Published in আলোকিত বাংলাদেশ on Thursday 2 January 2020
নতুন বছরে অর্থনীতিতে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জ
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, কর জিডিপি অনুপাত নেমে এখন দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক দুই শতাংশ। এর ফলে বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। একটা অর্থনীতি আট শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেখানে এত কম রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কর আহরণের পদক্ষেপগুলো নতুন বছরে আরও সক্রিয় করতে হবে। বলেন, ট্রেড ব্যালান্স এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে চাপ তৈরি হয়েছে। ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য সামাজিক সংকট তৈরি করছে। একইসঙ্গে তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানেও সুখবর নেই।
রাজস্ব খাতে সংস্কার দরকার : বাড়ছে চাহিদা; কিন্তু অর্থ সংস্থান নেই। তাই চাপে পড়ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। চলতি অর্থবছরের জন্য ধরা হয় উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা; যার আকার ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। যা জিডিপির ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। এর মধ্যে রাজস্ব রোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মূলত আয়কর, ভ্যাট এবং আমদানি-রপ্তানি শুল্ক থেকে রাজস্ব আদায় করে থাকে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এতে সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, ইএফডি যন্ত্র স্থাপন এবং কর কাঠামোতে সংস্কার প্রয়োজন।
ব্যাংক খাত : বছরজুড়েই ভুগিয়েছে আর্থিক খাতের অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংক খাত। খেলাপি ঋণের রেকর্ড, নয়ছয় নীতিতে কালক্ষেপণ, এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণসহ নানা কারণে এ খাত নিয়ে বিব্রতকর অবস্থানে ছিল সরকার। চলতি জানুয়ারি থেকে এক অঙ্ক সুদহার কার্যকরের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে সেটি আবার পিছিয়ে এপ্রিলে কার্যকরের ঘোষণা আসে। এখন আদৌ এটি বাস্তবায়ন হবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণও নতুন বছরের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
রপ্তানি আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই : ক্রমান্বয়ে কমছে রপ্তানি আয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রপ্তানি আয় কমছে কয়েক মাস ধরেই। তবে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের রপ্তানি বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে রপ্তানি আয় বাড়লেও এর পর টানা চার মাস ধরে রপ্তানি আয় কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। এর মধ্যে সর্বশেষ নভেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১৮ সালে নভেম্বরে আয় হয়েছিল ৩৪২ কোটি ১৯ লাখ ডলার। সদ্য বিদায়ি নভেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩০৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের রপ্তানি খাতে কোনো সংকট তৈরি হলেই প্রণোদনা দেয়া হয়; কিন্তু সার্বিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ দরকার : নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাড়ছে না ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ। ব্যবসা সহজীকরণ এবং অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। গেল ছয় বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। ব্যবসায়ীদের অন্যতম শীর্ষ সংগঠন বলছে, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে নীতিমালা ও সংস্কার জরুরি।
আস্থায় নেই পুঁজিবাজার : সদ্য বিদায়ি বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে দরপতন ছিল চোখে পড়ার মতো। টানা দরপতনে ডিএসইর প্রধান সূচক আগের ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে যায়। গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক ৪ হাজার ৪১৮ পয়েন্টে নেমে আসে। এটি ২০১৬ সালের ২৭ জুনের পর সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। টানা দরপতনের কারণে চলতি বছরে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৯৬৭ পয়েন্ট। একই সময়ে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে ৪৮ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। বিনিয়োগের অন্যতম বড় এ উৎস এখন নিষ্ক্রিয়। পুঁজিবাজার আস্থায় আনাও ২০২০ সালের বড় চ্যালেঞ্জ।
বাড়ছে মূল্যস্ফীতির পারদ : বেশ কয়েক মাস কমতির দিকে থাকা মূল্যস্ফীতির পারদ আবার বাড়ছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালের শেষে এসে পেঁয়াজই উসকে নেয় সার্বিক মূল্যস্ফীতিকে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পেঁয়াজের দর কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। পাশাপাশি চাল, সবজিসহ নিত্যপণ্যের দর এক ধরনের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ফলে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছেন দেশবাসী। গেল বছরের নভেম্বর মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ হয়েছে। এর আগে অক্টোবরে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এছাড়া বাড়িভাড়া, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন, শিক্ষা উপকরণ এবং বিবিধ সেবা খাতের মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। নভেম্বর মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে; যা এর আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে প্রান্তিক মানুষদের সংকট বাড়বে।