বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন’ উড়োজাহাজের দুই ইঞ্জিনের একটি প্রায় বিকল – ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Published in বণিক বার্তা on Tuesday, 17 April 2018

ডঃ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অর্থনীতিবিদ ও নীতি বিশ্লেষক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো। জাতিসংঘসহ জেনেভা ও ভিয়েনাস্থিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নসংক্রান্ত সংস্থা আঙ্কটাডের (ইউএনসিটিএডি) গভর্নিং বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আঙ্কটাড মহাসচিবের স্বল্পোন্নত দেশসংক্রান্ত বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। জেনেভায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সমন্বয়কও ছিলেন। আন্তর্জাতিক জার্নালে তার বহু গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন, প্রবৃদ্ধির গুণগত মান, আয় ও ভোগবৈষম্য বৃদ্ধি, সুশাসন সূচকের অবনতি, সামাজিক সুসঙ্গতির অভাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে এ অর্থনীতিবিদের কথা হয়।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

[সাক্ষাৎকারটি দুইটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। এটি সাক্ষাতকারের  প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে। ]

 

বলা হয় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। অথচ আমরা অনেক দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছি। উন্নয়নের এ বিশ্লেষণকে আপনি কীভাবে দেখেন?

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তিন দশক ধরে প্রতিটি দশকে ১ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি করতে আমরা সক্ষম হয়েছি, যা একটি অনন্য ঘটনা বটে। সাম্প্রতিক পাঁচ বছরে এটি আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। বাংলাদেশে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের কিছু লক্ষণও আমরা দেখেছি। চার দশক আগে বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ ছিল আমাদের দেশজ আয়ের প্রায় ৮ শতাংশের ওপর। এখন সেটা ২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। একসময় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশই যেত বিদেশী সংস্থাগুলোর দায়দেনা পরিশোধ করতে। এখন সেটা রেমিট্যান্স ও রফতানির মোট আয়ের ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। পাকিস্তান শাসনামলে আমাদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ ছিল, বর্তমানে তা আমরা ১ দশমিক ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছি। একটা সময় ছিল যখন দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দুবেলা আহারের ব্যবস্থা করা যেত না। এখন ১৬ দশমিক ২ কোটি মানুষকে তিনবেলা খাওয়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত দুই দশকে খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের অর্জন আছে আমাদের। পৃথিবীর বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ যেখানে প্রাথমিক পণ্য রফতানি করে, সেখানে আমরা সব রফতানি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ করছি। তাছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বড় ধরনের অর্জন রয়েছে। আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসছি।

এখন বিষয় হলো, উন্নতির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এ তুলনার মাপকাঠি কী? আমরা যদি অতীতের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আগের চেয়ে আমরা অনেক ভালো করেছি— এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তাহলে কোন দেশ ও কোন সময়ের সঙ্গে তুলনা করছি তা বিবেচ্য। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, তাহলে একটা সময়ে তাদের চেয়ে আমাদের মাথাপিছু আয় বেশি ছিল। এখন আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় মাথাপিছু আয়ে অনেক পিছিয়ে আছি। আবার আফ্রিকার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। আবার যদি সমসাময়িক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমরা ৩০ বিলিয়ন ডলার রফতানি করছি অথচ আমাদের চেয়ে ছোট দেশ প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে। এখানে তুলনীয় মাপকাঠিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশ যখন নিজেদের অর্জনকে বড় করে দেখাতে চায়, তারা দুর্বলতরদের সঙ্গে অথবা বিগত কালের সঙ্গে তুলনা করে।

আমরা যারা পেশাদার অর্থনীতি বিশ্লেষক, তারা বেশি গুরুত্ব দেই সম্ভাবনার কত অংশ রূপায়ণ করতে পারলাম আর কী সুযোগ রূপায়ণ করতে পারলাম না তার ওপর।

