Published in দৈনিক সমকাল on Thursday 30 July 2020
রাজধানীর বেশিরভাগ ফ্ল্যাটে কোরবানি হচ্ছে না
পশু মিলছে তো জায়গা মিলছে না। আবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে তো অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে পশু কেনা নিয়ে। এবার কোরবানি নিয়ে এমনই উভয়সংকটে পড়েছেন রাজধানীর বহু মানুষ। বিশেষ করে ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বেশি। করোনা মহামারির কারণে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে গিয়ে কোরবানি নিয়ে বেশিরভাগ আবাসনে সতর্কতামূলক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম ফ্ল্যাটের বাড়িগুলোতে এ ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা থাকলেও বড় আকারের আবাসনে কড়াকড়ি যথেষ্টই। ফলে এবার রাজধানীর বেশিরভাগ ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দাদের পক্ষে কোরবানি দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসের ২ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দা হাসিবুর রহমান প্রতিবার তিনটি পশু কোরবানি দেন- একটি খাসি ও দুটি গরু। এবার কেবল একটি গরু কোরবানি করবেন। তাও বাসার গ্যারেজে নয়, গাজীপুরে থাকা নিজের কৃষিজমিতে। হাসিবুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণেই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তিনি জানান, তার ভবনে যত ফ্ল্যাট মালিক বাস করেন, প্রায় সবাই প্রতিবছর এক বা একাধিক পশু কোরবানি দেন। এবার কয়েকজন কোরবানিই করছেন না। অন্যরা কয়েকজন মিলে একটি গরু কোরবানি দেবেন। করোনার স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে পশু কোরবানি দেওয়া সত্যিই খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ চিত্র কেবল হাসিবুর রহমানের বাসভবনের ক্ষেত্রেই নয়- কমবেশি প্রায় সবার কাছেই এবার কোরবানি করাটা দুরূহ হয়ে উঠেছে। অনেকে কোরবানির সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে কোরবানি থেকে বিরত থাকছেন। রাজধানীর হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি ভবনে ফ্ল্যাটের সংখ্যা ২৭। ওই ভবনে একজন ফ্ল্যাট মালিক আসমাউল হুসনা জানান, কয়েক দিন আগে কোরবানি নিয়ে তাদের ভবনের পরিচালনা কমিটির একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অন্যবারের মতো এবার ভবনের গ্যারেজে কোনো কোরবানির পশু জবাই করা ও মাংস বানানো যাবে না। বাধ্য হয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কোরবানিতে শরিক হয়েছেন।
মোহাম্মদপুরের সুবিশাল আবাসন প্রকল্প জাপান গার্ডেন সিটিতে কয়েক দিন আগে নোটিশ জারি করা হয়, কেউ ভেতরে কোরবানি করতে পারবেন না। পরে অবশ্য নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় আরেকটি নোটিশ জারি করে বলা হয়েছে, আবাসনের ভেতরে কোরবানি করা যাবে, তবে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোরবানির পশু জবাইয়ের স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ পরিচালক মাহমুদ আলম জানান, ক্যাম্পাসে বসবাসকারী শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের এবার মুহসীন হলের মাঠে কোরবানির পশু জবাই করতে হবে।
কোরবানি নিয়ে আরেকটি চিত্রও রয়েছে। করোনা মহামারির কারণে দেশের সব শ্রেণির মানুষই বড় রকমের আর্থিক সংকটে পড়েছেন। এই সংকটের কারণেও অনেকে কোরবানি করতে পারছেন না। যারা একটা পশু কোরবানি করতেন, তারা হয়তো কয়েকজন মিলে একটা পশু কোরবানি দেবেন। ফরাশগঞ্জের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সেলিম মোল্লা বলেন, এবার কোরবানি দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। তবে আত্মীয়স্বজন মিলে একটা গরু কোরবানি করবেন। করোনার কারণে এমনিতেই মনে স্বস্তি নেই। আবার ঈদে একেবারেই কোরবানি না করলে পরিবারের সবার মন আরও খারাপ হয়ে যাবে।
