Towfiqul Islam Khan on middle income trap for Bangladesh

Published in দৈনিক জনকণ্ঠ  on Monday, 15 February 2016

দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে আগামী বাজেটেই রোডম্যাপ

সরকার দশ বছরে ১৫ লাখ প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলতে চাইছে

এম শাহজাহান ॥

দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে দেশে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ ও জাতীয় আয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে দেশ। এছাড়া দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে কমে যাচ্ছে জনশক্তি রফতানি, ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় উৎস রেমিটেন্স অর্জনও রয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। এই বাস্তবতায় দেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করছে সরকার। আর তাই আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের লক্ষ্য আগামী দশ বছরে ১৫ লাখ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে আগামী বাজেটে একটি রোডম্যাপ কর্মসূচী ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নে গাইডলাইন দেয়া হবে। এছাড়া ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দ্রুত দেশের ১০০ উপজেলায় একটি করে কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিভাগীয় শহরে একটি করে গার্লস টেকনিক্যাল স্কুল ও চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, ২৩ জেলায় নতুন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং সকল বিভাগে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করা হবে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করবে সরকার। এছাড়া দক্ষ মানব গড়ে তুলতে প্রতিটি উপজেলায় টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা প্রসারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে নিয়ে যেতে কাজ করছে বর্তমান সরকার। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর ওই সময় সামনে রেখে ইতোমধ্যে ভিশন-২১ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার আওতায় উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন ও প্রাক্কলিত রাজস্ব আহরণে জোর দেয়া হয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে সাফল্য আনতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়নে সবচেয়ে জোর দেয়া প্রয়োজন। প্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্যানুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেবে সরকার। তিনি বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ রফতানি করা গেলে এখন যে রেমিটেন্স আসছে তার দ্বিগুণ আনা সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী দিনদিন অদক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। তাই জনশক্তি রফতানির স্বার্থেও আমাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তোলা প্রয়োজন। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেটে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেয়া হচ্ছে।

এদিকে, বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্যমতে, যে দেশে কারিগরি শিক্ষার হার যত বেশি, সে দেশে মাথাপিছু আয়ও তত বেশি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া কারিগরি শিক্ষা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে ওসব দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ৮ হাজার থেকে ৪৫ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত। অন্যদিকে বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি মাত্র ২ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৪ ডলার। শুধু জনশক্তির দক্ষতার তারতম্যের কারণে জাতীয় উৎপাদনে ভারতের তুলনায় ৬০ শতাংশ, মালয়েশিয়ার তুলনায় ৪ শতাংশ আর জাপানের তুলনায় ১ শতাংশ অবদান রাখতে পারছে বাংলাদেশীরা। অথচ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জোর দেয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপির হার অনেক বেশি।

এছাড়া পোশাক রফতানিতে চীনের পর এখন বাংলাদেশের স্থান। বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর ২৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়। এ শিল্পের সঙ্গে প্রায় ৪০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা জড়িত, যার অধিকাংশই আবার নারী।

ইতোমধ্যে রূপকল্প-২১ সামনে রেখে পোশাক শিল্প উদ্যোক্তারা রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন, তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রচুর দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি। এছাড়া নির্মাণ, হালকা প্রকৌশল, সিরামিক, চামড়া ও পাদুকা, ফার্মাসিটিক্যাল ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও প্রচুর দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া খাদ্য উৎপাদন, মৎস্য চাষ, মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনে যে অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখতে হলেও এ সব খাতে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে সরকারের সবচেয়ে বেশি ব্যয় বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ ও জাতীয় আয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনে তিনটি অন্তরায়ের মধ্যে একটি হলো দক্ষ জনশক্তির অভাব। এ কারণে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বর্তমান সরকার উন্নয়ন সহযোগী, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা, শিল্প সংগঠন ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে কিছু ভাল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখন এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না কিংবা তা কেবল পরিকল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ বছরে ২৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৩ বাংলাদেশী কর্মী বিদেশ গেছেন। এদের মধ্যে আধাদক্ষ ও অদক্ষ জনসংখ্যার হার সবচেয়ে বেশি। নগণ্য সংখ্যক পেশাদার ও দক্ষ জনশক্তি রফতানি হচ্ছে ফলে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ৯ কোটিরও বেশি। আগামী ২০৩০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা হবে ১৮ কোটি, যার মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১২ কোটি আর নির্ভরশীল জনসংখ্যা হবে ৬ কোটি। এই বিপুল কর্মক্ষম নাগরিকদের কর্মসংস্থান করতে না পারলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জানা গেছে, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের জন্য আগামী তিন বছরে তিনটি মন্ত্রণালয়ের ৩২ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ডিপার্টমেন্ট, পিকেএসএফ এবং নয়টি শিল্প সংগঠনের মাধ্যমে ২ লাখ ৬০ হাজার জনকে আন্তর্জাতিকমানের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। শুধু তাই নয়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া হবে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ কর্মীকে। যদিও বর্তমান বাজেটে পোশাক শিল্প, নির্মাণ খাত, তথ্যপ্রযুক্তি, হালকা প্রকৌশল, চামড়া ও পাদুকা এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অগ্রাধিকার খাত নির্ধারণ করে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

এদিকে, সম্ভাবনাময় খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে আগামী বাজেটে অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দেয়ার তাগিদ দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। বেসরকারী এই সংস্থাটির মতে, ২০২১ সালের মধ্যে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বাংলাদেশকে মানবসম্পদের উন্নয়ন ও অর্থনীতির বহুমুখীকরণ করতে হবে। সংস্থাটির সম্মানিত রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সম্ভাবনাময় খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলো দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর যে অগ্রগতি হয়েছিল তাতে ভাটা পড়েছে। এই দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে ভবিষ্যত পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। কৃষি খাত থেকে শ্রমিক বের করে শিল্প খাতের দিকে নিয়ে যেতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ॥ দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচী চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (সিপ) শীর্ষক এ প্রকল্পে পাঁচটি খাতে ১২ ট্রেডে ১০ হাজার ২০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। তিন বছর মেয়াদী এ প্রকল্পে ৪৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে। প্রশিক্ষণের জন্য দেশের আটটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এমএডব্লিউটিএস, ইউসেপ বাংলাদেশ, টিএমএসএস, ক্রিয়েটিভ আইটি লিমিটেড, উদ্দীপন, বিআইআইটি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড, এ্যাসোসিয়েশন অব গ্রাসরুট উইমেন এন্ট্রারপ্রেনিউরস বাংলাদেশ ও পিস এ্যান্ড রাইটস ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের তথ্যপ্রযুক্তি, তৈরি পোশাক, হালকা প্রকৌশল, অটোমোবাইল ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেক্ট্রিক্যাল মেনটেনেন্স খাতে প্রশিক্ষণ দেবে।

বিশেষ তহবিল গঠন ॥ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশেষ তহবিল গঠন করবে সরকার। ২২ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে এ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই বলা যায় না। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ দরকার। এজন্য সরকারী উদ্যোগ থাকতে হবে। তিনি বলেন, এরকম একটি উদ্যোগ (মানবসম্পদ উন্নয়নে তহবিল গঠন) ১৯৮১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামসুল হক নিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়, কেন বন্ধ হয়েছিল তা কেউ জানে না। প্রায় ৪০ বছর পরে এসে আবারও সেই তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের বাজেট বরাদ্দ, উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদান, দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সিএসআর তহবিলের অনুদান, রিক্রুটিং এজেন্সির চাঁদা ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অনুদান দিয়ে এ তহবিল গঠন করা হবে। এ ধরনের তহবিল ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে রয়েছে।