বাংলাদেশের এ উন্নয়নকে কি আমরা বিস্ময়কর বলব? বিস্ময়ের ব্যাপারটা উঠেছে এজন্য যে, নব্বইয়ের দশক থেকে বিদেশী দাতাগোষ্ঠী জোর দিচ্ছিল যে, সুশাসন যদি না থাকে তাহলে প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন তথা উন্নয়ন হবে না। বাংলাদেশের সুশাসনের সূচকগুলো খুব আশাব্যঞ্জক নয়, এটা সবাই জানে। তার পরও দুই দশক ধরে বাংলাদেশ ধাপে ধাপে বিভিন্ন ধরনের মানব উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু সুশাসনের সূচকে অনুরূপভাবে উন্নতি হয়নি। সুশাসন ছাড়া বাংলাদেশ কীভাবে উন্নয়নের সূচকে এগিয়েছে, এটাই বিস্ময়। কীভাবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি সাধন হলো! কীভাবে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ল! সুশাসন না থাকলে দুর্বল জনগোষ্ঠীর কাছে এগুলো পৌঁছানোর কথা নয়। দারিদ্র্য বিমোচন হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদিত হলো, এটাই বিস্ময়।

এক্ষেত্রে আপনার ব্যাখ্যা জানতে চাইছি—

এক্ষেত্রে তিন ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে। একটা হলো, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সুশাসনের যে সূচক দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের যে সূচকটি রয়েছে, সেটা যথোপযুক্ত কিনা? কিংবা সুশাসনের মূল ভূমিকাটি তারা ধরতে পারে কিনা? এখানে নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকা যদি যথাযথভাবে ধরা না হয়, তাহলে আমাদের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা ধরা সম্ভব হবে না। কারণ বাংলাদেশে সুশাসন কম থাকলেও সাধারণভাবে মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের জোরদার ভূমিকা পালন করে এসেছে, যেটা ওই সূচকে ধরা পড়ছে না। সুশাসনের ঘাটতির পরও উদ্যোক্তা শ্রেণী এক ধরনের ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ (পলিটিক্যাল সেটলমেন্টের) মাধ্যমে অর্থনীতি সচল রাখে। তাই প্রথম ব্যাখ্যাটা হলো, সূচকটির ভেতরে কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা। দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হলো, দেশের নিজস্ব কোনো বৈশিষ্ট্য আছে কিনা। ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি ‘কন্টেক্সচুয়াল পিকিউলারিটিস’। দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার দেশগুলো তুলনীয় কিনা, ঔপনিবেশবাদের যে অবশিষ্টাংশ রয়েছে, সেটা তারা কীভাবে করেছে, ওই দেশের ভেতরে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ক্ষেত্রেও যে মাত্রার তফাত রয়েছে, সেই মাত্রার পার্থক্যগুলোকে আমরা ধরতে পারি কিনা এ সূচকের মাধ্যমে। সে দেশের বৈশিষ্ট্য যেমন— শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্য ইত্যাদিও বিবেচনায় আনতে হবে।

