Originally posted in ভোরের কাগজ on 21 June 2022
প্রবাসীদের পাঠানো আয়ে খরা চলছে। বিভিন্ন ছাড় ও নানা সুবিধার পরও আশানুরূপভাবে বাড়ছে না এ সূচকের প্রবাহ। দেশে চলতি জুনের প্রথম ১৬ দিনে ৯৬ কোটি ৪১ লাখ বা ৯৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৩ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ৮ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে মাসের শেষে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১৮০ কোটি ডলার হতে পারে।
বাংলাদেশে গত এপ্রিলে ঈদ উল ফিতরের সময় প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়লেও এরপরই মে মাসে তের শতাংশ কমে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সরকারের রেমিট্যান্স অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রথম এগার মাসে অর্জিত হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এরই মধ্যে সরকার ৫ লাখ টাকার ওপর পর্যন্ত প্রবাসী আয়ে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাওয়ার শর্ত শিথিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতদিন ৫ লাখ টাকার বেশি আয় পাঠাতে সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট দিতে হতো বলে অনেকেই বেশি পরিমাণ অর্থ পাঠাতে পারতেন না। কিন্তু শর্ত শিথিলের কারণে এখন থেকে কোনো নথিপত্র ছাড়াই অর্থ পাঠালে প্রণোদনা পাবেন তারা।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, কোভিড পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ আসার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে কোভিড পরিস্থিতি উন্নতির পরপরই দেশে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল অনেক। এমনকি রপ্তানি ব্যয় ও রেমিট্যান্স দিয়ে সে ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের দাম দ্রুত বাড়তে থাকায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কম অর্থ পাঠাচ্ছিলেন।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, নগদ যে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে সেটি যোগ করার পরেও ফরমাল চ্যানেলের সঙ্গে বেশ কিছুটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। সেটাই হয়তো বড় কারণ হতে পারে। অন্যদিকে কোভিড পরিস্থিতির উন্নতির পর গত অক্টোবর থেকেই দেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণ বেড়েছে। লোকজনের আসা যাওয়া বেড়ে যাওয়ায় অনেকে নগদ অর্থ হাতে হাতে পাঠানোর সুযোগ নিতে পারছেন। মূলত এভাবে আসা অর্থই কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে টাকায় রূপান্তর করা হয় এবং সেখানে এখন ডলারের দাম ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে অনেক বেশি।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এটি আগে থেকেই বলা হচ্ছিল যে নন ফরমাল চ্যানেলে অর্থ আসা বেড়ে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দর ৮৪ টাকা বাড়িয়ে ৮৯তে এনেছে- এটা ঠিক। কিন্তু তারপরেও কার্ব মার্কেটে হয়তো মানুষ বেশি টাকা পাচ্ছে। সেজন্য ফরমাল চ্যানেলে টাকা আসা হয়তো কমেছে, বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, রেমিট্যান্স কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। আশা করছি, প্রবাসী অর্থ আসা শিগগিরই আবার আগের ধারায় চলে আসবে। রেমিট্যান্স একই গতিতে আসে না। ঈদের সময় বেশি আসে। সামনে আবার বেশি আসবে। এটি ব্যতিক্রম কোনো ব্যাপার নয়।
দেখা গেছে, বর্তমানে এক ডলার রেমিট্যান্সের বিপরীতে ব্যাংক ৯৩-৯৪ টাকা দিচ্ছে। সঙ্গে যোগ হচ্ছে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। সব মিলিয়ে গ্রাহক ৯৫ থেকে ৯৬ টাকা পান। কিন্তু খোলাবাজারে ডলার ৯৭ থেকে ৯৮ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে ভিন্নপথে রেমিট্যান্স আসলে বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে। যার কারণে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম। তাই ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলারের রেটের ব্যবধান না কমলে প্রবাসী আয় বাড়ানো কঠিন হবে।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যাংকারদের সঙ্গে আলোচনা করে মাসের শুরুতে মার্কিন ডলারের রেট বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন প্রতিযোগিতামূলক দর নির্ধারণ করছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, জুনের প্রথম ১৬ দিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৫১ লাখ মার্কিন ডলার। আর বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার।
চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১৯ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। এরপর ডাচ্–বাংলা ব্যাংক ৮ কোটি ২১ লাখ, অগ্রণী ব্যাংকে ৬ কোটি ৯২ লাখ ও সিটি ব্যাংক ৬ কোটি ১৪ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার প্রবাসী আয়। আলোচিত সময়ে সরকারি বিডিবিএল, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংক বিদেশি ব্যাংক আল-ফালাহ, হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ, আগস্টে ১৮১ কোটি, সেপ্টেম্বরে ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ, অক্টোবরে ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ, নভেম্বর ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ, ডিসেম্বরে ১৬৩ কোটি এবং জানুয়ারিতে এসেছে ১৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে আসে ১৪৯ কোটি ৪৪ লাখ, মার্চে পাঠিয়েছিল ১৮৫ কোটি ৯৭ লাখ, এপ্রিলে ২০১ কোটি ৮ লাখ, মে মাসে ১৮৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলার এসেছে।
এর আগে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের পুরো সময়ে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন ছিল। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে।