Originally posted in কালের কন্ঠ on 11 April 2022
নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি
ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদরা
করোনায় মানুষের আয়ের ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতির ফলে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাজারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট এবং পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার অস্থির করে তুলেছে। এ অবস্থায় পণ্যর দাম কমাতে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া এবং পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা।
গতকাল রবিবার ‘খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ’ নেটওয়ার্ক আয়োজিত ‘নগর-গ্রামের দারিদ্র্য পরিস্থিতি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন পিকেএসএফের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী।
ওয়েবিনারে বক্তারা বলেন, দরিদ্র মানুষ আয়ের ৬২ শতাংশ খাদ্য কিনতে ব্যয় করে। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অন্যতম সমস্যা হলো আইন প্রণেতারা ব্যবসায়ী। আর মানুষের খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এ ছাড়া সরকার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। কেননা নীতি-প্রণেতারা ব্যবসায়ীমহল থেকে এসেছেন। এখানে মন্ত্রী ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজদের তালিকা চান।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, করোনায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা। দেশে এত বড় বাজার, যা শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘ন্যায্যতার’ মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে না পারলে দ্রব্যমূল্য কেন, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ‘বাজার অর্থনীতিতে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকবে তা আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। ’
সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো এস এম জুলফিকার আলী বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ হলেও বাজারব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করছে না। মূল্যবৃদ্ধির কিছু যুক্তিসংগত কারণ থাকে। কিন্তু জোগান পর্যাপ্ত থাকলেও বিশেষ বিশেষ সময়ে এমনটা ঘটছে। এখানে সরকার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। কেননা নীতি প্রণেতারা এসেছেন ব্যবসায়ীমহল থেকে। ’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমরা এখন বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার লক্ষণগুলো দেখতে পাচ্ছি, যা মধ্য আয়ের দেশের পথে যাত্রার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রতিযোগিতামূলক বাজার বা মূল্যকাঠামো এখানে অনুপস্থিত। বাজার ব্যবস্থাপনায় সুসংঘবদ্ধ সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে হবে, যার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। ’ প্রতিযোগিতা কমিশন, ভোক্তা অধিকার কমিশন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়েও নজরদারি জোরদার করা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য আমরা পাচ্ছি না। তথ্যের অসংগতি দূর করা সম্ভব না হলে সঠিক নীতিনির্ধারণ করা সম্ভব নয়। দরিদ্র মানুষ তাদের আয়ের ৬২ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য কেনার জন্য। তাই ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জেনে, তার সঙ্গে প্রকৃত তথ্যের সামঞ্জস্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে হবে। ’
মূল প্রবন্ধে মহসিন আলী বলেন, ‘সরকারকে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে শহর ও গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি আঞ্চলিক বৈষম্য কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। বাজার তথ্য যাচাই করলে দেখা যায়, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শুধু শহরাঞ্চলে নয়, দেশজুড়ে জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন—জ্বালানি তেল, রান্নার চুলার গ্যাস, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, বিদ্যুৎ, গণপরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। ’
নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় মানুষ আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখন কম দামে পণ্য পেতে টিসিবির লাইনে দাঁড়াচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ‘ফ্যামিলি কার্ড’ বিতরণের মাধ্যমে টিসিবি থেকে কম দামে নিম্নবিত্তদের কাছে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে।
খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো—গ্রাম ও শহরাঞ্চলের প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষ যাতে খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে, সে জন্য নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি তাদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা, খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য হাওর অঞ্চলে অবিলম্বে বাঁধ ভাঙা, দেশব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধসহ সব ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অগ্রিম আমদানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।