তৃতীয়ত. সুশাসনের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও আমরা বেশ ভালো করছি। কিন্তু সুশাসনের সূচকটা যদি ভালো হতো তাহলে আমরা আরো অনেক ভালো করতাম, অনেক বেশি অবদান রাখতে পারতাম। আমরা বলি যে, দুর্নীতি যদি চলে যেত তাহলে বাড়তি ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতো। তবে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেত কি পেত না, এটা নিশ্চিত করে আমি বলতে পারব না। তবে যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সূচক সেটা হলো, কয়েক দশক ধরে মোটামুটিভাবে যে শোভন প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার ফলে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কতখানি উন্নয়ন হলো, তা দেখতে হবে। আমরা জানি যে, দেশে সাম্প্রতিককালে আয়বৈষম্য বেড়েছে ভোগবৈষম্যের চেয়ে বেশি। আর সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে আয়বৈষম্যের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ এখন একটা সন্ধিক্ষণে রয়েছে, সেখানে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ নিয়ে আলোচনা না করে প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। এখন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে আলোচনা করার মতো অর্জন বা ভিত্তি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, কেকটা আগে বড় করে তারপর ওটা কীভাবে কাটা হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে হয়। এখন আমরা বলতে চাই, কেকটা এমন একটা অবস্থায় এসেছে যে, এখন ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এটা বড় করার জন্য যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে, তার কাছে ওটা আমরা পৌঁছে দিতে পারছি কিনা, তা এখন আমাদের জন্য একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্যই সাম্প্রতিককালে যেটি আমাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে তা হলো, পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের খানা জরিপ। এর সঙ্গে রয়েছে সর্বশেষ শ্রম জরিপের ফলাফল। শ্রম জরিপে আমরা দেখছি, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু আগের মতো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। গত বছর আমরা যখন এটা বলেছি, তখন কেউ তা স্বীকার করতে চায়নি। এখন সরকারি তথ্য— যে তথ্য নিয়ে বহু সংশয়, বহু বিতর্ক রয়েছে— আমাদের দেখাচ্ছে যে, উপাদানের এককপ্রতি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আমরা দুর্বল হয়ে গেছি। তার মানে কোথাও প্রবৃদ্ধির অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রের পরিবর্তন আসছে এবং প্রশ্ন হলো, আগামীতে এটি কোন অবস্থায় যাবে। দেখতে হবে আগামীতে কোন খাতে আমরা প্রবৃদ্ধির জন্য জোর দেব। সেবা খাত প্রাধান্য পাচ্ছে, শ্রমঘন প্রক্রিয়াজাত খাতের দিকে বেশি মনোযোগী হচ্ছি না। এ প্রক্রিয়ায় নতুন প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, সে প্রযুক্তির কারণে কর্মসংস্থানের হার কমে যাচ্ছে কিনা।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে কিন্তু সে হার হয়তো এখন শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আপনি যত অবশিষ্টাংশের দিকে এগোবেন, তত এর হার কমবে। ২০ শতাংশকে ১০ শতাংশ করা যত সহজ, ৫ শতাংকে আড়াই করা তত সহজ নয়। বিষয় হলো, বাংলাদেশ সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে কিনা। তার পরও যে প্রশ্নটি থাকে তা হলো, দারিদ্র্য বিমোচনের হার যেভাবে কমছে, হতদরিদ্রদের অবস্থা সে অনুযায়ী বিমোচন হচ্ছে কিনা? এর পরে আসছে দারিদ্র্যের ভৌগোলিক চেহারা। এ ছোট দেশের মধ্যেও আমরা লক্ষ করছি, উন্নয়নের অসমতার মাধ্যমে এক ধরনের ভৌগোলিক বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে।

তৃতীয় যে বিষয়টি আরো বেশি আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে তা হলো, যত ভোগবৈষম্য বাড়ছে, তার চেয়ে দ্রুততর হারে আয়বৈষম্য বাড়ছে এবং তার চেয়ে আরো অনেক বেশি হারে বাড়ছে সম্পদের বৈষম্য। প্রশ্নটি আসছে, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চরিত্র কী? যার ফলে সবক্ষেত্রে এ রকম বৈষম্য বাড়ছে? বিষয়টি মারাত্মক। কিছু ব্যাখ্যা চটজলদি দিতে পারি। যেমন বড় ধরনের কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আর ওই লোকগুলোর কিছু নামই পানামা বা প্যারাডাইস পেপারসে রয়েছে। এরা সরকারকে নিয়ম অনুযায়ী কর দেয়নি, হয়তো টাকাটাই ছিল কালো, সরকারও গরিব মানুষের পক্ষে টাকা খরচ করতে পারেনি। হতে পারে, ব্যাংক থেকে যে প্রচুর পরিমাণে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে, সেই টাকা তাদের বৈভবকে আরো স্ফীত করেছে কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় সরকারি অতি অর্থায়িত প্রকল্পের তছরুপকৃত টাকা এটি।

এছাড়া আরো একটা বিষয় ঘটতে পারে। যেভাবে আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি, এ প্রবৃদ্ধির চরিত্রটিই এ রকম যে, এটা কেবল উচ্চবিত্ত মানুষদের আয় বৃদ্ধি করে না, তাদের সম্পদের পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। এ জায়গাটায় গভীর বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা প্রবৃদ্ধির গুনগত মান নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত নন। তারা এটাকে খুবই সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন। আমরা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি, পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যে দেশে বৈষম্য বাড়ে, সেই দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো দুষ্কর। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো এখানে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আয়বৈষম্য রয়েছে লাতিন আমেরিকার মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় এবং তারা ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদে’ আটকে থেকে উচ্চ আয়ের দেশ হতে পারছে না। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার যা বর্তমান, বাংলাদেশের ভবিষ্যতে তা হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমি বলব, যদি বাংলাদেশের ভবিষ্যেক দেখতে চান, তাহলে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর দিকে তাকান। ২০১০ থেকে ২০১৫— এ সময়কাল প্রবৃদ্ধির গুণগত মানের যে বিরাট অবনতি হয়েছে, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?

