদের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাককে জিএসপির আওতায় নিয়ে এলে আরও কয়েকটি দেশ এ সুবিধা পাবে। তখন বাংলাদেশ বাইরে থাকলে আমাদের ক্ষতি হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমরা এ সুবিধা পাই। তারাও তখন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করতে পারে। কানাডার বাজারেও প্রভাব পড়তে পারে। এখন প্রয়োজন হচ্ছে, শ্রমিকদের স্বার্থ নিশ্চিত করায় বাংলাদেশ কী কী করছে, সেটা বিশ্ববাসীকে অবহিত করা। বাংলাদেশ যে রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর যথার্থই আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে, সেটা সবাইকে বোঝাতে পারলে আমরা এমনকি আগের চেয়েও ভালো অবস্থানে চলে যেতে পারি। আমার তো মনে হয়, এটা ওয়েকআপ কল এবং তাতে যথাযথ সাড়া দিতে পারলে আমাদের জন্য সম্ভাবনার জানালা খুলে যেতে পারে। অন্যদিকে, গতানুগতিকভাবে চললে এতদিনের সতর্কবাণী অচিরেই সাবধানবাণীতে পরিণত হবে এবং এক পর্যায়ে মহাবিপদ সংকেত হিসেবে দেখা দেবে। আমরা যা করছি এবং করতে চাই তাতে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা থাকা চাই। তাজরীন কিংবা রানা প্লাজায় যাদের করুণ মৃত্যু হয়েছে তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেও আমাদের জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববাজারের প্রধান ক্রেতাদের এভাবে আমরা উৎসাহিত করে তুলতে পারি। এত বড় দুর্ঘটনা যেন এ শিক্ষাই দেয় যে, আমরা যা বলছি সেটা সম্পন্ন করায় শতভাগ আন্তরিক।

সমকাল :যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি) অনেক দিন ধরেই আলোচনায়। এটি সই হলে জিএসপি অব্যাহত রাখা সহজ হবে বলে অনেকে মনে করছেন। আবার বিরোধিতাও রয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

মোস্তাফিজুর রহমান : টিকফা একটি আলোচনার প্লাটফর্ম। সেখানে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সুবিধা বাড়ানোর জন্য দাবি তুলতে পারি। জিএসপি সুবিধার বিষয়েও এ প্লাটফর্ম ব্যবহার সম্ভব। যদি জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমি এ চুক্তি সইয়ের যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মনে করি। বাংলাদেশের যে বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে, সেটাও তাদের সামনে তুলে ধরার এটা সুযোগ এনে দেবে। আমরা জিএসপি সুবিধা চাইছি তৈরি পোশাক খাতে। এটা যাতে দেওয়া হয়, সে জন্য এ ফোরাম কাজে লাগানো সম্ভব। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে বাংলাদেশের পক্ষে লবিং করার প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে।

সমকাল : বাংলাদেশ অচিরেই তৈরি পোশাকের বাজার হারাতে চলেছে, এমন একটি শঙ্কা কেউ কেউ তুলে ধরছেন…।

মোস্তাফিজুর রহমান :এটা রাতারাতি হবে না। আগামী কয়েক মাসের অর্ডার বাংলাদেশে রয়েছে। আমরা যদি কারখানার পরিবেশের বিষয়ে উদ্যোগী না হই, তাজরীন-রানা প্লাজার মতো নতুন কোনো বিপর্যয় ঘটে, তাহলে ক্রমে অর্ডার কমতে থাকবে। বিশ্ববাজার প্রতিযোগিতামূলক। আমাদের মতো কয়েকটি দেশ আমাদের বাজার ছিনিয়ে নিতে মুখিয়ে আছে। বিশ্ববাজারে এখন বস্ত্র চাহিদার ৩০ শতাংশ সরবরাহ করে চীন। বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে_ হিস্যা ৫ শতাংশ। চীন থেকে কিছু অর্ডার বাংলাদেশ পাবে, এমন সম্ভাবনা জোরালো। কিন্তু আমরা যদি কমপ্লায়েন্স উপেক্ষা করি, তাহলে এটা আসবে না। এভাবে বিদ্যমান বাজার হারাতে থাকব এবং সম্ভাব্য সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং সেটা উন্নয়নের পথে চলায় মস্ত বাধা হবে। এখন বিশ্ববাজারের বড় বড় ক্রেতারা লক্ষ্য করবে, বাংলাদেশ কী করছে। আমরা যদি ভালোভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারি, তাহলে ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে। ফের যদি বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে অবশ্যই নতুন ধাক্কা আসবে এবং সেটা সামাল দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা আর নয়। সামনের কয়েকটি মাস হবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পোশাক মালিক ও সরকার কী করছে, শ্রমিকদের স্বার্থ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে তার প্রতি নজর থাকবে বিশ্বের অনেক অনেক চোখের। ঠিক পথে চললে বাংলাদেশ বাজার হারাবে না বরং চীনের যে অর্ডার অন্যত্র যাচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ পাবে বাংলাদেশ।

সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুর রহমান :সমকাল পাঠকদের জন্য শুভেচ্ছা।