ড. আনিস পারভেজ
অতিরিক্ত পরিচালক, সংলাপ ও যোগাযোগ, সিপিডি
গত শতাব্দির তৃতীয় দশক থেকেই উন্নয়নের তত্ত্ব পশ্চিমা আধুনিকতাকে অনুকরন করার নির্দেশনা দিয়ে প্রকারন্তরে সমাজকে করেছে ভোগবাদী, রাষ্ট্রের অহমকে দিয়েছে পুষ্টি, আর ব্যক্তিকে ঠেলে দিয়েছে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার উন্মাদনায়। ভৌতিক ও অভৌতিক ভোগই লক্ষ্য; তাই ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র চলছে একরৈখিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনুশাসনে। বদলে গেছে পৃথিবী, দুঃখজনক ভাবে ধ্বংসাত্মক পথে, যা স্পষ্ট দ্রুতবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ায়।
বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০১৫ সালে ৩৬ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ হয়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাম্প্রতিক উপাত্ত অনুসারে এখন বায়ুমণ্ডলে যে পরিমান কার্বন জমেছে তা আট লাখ বছরের মধ্যে সবচে বেশি। পরিণামে ঘটছে পৃথিবীর নেতিবাচক রূপান্তর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ—অসময়ে অতিবৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি—যার ফলশ্রুতিতে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে খাদ্যাভাব, বাস্তুচ্যুতি, স্বাস্থ্যহানি ও প্রাণক্ষয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যা এর টেস্টিমনি। তবে উন্নত বিশ্বও মুক্ত নয় প্রকৃতির বৈরী প্রভাব থেকে, কেননা প্রকৃতি ধনী দরিদ্রের পার্থক্য করে না। তাই টেক্সাসের জনপদও ভেসে গেছে বন্যায়, অন্টারিওর রাস্তা রূপ নিয়েছে খালের। যে কোন নির্মাণ ও অর্জনই ধসে যাবে, বিলীন হবে মানব প্রজাতি যদি না পরিবেশের বিপন্নতা রোধ করা যায়।
মানুষ তার আপাত সুখের জন্য প্রকৃতিকে বিষিয়ে তুলছে, যা বুমেরাং হয়ে আঘাত করছে মানুষকেই। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত বিশ্ব পরিবেশ দূষণে সবচে এগিয়ে। তাদের কলকারখানা ও যানবাহনের ধুয়ো এবং ভোগ্যপণের বর্জ্য বায়ুমণ্ডলে কার্বন ছড়িয়ে দেয়। চীন তার বস্তুগত উন্নয়নকে ধরে রাখতে গিয়ে সবচে বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে যার পরিমাণ পুরো নিঃসরণের ২৮.৫৬%। যুক্তরাষ্ট্রের নিঃসরণ ১৪.৯৩%। উন্নয়নশীল দেশগুলুর কার্বন নিঃসরণ অতি নগণ্য, যেমন বাংলাদেশের মাত্র ০.২১%। তবে এসব দেশেও পরিবেশ অবান্ধব উন্নয়ন অচিরেই কার্বনের নিঃসরণ নিশ্চিত আরও বাড়াবে।
আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, চলছে বিতর্ক। কিন্তু রাষ্ট্রের অহম, অর্থাৎ বস্তুগত সম্পদ ও ভোগ বাড়ানোর আগ্রাসী মনস্তত্ত্ব, কোন কার্যকরী উদ্যোগ সৃষ্টি করতে পারছে না। চীন ও ভারত কার্বন নিঃসরণ কমাবে যেদিন তারা তথাকথিত উন্নয়নের স্কেলে পাশ্চাত্যের সমকক্ষ হবে, এরকমই তাদের প্রতিজ্ঞা। যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী নীতি ও দাম্ভিক আচরণে কোন রাখঢাক নেই। জলবায়ু তহবিল থেকে তারা সরে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে বাজারে ভোগ্যপণ্যের ভিড়। গাড়ি উপচে পড়ছে রাস্তায়—চারদিকে শুধুই ভোগের প্রতিযোগিতা। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে বিপন্নতা—বাংলাদেশের ও গোটা পৃথিবীর।
মানবসৃষ্ট বৈরী জলবায়ু প্রসূত বিপন্নতা উন্নয়নের আর সব অর্জনকে ম্লান করে দেবে। অর্থহীন হবে সব উন্নয়ন প্রচেষ্টা যদি বন্ধু প্রকৃতিকে আমরা শত্রু বানিয়ে ফেলি। তাই টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ২০৩০-এর ১৩ নম্বর অভীষ্ট জরুরি ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া। ব্যাপারটি অসম্ভব নয়, কিন্তু জটিল। মানব প্রকৃতির ভেতর লোভ মজ্জাগত, তাই অধিকাংশ নাগরিকই প্রকৃতি বিধ্বংসী ভোগ থেকে ব্যক্তি উদ্যোগে বিরত নাও হতে পারে। প্রয়োজন রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিকীকরণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা। রাষ্ট্রের পরিবেশ বান্ধব নীতিমালা ও তার যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। যেমনটি হচ্ছে স্কেন্ডেনেভিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীত চিত্র সেখানে—ব্যক্তির গাড়ি প্রায় সারাবছর গ্যারাজেই থাকে, নাগরিক ব্যবহার করে গণপরিবহন। গাড়ি চালানোয় গ্রিন ট্যাক্স বসিয়ে নাগরিককে পরিবেশ দূষণ করা থেকে অনুৎসাহিত করা হয়। ভুটান সুস্পষ্ট নীতির মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ শূণ্যেরও নিচে নামিয়েছে। উপরন্তু ভুটানের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ্যাডভোকেসি করছে পরিবেশ-বিপন্নতা কাটিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। নাগরিকের আচরণ পরিবর্তনে রাষ্ট্রের নীতি ও তার প্রয়োগের সাথে সাথে প্রয়োজন সামাজিকীকরণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নাগরিকের মনস্তত্ত্ব ও মনোভাব বদলানো। একরৈখিক বস্তুগত উন্নয়নের জবরদস্তি থেকে বেরিয়ে না আসলে আজকের বিপন্ন মানব হয়তো কাল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
কাঠামোগত পরিবর্তন ব্যতিরেকে কোন পরিবর্তনই টেকসই নয়। রাষ্ট্রের কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত সমাজের সর্বশ্রেণী। তাই সবার অংশগ্রহণই কেবল পরিবর্তন ও উন্নয়ন বাস্তবায়িত করতে পারে। এ বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ সংগঠিত হয়েছে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম-এ। প্ল্যাটফর্মের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এসডিজি বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের পাশাপাশি সক্রিয় ভুমিকা রাখা এবং এ প্রক্রিয়ার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। প্ল্যাটফর্মকে জনচেতনায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে “নাগরিক সম্মেলন ২০১৭: বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়ন”।
Carbon neutral Bhutan