২০০৫ থেকে ২০১০ সাল সময়কালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্পদবৈষম্য, আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের হারে তেমন কোনো বড় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু ২০১০ পরবর্তী সময়কালে এ বৈষম্যগুলো দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ এবং ২০১০ থেকে ২০১৫— এ সময়কালে এ বৈষম্যের ভিন্ন চিত্র লক্ষণীয়। দুটো সময়কাল কিন্তু প্রায় একই সরকারের আমলে। আগের পাঁচ বছরের সঙ্গে পরের পাঁচ বছরের কী পার্থক্যটা হলো যে, বৈষম্য এই পরিমাণে বেড়ে গেল! বিষয়টিতে কিন্তু সরকারেরই দুশ্চিন্তা হওয়া উচিত, কারণ সরকারি তথ্যই বৈষম্য বাড়ার কথা বলছে। আমরা দেখছি, বর্তমানে নিম্নতম ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে বিত্তশালী ৫ শতাংশ মানুষের আয় ১২১ গুণ বেশি আর তা সম্পদের ক্ষেত্রে প্রায় ২ হাজার ১০০ গুণ! ফলে যে বিষয়টি সামনে আসছে তা হলো, বাংলাদেশের আগামী দিনের চেহারা কী? এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, সাধারণভাবে বাংলাদেশ কি ক্রমান্বয়ে এ বৈষম্যক্লিষ্ট, অসম সুযোগের সমাজে পরিণত হলো? পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর কি আরো তুলনামূলক প্রান্তিকীকরণ হবে? আরো চিন্তার বিষয় হলো, প্রবৃদ্ধিকে পরবর্তী ধাপে নেয়ার জন্য অর্থনীতিতে যে ধরনের কাঠামোগত ও নীতি সংস্কার দরকার, যে ধরনের গুণমানসক্ষম প্রতিষ্ঠান দরকার, তা আমরা করতে পারছি না।  ২০০৫ থেকে ২০১০ এবং ২০১০ থেকে ২০১৫— এ সময়কাল দুটোর পার্থক্যের একটা বড় ব্যাখ্যা হলো, প্রতিষ্ঠানিক অবক্ষয়। আর অন্য ব্যাখ্যাটি হলো, সমাজে বিকল্প মত প্রকাশের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে যাওয়া। এ পরিস্থিতি ও প্রবণতার পরিবর্তন না হলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রগতি নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।

স্মরণ করা যায়, নব্বইয়ের পর বেশকিছু সংস্কার হয়েছে। আমাদের ভ্যাট আদায়ে প্রচলিত টাকার ভাসমান বিনিময়হার পেয়েছি। ব্যক্তিখাতের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশকিছু ক্ষেত্রে আইন, নীতি ও প্রবিধানের সংস্কার করা হয়। ফলে অর্থনীতির ছাদটা একটু উঁচু হয়েছিল। আমরা নিচে থেকে উপরের দিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাই। সাম্প্রতিক কালে জায়গাটা আমরা ব্যবহার করে ফেলেছি বা নিঃশেষ করেছি। এখন যদি আমরা উপরে উঠতে চাই, তাহলে নীতি-প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের মাধ্যমে ছাদটাকে আরো উপরে তুলতে হবে। বৈষম্য বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি আমরা একটা বৈরী বৈশ্বিক পরিস্থিতির ভেতরে প্রবেশ করেছি। বর্তমান বিশ্বে উন্নয়ন সহমর্মিতা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য আগামীতে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার ফলে বাংলাদেশকে যে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তাকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুতির ব্যাপার রয়েছে। এক কথায় আমাদের বড় অর্জন আছে, গর্ব করার মতো সাফল্য আছে কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সেই অর্থনৈতিক সাফল্যগুলোর সুফল বিতরণ এবং সামাজিক ন্যায়নীতির বিষয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠছে। এবং এ কারণেই আগামী দিনের প্রবৃদ্ধির মাত্রা ও মান রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো স্বল্পমেয়াদি হয়। পাঁচ বছর ব্যাপ্তি ধরে একটি পরিকল্পনা করতে পারলেও তা ফলপ্রসূ হতে পারে, কিন্তু আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো হয় কয়েক মাসের জন্য—

