From Two Economies to Two Nations by Rehman Sobhan reviewed

Book Review: “From Two Economies to Two Nations: My Journey to Bangladesh” authored by Professor Rehman Sobhan, published in Kaler Kantho on Tuesday, 1 September 2015.

নতুন বই : ‘ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু নেশনস মাই জার্নি টু বাংলাদেশ’
রেহমান সোবহানের চোখে বঙ্গবন্ধু

রাজীব আহমেদ

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের আগে পূর্ব পাকিস্তানে একটি গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল। গল্পটি এ রকম-কুষ্টিয়ায় এক প্রার্থী প্রত্যন্ত গ্রামে ভোট চাইতে গেলে তাঁকে ভদ্রভাবে ফিরিয়ে দেয় গ্রামবাসী। তারা জানায়, বিপক্ষ প্রার্থীকেও ভোট দেবে না তারা। তখন সেই প্রার্থী চমকে গিয়ে প্রশ্ন করেন, গ্রামবাসী তাহলে কাকে ভোট দেবে? উত্তর আসে, ‘আমরা শেখ মুজিবউদ্দিনকে ভোট দেব।’ ওই আসনে শেখ মুজিবউদ্দিন নামে কোনো প্রার্থী ছিলেন না। গ্রামবাসীর কথার মানে হলো, শেখ মুজিব যাঁকে প্রার্থী করবেন তাঁকেই গ্রামবাসী ভোট দেবে। সেটা রহিম উদ্দিন, করিম উদ্দিন, ছলিম উদ্দিন-যেই হোন না কেন।

এ গল্পটি উল্লেখ করা হয়েছে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের ১৯৭০ সালের ৭ নভেম্বর প্রকাশিত এক লেখায়। ‘দ্য মুজিব ফেনোমেনন’ শিরোনামে তখনকার ফোরাম নামের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত ওই লেখাটি লেখকের নতুন বই ‘ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু ন্যাশনস : মাই জার্নি টু বাংলাদেশ’-এ সংকলিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে রেহমান সোবহানের প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা ও বক্তৃতা সংকলন করে বইটি প্রকাশ করেছে ডেইলি স্টার বুকস। বইটিতে সংকলিত বেশির ভাগ লেখাই ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে প্রকাশিত। ওই সব লেখায় বারবার এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রসঙ্গ। বইটি থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত কিছু অংশের ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য :

১৯৭০ সালে রেহমান সোবহান লিখেছেন, ‘বাঙালির সংগ্রামকে লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার সংকেত ইতিহাস শেখ মুজিবকে দিয়েছে। তিনি যদি নিজের আস্থা হারান তাহলে ইতিহাস তাঁকে এক পাশে ফেলে নিজের মতো এগিয়ে যাবে।’ ২০০০ সালে রেহমান সোবহান লেখেন, ‘স্বাধীনতার জন্য সত্যিকার মূল্য দেওয়া দেশের সাধারণ মানুষের রক্তের ঋণ শোধে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। সেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা, যা ওই সব মানুষকে স্বাধীনতার সংগ্রামে সংযুক্ত করতে পেরেছিল।’

স্বাধীনতার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তখন ফোরাম নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন তিনি। দুই অর্থনীতি, বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানের আলাদা জাতিসত্তা, দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য-ইত্যাদি নিয়ে তিনি তখন একের পর এক লেখা লিখেছেন। সেসব লেখার ক্ষুরধার যুক্তি তখন রাজনীতিবিদদের রাজনীতির মাঠের রসদ জোগাত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হন রেহমান সোবহান। পরে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) যোগ দেন তিনি। সেখান থেকে অবসর নিয়ে তিনি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) প্রতিষ্ঠা করেন।

ফোরামের সম্পাদনা করার সময় রেহমান সোবহান বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তিনি ছিলেন ওই পত্রিকার সম্পাদক, প্রবন্ধকার, প্রতিবেদক-আরো অনেক কিছু। বিভিন্ন সময় তিনি একাধিক নামে একাধিক লেখা লিখতেন। সামরিক শাসনের মধ্যে তাঁর ভয়হীন লেখার কারণে আইয়ুব খান জানতে চেয়েছিলেন, এই রেহমান সোবহান কে?

১৯৭০ সালের ৭ নভেম্বর তিনি ‘দ্য মুজিব ফেনোমেনন’ শিরোনামের এক লেখায় পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় কিভাবে শেখ মুজিবুর রহমান অন্য নেতাদের হটিয়ে বাঙালির একক নেতায় পরিণত হন তা উল্লেখ করেছেন। রেহমান সোবহান লিখেছেন, অন্য নেতারা যখন নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করছেন তখন শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক অস্ত্র। তিনিই একমাত্র নেতা, যার দুটো আসনে জয় নিশ্চিত। তিনি এখন অন্য প্রার্থীদের জয়ী করে আনতে প্রচারণা চালাচ্ছেন। শেখ মুজিব একবার সফর করলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ৫০ হাজার ভোট বেড়ে যায় গণ্য করা হয়।

