Published in প্রথমআলো on Friday 5 June 2020
বাজেট ২০২০–২১
বিনিয়োগ কমবে, বাড়বে বেকার
বাজারে চাহিদা কম। জরুরি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য খাতে উৎপাদন কমে গেছে। রপ্তানিমুখী শিল্পেও পরিস্থিতি একই। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কেটে গেলেই যে চাহিদা লাফিয়ে বাড়বে, সে আশাও করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আগামী অন্তত এক থেকে দুই বছর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মুনাফা কমবে। অনেকে থাকবে নগদ টাকার সংকটে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে কি স্বাভাবিক গতি থাকবে? ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেটা হবে না। বরং এখন যেসব কর্মসংস্থান আছে, সেটা ধরে রাখাই কঠিন হবে।
তাঁদের বক্তব্য সমর্থন করছে অন্তত দুটি সমীক্ষা।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)করা একটি অপ্রকাশিত জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ৪৩ শতাংশ বলেছে, করোনাকালে তাদের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। কমার হার বড়দের ক্ষেত্রে ৫০, মাঝারিদের ৩৬, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের (এসএমই) ওপর লাইটক্যাসেল পার্টনারস ও সেবা এক্সওয়াইজেডের একটি সমীক্ষা গত ২৫ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়। ২৩৩টি প্রতিষ্ঠানের ওপর ওই সমীক্ষায় উঠে আসে যে সাধারণ ছুটিতে ৫২ শতাংশ মাঝারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী দিনগুলোতে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় পরিস্থিতি যেহেতু ভালো থাকার আশা ক্ষীণ, সেহেতু মানুষ জরুরি ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে দেবে। সঞ্চয় ধরে রাখতে চাইবে। রপ্তানি খাতেও একই পরিস্থিতি থাকবে বলে ধারণা করা যায়। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে শিল্প খাতে এখন যে উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে, সেটার পূর্ণ ব্যবহার না–ও হতে পারে। ফলে নতুন করে সক্ষমতা তৈরির জন্য বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা কম, অন্তত অধিকাংশ খাতে। বরং ছোট ও মাঝারি খাতে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আশঙ্কা আছে।’
বিনিয়োগ কেমন ছিল
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ হয়েছে ৮ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি (চলতি মূল্যে), যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বাড়তি। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ মোটামুটি ২ লাখ কোটি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ৬ লাখ কোটি টাকা।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব সংখ্যার গুরুত্ব ততটা বেশি নয়। অর্থনীতিবিদেরা গণ্য করেন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগের হারকে, যেটা (বেসরকারি বিনিয়োগ) অনেক বছর ধরেই ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুতেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে না।
বাজেটে কর্মসংস্থান পদক্ষেপ ও শর্তযুক্ত প্রণোদনার পরামর্শ দিয়ে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেকার বাড়লে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে।
এর মধ্যে আবার করোনার হানা। সাধারণ ছুটিতে অনানুষ্ঠানিক খাতে বহু মানুষের কাজ না থাকার খবর এসেছে। কিছু কারখানায় ছাঁটাইয়ের ঘোষণা এসেছে। বেতন, মজুরি ও উৎসব ভাতা কম অথবা আংশিক দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি তাতে সার্বিকভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশা করা কঠিন। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্সের মতো কিছু খাতে হয়তো বিনিয়োগ বাড়তে পারে।’ তিনি আরও বলছেন, ‘বাজেটে কতটুকু উৎসাহ দেওয়া হয়, সেটার ওপরে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান অনেকটা নির্ভর করছে।’
অপেক্ষা এখন বাজেটের, যা ঘোষণা হবে ১১ জুন।
কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কী
করোনা দুর্যোগ শুরুর আগেই বাংলাদেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতি সুখকর ছিল না। বেকারের সংখ্যা ও হার বাড়ছিল। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি ছিল আলোচনার বড় বিষয়।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, ডেটা সেন্স ও উন্নয়ন সমন্বয়ের এক যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। ১৪ লাখের বেশি প্রবাসী শ্রমিক বেকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন অথবা আসার পথে রয়েছেন। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও ২৫ জেলায় ৯৬২ জন উত্তরদাতার অংশগ্রহণে একটি জরিপের মাধ্যমে সমীক্ষাটি করা হয়েছে।
বছরে নতুন করে শ্রমবাজারে প্রবেশ করে ২০ থেকে ২২ লাখ মুখ। করোনাকালে সেটা বন্ধ থাকবে না।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে কঠিন সময়ের কথা মাথায় রেখেই সরকার বাজেটে পদক্ষেপ নেবে বলে জানান পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম। তিনি বলেন, বাজারব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখতে সরকার সাধ্যের মধ্যে সব পদক্ষেপই নিচ্ছে।
বিদেশি বিনিয়োগ কি বাড়বে
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) ‘ইনভেস্টমেন্ট ট্রেন্ড মনিটর’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে গত ২০ জানুয়ারি বলা হয়, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬ শতাংশের মতো কম। এটা অবশ্য প্রাথমিক প্রাক্কলন। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে গত মার্চে প্রকাশিত আঙ্কটাডের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের জন্য একটি আশার দিক হলো, চীন থেকে কারখানার একাংশ সরে যেতে পারে। জাপান চীন থেকে কারখানা সরিয়ে নিতে ২২০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিলও গঠন করেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কিছুটা মধ্যম ও নিম্ন দামের পণ্যের শিল্পকারখানা বাংলাদেশে আসতে পারে। উচ্চ দামের পণ্যের বিনিয়োগ বেশি পাবে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত। তারা অনেক আগেই এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। যেমন, ভারত বিনিয়োগ টানতে শ্রম আইন সংশোধন করেছে। করপোরেট কর কমিয়েছে।
অবশ্য কম দামের বিপুল পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ আকর্ষণীয় জায়গা বলেও মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বিদেশি বিনিয়োগ এলেও কর্মসংস্থানে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে এক-দুই বছর লাগবে।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর সংস্থা আইএফসির সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ মনে করেন, কর্মসংস্থান সুরক্ষায় সরকারি পদক্ষেপ দরকার। ছাঁটাই না করার শর্তে প্রণোদনা, অনুদান, করপোরেট করে ছাড়, বিভিন্ন ফি বা মাশুলে ছাড় ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্প বাড়াতে হবে।
মাশরুর রিয়াজ উল্লেখ করেন, ভারতে ভবিষ্য তহবিলে মালিকের অংশ সরকার দিয়ে দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর ৭০ শতাংশ বেতন কর্মীর ব্যাংক হিসাবে সরকার দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, যেসব কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই করবে না, তারা করের একটা অংশ ফেরত পাবে। তিনি বলেন, ‘তরুণেরা কাজ না পেলে বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। তার কয়েকটি নমুনা কিন্তু আমরা এর মধ্যেই দেখেছি।’