বাংলাদেশের জীবনচক্রটা এখন অনেক পরিমাণে স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক চক্র দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়, সেহেতু কেউই ভবিষ্যতের জন্য সামাজিক প্রথা, রাষ্ট্রীয় নীতি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এ মনোভঙ্গিতে দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন চিন্তার সুযোগ কম। তবে অর্থনৈতিক বিষয়ে এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা দেখা যায়। আগে সরকার বদল হলে নীতি বদল হতো, তারপর সরকার বদল হলে নীতি ঠিক থাকত কিন্তু প্রকল্প বদল হতো। এখন নীতিও বদল হয় না, প্রকল্পও বদল হয় না; বদল হয়ে যায় ঠিকাদার।

বর্তমান অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিটা রেমিট্যান্স ও পোশাক শিল্পনির্ভর। ভবিষ্যতে এখানে আমরা বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হব। এটা যদি আমরা টিকিয়ে রাখতে না পারি, সেক্ষেত্রে কী ধরনের পরিণতি হবে?

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যাগুলোকে দুভাবে দেখা যায়। একটা হলো, কাঠামোগত মধ্যমেয়াদি সমস্যা। পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন বাজার সৃষ্টি করা, রফতানি পণ্য বৃদ্ধি, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এক ধরনের কাঠামোগত সমস্যা। অন্য সমস্যাটি হলো, স্বল্পমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যদি দুর্বল হয়ে যায়, রাজস্ব আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য না থাকে, সুদের হার বেড়ে যায় ইত্যাদি। সাম্প্রতিককালে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে চলতি হিসাব নেতিবাচক হয়ে গেছে। এর কারণ কি মধ্যমেয়াদি সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে, নাকি চলতি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা? আমরা বলছি দুটোই সঠিক। বাংলাদেশ নামক উড়োজাহাজটি এখনো এক ইঞ্জিন তথা সরকারি বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে, অপর ইঞ্জিন ব্যক্তিবিনিয়োগে রয়ে গেছে নিরুদ্যম। এক ইঞ্জিনে কি প্লেন ওড়ে?

প্রথমে এক পায়ে হাঁটার কথায় আসি। রফতানি ও রেমিট্যান্সের ওপর জোর দিয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করার চেষ্টা হচ্ছে। এখানে মূল প্রতিবন্ধক হলো, আমাদের প্রতিযোগিতাসক্ষম গুণগত মানসম্পন্ন মানবসম্পদ নেই। ডিগ্রিধারী লোক হলেই কেউ শিক্ষিত হয় না। এজন্য পোশাক শিল্পে দেশের বাইরে থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারী আনতে হচ্ছে। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, এটা কাঠামোগত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তবে মূল বিষয় হলো, রফতানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারের সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। এজন্যই প্রয়োজন বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি।

আরেকটা উদাহরণ দিই। উড়োজাহাজের প্রথম ইঞ্জিনের শক্তি ছিল সরকারি বিনিয়োগ। রাস্তাঘাট ইত্যাদি তৈরি হলো। দ্বিতীয় ইঞ্জিনের শক্তি বেসরকারি বিনিয়োগ। কিন্তু দশ বছর ধরে ব্যক্তিবিনিয়োগের একটা ইঞ্জিন প্রায় বিকল। তাহলে কীভাবে অগ্রসর হওয়া যায়। এটা কি স্বল্প, মধ্য, নাকি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা? বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি সমস্যাগুলো ক্রমান্বয়ে প্যাঁচ খেয়ে যাচ্ছে। যদি আগামী দিনের উন্নয়ননীতি চিন্তা করতে হয়, তাহলে অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী চিন্তা করতে হবে।