রেহমান সোবহান আরো লিখেছেন, শেখ মুজিব নির্বাচনের প্রচারাভিযানকে এমন একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছেন যেখানে ঘোড়া কেবল একটি। এখন মাঠে আওয়ামী লীগই একমাত্র রাজনৈতিক দল। ফরিদপুরে মোহন মিঞা ও সালাম খান, খুলনায় সবুর, ময়মনসিংহে নুরুল আমিন, সিলেটে মুহাম্মদ আলী, বরিশালে মহিউদ্দিন, চট্টগ্রামে ফজলুল কাদের-এই আসনগুলোতে শক্ত লড়াই হতে পারে। তবে সেটা প্রার্থীর নিজের যোগ্যতায়, দলীয় প্রভাবের কারণে নয়।

প্রবন্ধের একপর্যায়ে রেহমান সোবহান ‘শেখ মুজিবউদ্দিন’কে ভোট দেওয়ার গল্পটি উল্লেখ করে লিখেছেন, এটা সত্য যে একজনের ক্যারিশমাই নির্বাচনী প্রচারকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তাঁর শ্রোতার তালিকায় শুধু কলেজছাত্র বা বাঙালি বুর্জোয়ারা ছিল না, বরং সবচেয়ে দরিদ্র মানুষগুলোও তার জনসভায় যেত। যারা মনে করে ক্যারিশমা একটি শহুরে ধারণা, তারা গিয়ে দেখতে পারে যে মুজিব শব্দটি প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি ঘরে একটি পরিচিত নাম।

কেন মওলানা ভাসানী, মুজাফফর আহমেদের মতো নেতারা থাকতেও শেখ মুজিব বাঙালির নেতা হয়ে উঠেছিলেন সে প্রশ্ন উঠেছে রেহমান সোবহানের লেখায়। তার উত্তরও দিয়েছেন তিনিই-এটা কেন হলো? ভাসানী একজন দুর্দান্ত বক্তা। কারাভোগ ও নির্যাতন সহ্য করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে মুজাফফরের। অন্য নেতারাও গুণের দিক দিয়ে তাঁর সমান সমান হতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো-মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, যেমন আরব জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়েছিলেন নাসের। ২৩ বছরের নিপীড়ন ও উপেক্ষার পর মানুষের মুক্তির প্রত্যাশা এক ব্যক্তির দিকে ধাবিত হয়েছে।

রেহমান সোবহান আরো লেখেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এখন বহু ধরনের প্রত্যাশার মিশেল। ভূমিহীন আশা করে সে জমি পাবে, দরিদ্র ভূমির মালিকরা আশা করে তাদের করের বোঝা কমানো হবে, শ্রমিকরা আশা করে তাদের মজুরি বাড়বে, বেকার আশা করে সে কাজ পাবে, সরকারি চাকুরেরা আশা করেন তাঁদের পদোন্নতি হবে, ব্যবসায়ীরা আশা করেন তাঁরা আরো অনুমোদন পাবেন, শিক্ষার্থীরা আশা করে তারা আরো বৃত্তি পাবে। সব আশা একজন মানুষের প্রতি, যিনি সাত কোটি মানুষকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ প্রকাশিত ‘পাবলিক লেকচার, ভলিউম-৪’-এ ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড দ্য এমারজেন্স অফ অ্যান ইনডিপেনডেন্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক লেখায় এসেছে স্বাধীনতার ঘোষণার প্রসঙ্গটি। রেহমান সোবহান লিখেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন এটা বড় ধরনের একটি অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য। যেকোনো ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ঘোষণা কেবল বৈধ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই আসতে পারে। নইলে যে কেউ বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বসত। ১৯৭১ সালে একজন অপরিচিত সেনা কর্মকর্তা কোনো ধরনের কর্তৃত্ব ছাড়া সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এবং তা মানুষ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে-এটা ভাবা বাস্তবসম্মত নয়। বরং এ ধরনের ঘোষণা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ধারণা তৈরি করতে পারত যে পূর্ব পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছে। ওই সময় একজন মানুষেরই স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার বৈধতা ছিল, তিনি শেখ মুজিব। সেই বৈধতা নির্বাচনী ও রাজনৈতিক-দুই দিক থেকেই ছিল। এই বাইরে কেউ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করলে সেটি গ্রহণযোগ্য হতো।

২৯২ পৃষ্ঠার বইয়ের শেষ অনুচ্ছেদে প্রকাশ পেয়েছে রেহমান সোবহানের আক্ষেপ। তিনি লিখেছেন, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সেই জনযুদ্ধ বিশ্বের অন্য অনেক স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে বাঙালির সংগ্রামকে আলাদা করেছিল। এ কারণেই আমাদের এমন একটা সমাজ নির্মাণ করা প্রয়োজন ছিল, যেখানে সাধারণ মানুষ স্বাধীন দেশে যথেষ্ট বস্তুগত ভাগ পায়। কিন্তু তার বদলে আমরা একটি অসাম্যের সমাজ নির্মাণ করেছি, যেখানে স্বাধীনতার সুফল কিছু উচু শ্রেণির মানুষের দখলে। যারা এখনকার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে কর্তৃত্ব করছে।

রেহমান সোবহান লিখেছেন, স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে আমরা এখনো রাজনৈতিক বিভাজন ও সামাজিক অস্থিরতার বৃত্তে বন্দি হয়ে আছি, যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের টেকসই উন্নয়নকে বাধা দিচ্ছে।

দুই ধরনের মলাটে প্রকাশিত ওই বইটির দাম ৩০০ ও ৩৫০ টাকা।