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী বাসেত দেওয়ান বলেন, অন্যবার কয়েকজন মিলে একটা গরু কিনে কোরবানি দিতাম। এবার পকেটে টাকা-পয়সা নেই। এ জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোরবানি দেবো না। ভাইবোনেরা কোরবানি দেবে। ঈদের দিন বোনের বাসায় চলে যাব পরিবার নিয়ে।
ঠিক এ রকম অবস্থার মধ্য দিয়ে আগামী ১ আগস্ট পালিত হতে যাচ্ছে পবিত্র ঈদুল আজহা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর বড় একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়বেন খামারিরা। কয়েক বছর ধরেই ভারত থেকে পশু আমদানি বন্ধ থাকায় দেশে বিপুলসংখ্যক খামার তৈরি হয়েছে। তারা পশুতে বিনিয়োগ করেন। কোরবানির জন্য পশু প্রস্তুত করেন। এ ধরনের খামারির সংখ্যা প্রায় ৭১ হাজার। তার মধ্যে গরুর খামারি ৬০ হাজার। বাকি খামারিরা মহিষ-ভেড়া-ছাগল উৎপাদন করেন। এবার পশু বিক্রি কম হওয়ায় তারা বড় চ্যালেঞ্জে পড়বেন। পাশাপাশি পশু বিক্রির সঙ্গে সহযোগী হিসেবে যেসব মানুষ সম্পৃক্ত হন, যেমন- পরিবহন, চামড়া, কসাইসহ সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের মাদ্রাসাগুলোর একটি বড় আয় হয় কোরবানির চামড়া থেকে। এবার চামড়ার মূল্য গতবারের চেয়ে কমানো হয়েছে। আবার পশু কোরবানিও কম হবে। এ জন্য তাদের ওপরও একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার জন্য সরকার কয়েকটা উদ্যোগের কথা ভাবছে। প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ, পশু ও মাংস রপ্তানি করে সেই আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার পশু কোরবানির কারণে স্বাস্থ্য খাতেও একটা সমস্যা হতে পারে। দেশের প্রচুর সংখ্যক অসহায় দরিদ্র মানুষ কোরবানির মাংসের জন্য অপেক্ষা করেন। কারণ, তাদের উচ্চমূল্য দিয়ে গরু বা খাসির মাংস কেনার সক্ষমতা থাকে না। তারাও প্রত্যাশিত পরিমাণে মাংস পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন।
বিশিষ্ট চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সমকালকে বলেন, একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পৃক্ত। করোনার কারণে সেটা আবার নতুন করে বোঝা যাচ্ছে। সাধারণত গরিব মানুষ কোরবানির সময় ৮/১০ কেজি মাংস পায়। তারা একটু তৃপ্তি করে মাংস খায়। এবার সেটা পাবে না। কাজেই জনস্বাস্থ্যের ওপরও এর প্রভাব পড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সংশ্নিষ্টরা জানান, গত বছরগুলোতে প্রতি কোরবানির সময় পশু বিক্রি ও সহযোগী খাতগুলোতে ২৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। গরু-ছাগল মিলিয়ে পশু বিক্রি হয় ৮০ লাখ। এবারও দেশে কোরবানিযোগ্য পশু আছে এক কোটি ১৭ লাখ। কিন্তু করোনার কারণে এবার এর অর্ধেক পশুও বিক্রি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন খামারি ও ফড়িয়ারা। অন্যান্য বছরে ঈদের প্রায় এক মাস আগে থেকেই খামারিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পশু এনে রাজধানীর গাবতলীসহ স্থায়ী হাটগুলোতে জড়ো করেন। এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। ঈদের আগের পাঁচ দিন রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট বসানো হয়। ওই সব হাট তার আগেই পশুতে ভরে যায়। এবার সে তুলনায় পশুর সংখ্যা অনেক কম। অন্যবার হাটের সংখ্যা যা থাকে, এবার তার অর্ধেক করা হয়েছে। রাজধানীতে এবার বসেছে ১৬টি কোরবানির পশুহাট। এ ছাড়া গাবতলীর স্থায়ী পশুহাট তো আছেই। এরই মধ্যে ওই সব হাটে পশু আমদানি হলেও তা একেবারেই কম। ক্রেতার সমাগম তেমন একটা নেই। বিক্রেতারা বলছেন, এবার দাম অনেক কম। আর ক্রেতারা বলছেন, বিক্রেতারা অনেক বেশি দাম চাইছেন।