আমি আজ বেদনা ভারাক্রান্ত – রেহমান সোবহান

Published in দৈনিক সমকাল on Monday 23 December 2019

ফজলে হাসান আবেদের প্রয়াণ আমাকে বেদনা ভারাক্রান্ত করেছে। তিনি বয়সে আমার চেয়ে প্রায় এক বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু আমার আগেই চলে গেলেন। তার মৃত্যুতে আমি একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়েছি।

ফজলে হাসান আবেদ সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আমরা যখন এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছিলাম, তখন হাতেগোনা যে কয়েকজনকে সঙ্গে চেয়েছিলাম, তিনি ছিলেন তাদের একজন। কিছুদিন আগে তিনি এই পদ থেকে সরে দাঁড়ান স্বাস্থ্যগত কারণে। নিজের প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাকসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে তিনি জড়িত ছিলেন, সবগুলো থেকেই অবসর নিচ্ছিলেন।

প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগের বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে আবেদকে আমি চিনি ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনগুলো থেকে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারণা ও তহবিল গঠনের কাজে স্বনিয়োজিত ছিলেন। আমি তখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের পক্ষে লবি করছিলাম। মনে আছে, তিনি চট্টগ্রাম থেকে লন্ডন পৌঁছে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা ও তহবিল গঠনে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। সেই প্রথম দেখার পর তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের সখ্যে চিড় ধরেনি।

স্বাধীনতার পর সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লায় ছোট্ট একটি ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প থেকে ফজলে হাসান আবেদ আজকের এত বড় ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন অনন্য নেতৃত্বের গুণে। স্বাধীনতার পর দেশে আরও হাজার হাজার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গড়ে উঠেছিল। এগুলোর অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্র্যাকের মতো ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। কোনো কোনোটি উপজেলা বা জেলা পর্যায়েই সীমিত থেকেছে। ব্র্যাক ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম শুরু করেছে।

ফজলে হাসান আবেদের একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে, তিনি একটি কাজে সীমিত থাকতেন না। কোনো বিষয়ের খণ্ডিত দিক নিয়ে পড়ে থাকতেন না। সবকিছুতে তার একটি ‘হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচ’ ছিল। তিনি মনে করতেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শুধু ক্ষুদ্রঋণ দিলেই হবে না, এর সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে আইনি সুযোগ ও শিক্ষা দিতে হবে।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একটি প্রতিষ্ঠান যেভাবে তৈরি হয়, সেটাকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা অনেকেই করতে পারেন। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানকে ছোট থেকে ক্রমাগত বড় করে তুলতে পারে খুব কম মানুষই। ফজলে হাসান আবেদ সেটা পেরেছেন। এখানেই তার স্বাতন্ত্র্য। তিনি প্রমাণ করেছেন, কথিত তৃতীয় বিশ্ব থেকেও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। তার একটা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি কাজ করেছেন জাতীয়ভাবে; কিন্তু ভেবেছেন আন্তর্জাতিক মাত্রায় (স্কেলে)। বাংলাদেশে নিজেকে প্রমাণ করে সেই অভিজ্ঞতা ও কর্মসূচি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। দেশের প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জীবন রূপান্তরের ব্রত নিয়েছিলেন। আমরা দেখি, একই সঙ্গে তিনি নিজের জীবনকেও রূপান্তর করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ই তিনি বহুজাতিক কোম্পানি শেল অয়েলের অর্থ বিভাগের প্রধান হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত, তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে থাকলে সেখানেও সর্বোচ্চ পদে যেতেন। যে কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হওয়ার যোগ্যতা ফজলে হাসান আবেদের ছিল। তিনি সেই হাতছানি এড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা থেকেও তার প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক স্বতন্ত্র। তারা বিভিন্ন দেশে এক একটি কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে। কিন্তু ব্র্যাক বাংলাদেশের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের সব দিক নিয়েই কাজ করেছে। পরিবেশ নিয়েও কাজ করছে। একটি দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে দেওয়ার এ প্রত্যয় খুব কম আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার মধ্যেই রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতা আফগানিস্তানসহ অন্যান্য দেশেও প্রয়োগ করতে চেয়েছেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।

আমার কাছে ফজলে হাসান আবেদের যে দিকটি আরও গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে তুলে ধরার চেয়ে সব সময় প্রতিষ্ঠানকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এমন মানুষ কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বেও বিরল। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রস্থানের সময় হয়েছে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে ব্র্যাক ও এর বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে, তার সব ব্যবস্থা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে করেছেন। তিনি জীবনে যেমন, তেমনই মৃত্যুর পরও তার কর্ম সুচারু রাখতে চেয়েছেন।

ফজলে হাসান আবেদ ও তার মহৎ জীবনের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

 

অর্থনীতিবিদ; সভাপতি, সিপিডি