Published in কালের কন্ঠ on Wednesday 5 August 2020
এবারও কাঁচা চামড়া নিয়ে কারসাজি, লাভ কার
চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এ ছাড়া সেল গঠন, কাঁচামাল সরবরাহ লাইনে নজরদারির ব্যবস্থা করেছে। দিয়েছে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ। এত কিছুর পরও গত বছরের মতো এবারও নৈরাজ্য ঠেকানো যায়নি। মূলত আড়তদাররা একজোট হয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন। যদিও তাঁরা দোষ চাপাচ্ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ওপর। আড়তদাররা এবারও ট্যানারি মালিকদের দোষারোপ করছেন। অন্যদিকে ট্যানারি মালিকরা দুষছেন আড়তদার বা মধ্যস্বত্বভোগীদের।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, চামড়া কেনার জন্য সরকার ৬০০ কোটি টাকা তহবিল দিলেও তাঁরা ব্যাংক থেকে পেয়েছেন মাত্র ১২০ কোটি টাকা। ব্যাংকের এমন অসহযোগিতার ফলে বাজারে নগদ টাকার ঘাটতি হয়েছে। ফলে দেশের মূল্যবান চামড়া এবারও নষ্ট হয়েছে।
চামড়া খাতসংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফড়িয়া ও আড়তদারসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে দেশের চামড়াশিল্প জিম্মি হয়ে পড়েছে। ফলে এবারও গরিব আর এতিমের হক কাঁচা চামড়া ময়লার ভাগাড়ে গেছে।
আড়তদারদের সূত্রে জানা গেছে, এবার গত বছরের তুলনায় ৩০-৩৫ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে। গরম, পুঁজির অভাব ও অতি মুনাফার লোভে নষ্ট হয়েছে ১৫ শতাংশ গরুর চামড়া; আর খাসি বা ছাগলের চামড়া নষ্ট হয়েছে ৯০ শতাংশ। তবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, গড়ে ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে।
জানা যায়, প্রতিবছর দুই কোটি ২৫ লাখ পশুর চামড়া হয়। এর মধ্যে কোরবানির সময় পাওয়া যায় এক কোটি ২০ লাখ থেকে এক কোটি ২৫ লাখ চামড়া। এ বছর ৮০ লাখ থেকে ৯০ লাখ পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে সংগ্রহ করা গেছে ৭০-৮০ লাখ পিস চামড়া।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতা মো. রবিউল কালের কণ্ঠকে বলেন, কোরবানিদাতা এবং মাদরাসা ও এতিমখানা বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। এই সব প্রতিষ্ঠানের সারা বছরের অর্থের জোগান আসে কোরবানির চামড়া থেকে। তিনি বলেন, এবারের কোরবানিদাতারা পশুর চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। কেউ কেউ বিক্রি করলেও গরুর চামড়া প্রতিটি সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করতে পেরেছেন। চামড়া গেছে মসজিদ-মাদরাসা ও এতিমখানায়। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এসব চামড়া কিনে আড়তে বিক্রি করতে পেরেছেন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। আর লোকসান হবে বলে ছাগলের চামড়া কেনেননি আড়তদাররা।
ঈদের পরে দুই-তিন দিন রাজধানীর পোস্তায় কাঁচা চামড়ার আড়তে গিয়ে আড়তদারদের বিরুদ্ধে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। সারা দেশ থেকে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী পোস্তার আড়তে চামড়া নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও চামড়া বিক্রি করতে পারেননি।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জানান, আড়তদাররা একজোট হয়ে দাম কমিয়েছেন। কালক্ষেপণের মাধ্যমে চামড়া পচিয়েছেন।
তবে আড়তদাররা দাবি করেন, আট থেকে ১০ ঘণ্টা রোদ এবং গরমে থাকার ফলে চামড়ার গা থেকে লোম খসে গেছে। চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। ওই সব চামড়া তাঁরা ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছেন।
নরসিংদীর রহমতউল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা পরে নেবে বলে আড়তদার তাঁকে বসিয়ে রাখেন। নেওয়ার সময় দাম বলেছেন প্রতিটি গরুর চামড়া মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা, যেখানে প্রতি চামড়ায় খরচ পড়েছে ২০০-৩০০ টাকা। দাম না পেয়ে তিনি চামড়া ফেলে দিয়ে চলে গেছেন।
রাজশাহী থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সেখানে ছাগলের চামড়া প্রতিটি ৫-৩০ টাকা এবং গরুর চামড়া ১০০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অনেকে আড়তে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে পদ্মা নদীতে ফেলে দিয়েছেন।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, শহরের বেলঘরিয়া চামড়ার আড়তে গরুর চামড়া প্রকারভেদে প্রতিটি ১০০-৬০০ টাকা দরে এবং খাসির চামড়া ১০-৩৫ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। আড়তের সামনে চামড়া ফেলে চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, একেকটি গরুর চামড়া ২০-৩০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। অনেকে সড়কে ফেলে চলে গেছে। এ সুযোগে একটি মহল চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে মজুদ করে রেখেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্যানারির মালিকদের কাছে ১৫৩ কোটি টাকা পান আড়তদাররা। দিয়েছেন মাত্র ১০ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা। অর্থ সংকটে চামড়ার বাজারে এমন ধস নেমেছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিছিন্ন দুই-একটি ঘটনা ছাড়া প্রায় সব চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁর দাবি, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অসতর্কতার ফলে চামড়া নষ্ট হয়েছে। তবে প্রতিবছরই গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়।
শাহিন আহমেদ বলছিলেন, ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ আড়তদারদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তাঁরা ট্যানারি মালিকদের কাছে ১২০ কোটি পান। তিনি বলেন, এবার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক থেকে পেয়েছেন ১২০ কোটি টাকা। গতবার পেয়েছিলেন ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা।
বিটিএ সূত্রে জানা যায়, সরকার চামড়া কেনার জন্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকার তহবিল দিলেও এসব টাকা থেকে ২০ বছরের পুরনো ঋণ সমন্বয় করেছে ব্যাংক।
কাঁচা চামড়ার দামে ধস ঠেকাতে সরকার শেষ সময়ে কাঁচা চামড়া বা ওয়েট ব্লু রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। ফলে রপ্তানি হবে কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এই মুহূর্তে রপ্তানির বাজার বন্ধ। গত বছরের তিন হাজার কোটি টাকার চামড়াও পড়ে আছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পরামর্শ ছিল ওয়েট ব্লু (পশম ছাড়ানো চামড়া) রপ্তানির সুযোগ দিতে হবে। সরকার প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। একেবারে শেষ সময়ে এসে সুযোগ দিয়েছে। ঘোষণাটি আরো আগে দেওয়া হলে দেশের ভেতর কাঁচা চামড়ার চাহিদা আরো বাড়ত।’ আগামীতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে কাঁচা চামড়া রপ্তানির বিষয়ে আগে থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে যোগাযোগসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধাণের বিষয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে চামড়ার দাম না কমিয়ে আগের মূল্য রাখলেই ভালো হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ কালের কণ্ঠকে বলেন, গত দুই বছর ধরে দেশে কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে বিশৃঙ্খলা চলছে। সরকার দর নির্ধারণ করে দিলেও সেটা মানছে না কেউ। সরকারের নানা উদ্যোগ থাকার পরও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। কৃষকদের ধান ও পাটের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে যেমন সরকারের উদ্যোগ আছে, একইভাবে চামড়ার ব্যাপারেও উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের মূল্যবান এই সম্পদ রক্ষায় সুশাসন, নজরদারি ও যথাযথ আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।