এখন যে বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী হচ্ছে, তারা ব্যক্তিখাতে, করপোরেট সেক্টরে চাকরি করছে। তারা কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে খুশি নয়। আবার সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংককে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নিজের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যও তাদের নেই। দেশের ভেতরে তারা একটা মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা চায়। একই সঙ্গে দেশের ভেতরে মানসম্পন্ন গণপরিবহন, মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চায়। নতুন এ চাহিদাটাকে বুঝতে হবে। কারণ নতুন এ চাহিদাই কিন্তু নতুন বাজার। কিন্তু আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়, সামাজিক পুঁজির অবক্ষয়, সেখানে নতুন বিকাশমান মধ্যবিত্তকে স্থান করে দেয়া সম্ভব হয় না। আগে বলা হতো, সর্বহারা হলো সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি। এখন নতুন তত্ত্ব হচ্ছে, বিকাশমান মধ্যবিত্ত সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি। এ মধ্যবিত্ত বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা রাখে, নিজের অর্জন সম্পর্কে আস্থাবান। সে কেবল বেতন পেয়ে শান্তি পায় না; সে কথা বলতে চায়, মতামত প্রকাশ করতে চায়, পৃথিবীর সঙ্গে তার অবস্থার তুলনা করতে চায়। এটিই হলো বাংলাদেশে আগামী দিনের বড় শক্তি। এ শক্তিটাকে স্বীকার করতে হবে। তাকে জায়গা করে দিতে হবে। বিকাশমান মধ্যবিত্তকে ধরে রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারভিত্তিক উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, সামাজিক পুঁজি ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশের সবচেয়ে বড়  ট্র্যাজেডি হলো, বিকাশমান মধ্যবিত্তকে সে সবসময় জায়গা করে দিতে পারে না। সে অপরিকল্পিত নগরায়ণ করে, আয় ও সম্পদবৈষম্য সৃষ্টি করে; গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারে না, ঠিকমতো অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে পারে না, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সে তার কথা বলার জায়গাটার প্রতিফলন দেখতে পায় না। আরব বসন্তের নেপথ্যেও ওই একই বিষয় কাজ করেছে। তাই বিকাশমান মধ্যবিত্তের রোষ থেকে সাবধান!

দুই যুগ ধরে সত্ভাবে ব্যবসা করে একজন ব্যবসায়ী যে অবস্থানে এসেছেন, এখন একটি ব্যাংক কিংবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে অনেকেই অল্প সময়ে সমপরিমাণ আয় করছেন—

ব্যক্তিখাতে পুঁজির মধ্যমেয়াদি সমস্যা হলো, তারা বিশ্বাস করে না যে, বাংলাদেশে একটি নিয়ম-নীতিভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা চালু থাকবে। মেধার ভিত্তিতে সে স্বীকৃতি পাবে। তারা বুঝে গেছে প্রভাব বলয়ের বা রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলেই কাজ হবে। এটা আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য খুবই ভুল সংকেত দেয়। একটা বাজার অর্থনীতি সঠিকভাবে গড়ে উঠতে হলে তার যেমন রাজনীতি দরকার, তেমনি দরকার নৈতিক ভিত্তি। এটি কিন্তু চতুর্থ উপাদান। আর নৈতিক ভিত্তিটা হলো, পরিশ্রম করলে আমি মূল্য পাব। আমি যদি মেধাবী হই, তাহলে দেশের কাজে লাগতে পারব। আমার উদ্যম, উদ্যোগ আমাকে সামনে নিয়ে যাবে। মেধা, সৃজনশীলতা, উদ্যম, উদ্যোগ— এগুলো বাধাগ্রস্ত হবে না। সামাজিক নিয়মনীতি এগুলোকে সমর্থন করবে। সমাজের ভেতরে যদি সততা, মেধার দাম না থাকে, তাহলে তা ঠিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারভিত্তিক সমাজের ভিত্তি হয় না; আদিম পুঁজি হরণের যুগে চলে যায়। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ব্যাকরণ বলে, এ প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে থাকার ফলে এমন একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে, যে দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অর্জনকে আবার খর্ব করে দিতে পারে।

[সাক্ষাৎকারটি দুইটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। এটি সাক্ষাতকারের  প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে। ]

 

শ্রুতিলিখন: রুহিনা ফেরদৌস

আলোকচিত্রী: এফ ওমর