Published in দৈনিক সংগ্রাম on Tuesday 28 July 2020
কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে চলছে চরম নৈরাজ্য
নীতি সহায়তা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে পশুর চামড়ার দাম তলানিতে এসে ঠেকেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাত বছরে চামড়ার দাম কমেছে ৫৬ শতাংশ। কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে চলছে চরম নৈরাজ্য। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে গতবছর। বিক্রি করতে না পেরে পশুর চামড়া নদীতে ফেলে দেওয়া ও মাটির নিচে পুতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। আসন্ন কুরবানির ঈদে পশুর চামড়া নিয়ে শঙ্কা আরও প্রকট হয়েছে। গত বছরের তুলনায় দাম কমানো হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। চামড়ার দাম না থাকলেও চামড়াজাত পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। বিগত সাত বছরে চামড়াজাত পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০০ শতাংশেরও বেশি। বর্তমানে চামড়াজাত পণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন কোনো পণ্যের উৎপাদনের দাম কমে যায়, ওই পণ্যটিরও দাম কমা উচিত। এখানে চামড়ার কাঁচামালের দাম কমলেও, তৈরি পণ্যের যে দাম কমছে না, এ ক্ষেত্রে একটি সংগতির অভাব রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রস্তুতকৃত (ফিনিশড) চামড়ার দাম কমছে, এমন অজুহাতে গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম কমাচ্ছে সরকার। গত বছর কাঁচা চামড়ায় বিপর্যয়ের পর এবারও ব্যাপক হারে কমানো হলো দাম। আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে এবার ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সম্প্রতি অনলাইনে জুম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে চামড়া ব্যবসায়ীদের বৈঠকে এ দাম ঘোষণা করা হয়। এর ফলে সাত বছরের ব্যবধানে লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম কমলো ৫৬ শতাংশ। ঘোষণা অনুযায়ী, আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া ১৩-১৫ আর বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা।
বছরভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালে কুরবানির গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। পরের বছর একবারে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে ৫০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০১৬ সালে এই চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালে আবারও কমিয়ে তা ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। তবে ২০১৯ সালে এই দর অপরিবর্তিত থাকলেও চামড়া ব্যবসায়ীরা তা মানেননি। গরিব ও এতিমদের হক চামড়ার দাম নিয়ে গত বছরের কারসাজি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ৩১ বছরের মধ্যে গতবার কুরবানির ঈদে কাঁচা চামড়ার দরে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় নেমে আসে। দাম না পেয়ে অনেকেই ক্ষোভে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন। এমন পরিস্থিতিতে এবার গরুর চামড়া গত বছরের চেয়ে ২৯ শতাংশ কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। খাসির চামড়ার দামও গত বছরের চেয়ে ২৭ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে চামড়ার দাম কম। তবে চামড়াজাত পণ্যের দাম তিনগুণ বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে কম দামে পৃথিবীর কোথাও চামড়া পাওয়া যায় না। এছাড়া কুরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে দেড়-দুই শত টাকা বা আরও কমে। অথচ জুতা-স্যান্ডেল, হ্যান্ডব্যাগ কিনতে চলে যাচ্ছে মানভেদে তিন থেকে সাত হাজার টাকা। কাঁচামালের সস্তা ও সহজলভ্যতার সুফল সাধারণের মাঝে পৌঁছাচ্ছে না। শুধু যে চামড়া খাতে এ রকম তা নয়, অন্য ব্যবসাতেও একই ধরনের অবস্থা। পশুর ক্রয়মূল্যের সঙ্গে চামড়ার দাম নির্ধারণের সামঞ্জস্য কোনো তত্ত্ব নেই। আর চামড়ার সঙ্গে জুতা-ব্যাগ বিক্রির মূল্যের সঙ্গতির অভাব তো রয়েছে।
চামড়াজাত পণ্যের এক তৃতীয়াংশের চাহিদা আছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। উদ্যোক্তা বরাবরই উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে মুনাফা হাতিয়ে নেয়ার জন্য দোষারোপ করে থাকে। স্তরভিত্তিক মূল্য সংযোজন হয় বটে, কিন্ত তা গ্রাহক পর্যায়ে অতিমাত্রায় অস্বস্তি এনে দেয়। চামড়াজাত পণ্যের বাজার অনেকটা পোশাক খাতের মতো। একজোড়া জুতার রফতানি মূল্য ২০ ডলার হলে, বিদেশের দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে একশ’ ডলারে। বিজ্ঞাপন, দোকানের খরচ, কর্মী ব্যয় ও ব্যবস্থাপনার নামে হাতিয়ে নেয়া হয় বিপুল পরিমাণ মুনাফা।
কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। দেশে ১৫০ কোটি ডলারের চামড়া পণ্যের বাজার রয়েছে। কোম্পানি ভেদে পণ্যের মূল্যে রকমফের থাকলেও, তাদের কারও পণ্যেই কাঁচামালের এ দরপতনের প্রভাব দেখা যায় না। কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবসময়েই পার্থক্য থাকবে। কিন্তু সেটা যৌক্তিক হচ্ছে কিনা, বাংলাদেশে সেরকম নজরদারি নেই। একবার কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীরা তা আর কমাতে চান না। এখন আবার বিদেশি ক্রেতারা নতুন শর্তজুড়ে দিয়েছেন। কয়েকটি স্থানীয় ব্র্যান্ডের জুতা বিদেশিরা কিনছে। কিন্তু তাদের শর্ত অনুযায়ী এসব পণ্য তৈরি করতে হলে তাদের পছন্দমতো দেশ থেকে চামড়া কিনে আনতে হবে। এক্ষেত্রে কোথায় থেকে চামড়া কিনতে হবে সেই দেশের নাম ও কোম্পানির নামসহ বলে দেয়া হয়। এ কারণে এসব বড় বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশের চামড়া কাজে লাগাতে পারছে না। চামড়ার দাম তলানিতে নামলেও জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগের মতো চামড়াজাত পণ্যের মূল্য এখনো চড়া রয়েছে, এর দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। কেন কাঁচামালের দরপতনের পরও এসব পণ্যের এত চড়া দাম? যখন কুরবানির চামড়া প্রায় পানির দরেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, তখনো দোকান থেকে চামড়ার পণ্য কিনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে। গতবছর কুরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ২০০ টাকায়। এর বেশি কেউ দাম দেবে না। যখন দোকান থেকে জুতা-স্যান্ডেল কিনেছি, কোনোটাই চার-পাঁচ হাজার টাকার নিচে কিনতে পারছেনা ক্রেতারা। আরিফ নামের এক ক্রেতা বলেন, এত সস্তায় চামড়া কিনে, সেটা দিয়ে জিনিসপত্র বানিয়ে এত বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে কেন? একজন ক্রেতা হিসেবে আমার তো মনে হচ্ছে, আমি বৈষম্যের শিকার হচ্ছি।
ঢাকায় বর্তমানে ভালো একটি দোকানে চামড়া দিয়ে তৈরি এক জোড়া জুতার দাম তিন থেকে আট হাজার টাকা। কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি পণ্যের দামের এত পার্থক্যের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের ফিনিশড লেদার ও লেদারসামগ্রী প্রস্তুতকারক সমিতি বলছে, কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি হওয়া পণ্যের দাম মেলানো যাবে না। বিশেষ করে চামড়ার মতো কাঁচামাল অনেক হাত ঘুরে আমাদের কাছে আসে। এখন যে চামড়াটা আপনি ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলছেন, সেটা কিন্তু আমাদের কাছে আসতে দর অনেক বেড়ে যায়। আমরা সরকারি রেট অনুযায়ীই কিনছি। এর সঙ্গে সেটাকে প্রসেস করা, কারখানা ও শ্রমিক খরচ যোগ হবে। তিনি বলেন, এরপর সেই প্রসেসড চামড়াটা আরেকজন কিনে নিয়ে দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী সেটা দিয়ে জুতা, স্যান্ডেল বা ব্যাগ তৈরি করবে। তার কাছ থেকে সেসব ব্র্যান্ড এসব পণ্য কিনে নিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করে। তিনি জানান, বাংলাদেশে এখন প্রায় দেড় বিলিয়ন কোটি টাকার চামড়াজাত পণ্যের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি।
গবেষকরা বলছেন, কাঁচামালের সঙ্গে তৈরি পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সব সময় পার্থক্য থাকবে। কিন্তু সেটা যৌক্তিক হচ্ছে কি না, বাংলাদেশে সে রকম নজরদারি নেই।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশের বাজারে একবার কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ব্যবসায়ীরা তা আর কমাতে চায় না। বাজারের অন্যান্য খরচ কমলেও সেটার দাম আর কমে না। আমাদের ভোক্তাদের অধিকার না থাকার কারণে পণ্যের উৎপাদকরা যে দাম নির্ধারণ করে, সেটাই গ্রহণ করতে হয়। তাদের উৎপাদন খরচ কমল কি না, সেটা আর যাচাই করা হয় না। সেটা শুধু চামড়াজাত পণ্য নয়, অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, যখন কোনো পণ্যের উপাদানের দাম কমে যায়, ওই পণ্যটিরও দাম কমা উচিত। এখানে চামড়ার কাঁচামালের দাম কমলেও, তৈরি পণ্যের যে দাম কমছে না, এ ক্ষেত্রে একটি সংগতির অভাব রয়েছে। ভোক্তাদের তাদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং ভোক্তা অধিকার আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ পার্থক্য কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে কয়েক বছর ধরেই চামড়া খাতের রপ্তানি আয় একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও চামড়া জুতার রপ্তানি আয় ছিল ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় নেমে আসে প্রায় ১০২ কোটি ডলারে। আর করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে সর্বশেষ হিসাব বছরে এ খাতের আয় ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফিনিশড চামড়া রপ্তানি থেকে আয় ছিল ৫০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এরপর থেকে প্রতি বছরই চামড়ার রপ্তানি কমছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ফিনিশড চামড়ার রপ্তানি আয় ৩৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৮ কোটি ৩১ লাখ ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ৯ কোটি ৮৩ লাখ ডলারে নেমে আসে। গত সাত বছরে ফিনিশড চামড়ার রপ্তানি আয় ৮০ দশমিক ৫৫ শতাংশ কমেছে।