Published in বণিকবার্তা on Friday 10 January 2020
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের অনেক স্মৃতি আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান পরস্পরের সঙ্গে নানা সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৫ সাল দীর্ঘ ১৮ বছর তাঁদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সাংবাদিক রঞ্জন মল্লিক
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় এবং সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে কীভাবে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেন?
রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ১৯৫৭ সাল থেকে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন প্রথমবার দেখা হলো, তখন তিনি আতাউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। কিছুদিন পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মাধ্যমে মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে গেল। তারপর একদিন ড. কামাল হোসেন আমাকে ডাকলেন, বললেন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিন। তখন আমি যতটা পারি কাজ করি। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো কী হবে, তা তৈরির ব্যাপারে সহযোগিতার দরকার ছিল। ওই সময় আমার বয়স বেশি ছিল না। তারপর তো ১৯৭০ সালে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, আমি, আনিসুর রহমান ও তাজউদ্দীনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ইলেকশন ম্যানিফেস্টো প্রিপারেশনে ব্যস্ত ছিলাম। আওয়ামী লীগের ইলেকশন ম্যানিফেস্টো আমরা চার-পাঁচজন মিলে তৈরি করলাম।
তারপর তো মার্চ ১৯৭১-এ আলাপ-আলোচনা, প্রিপারেশন, নিগোসিয়েশন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওই সময় আমি, নুরুল ইসলাম, আনিস রাজনীতির কঠিন বাস্তবতায় নানা কাজে যুক্ত ছিলাম। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে আমরা আলাপ-আলোচনা করে সব কাজের সিদ্ধান্ত নিতাম।
স্বাধীনতার পরে তো আরেকটা প্রফেশনাল সম্পর্ক শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করলেন। পরদিন, নেক্সডে ১১ জানুয়ারি অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা হলো। তিনি অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে ডেকে বললেন, আমি তোমাকে ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছি, প্ল্যানিং কমিশনে। তোমরা বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশন তৈরির কাজ শুরু করো। ওই কমিশনে আমাকে মেম্বার করা হলো। এটা তো ছিল একটা প্রফেশনাল সম্পর্ক।
তো আমি একটা বিশেষ সম্পর্কের কথা বলব, তিনি তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, টোটালি পাওয়ারফুল ম্যান। অত ক্ষমতা, কত পপুলারিটি, কত অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশে দ্বিতীয় কোনো লোক তার (বঙ্গবন্ধু) ধারেকাছে ছিলেন না। তিনি প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাজ এ প্রাইম মিনিস্টার হিসেবে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ডেপুটি চেয়ারম্যান আর আমি মেম্বার হিসেবে নিয়োজিত হই। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমি প্ল্যানিং কমিশন থেকে রিটায়ার্ড করে বিআইডিএসে চলে যাই। প্ল্যানিং কমিশনে যতদিন ছিলাম, আমি স্বাধীনভাবে কাজ করি। বঙ্গবন্ধু কখনো আমাকে কোনো ব্যাপারে রিকোয়েস্ট করেননি। চাপ দেননি, বলেননি অমুককে চাকরি দিতে হবে, এটা আমার আদেশ, কখনো ইনফ্লুয়েন্স করেননি, এ কাজটা করতেই হবে অর্থাৎ কাজে একটা ডিসিপ্লিন ছিল। বঙ্গবন্ধু অফিশিয়ালি ডেপুটি চেয়ারম্যানের (অধ্যাপক নুরুল ইসলাম) সঙ্গে কথা বলবেন, আলোচনা করবেন, কিন্তু কখনো আমার ডিসিশন মেকিংয়ের মধ্যে তার ইন্টারফেয়ার ছিল না। তিনি নতুন লোক রিক্রুট করেছেন। ওই সময় প্রথম অবস্থায়, নতুন প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে ৩০০-৪০০ লোক নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু কখনো ডাইরেক্টলি বা ইনডাইরেক্টলি তার (বঙ্গবন্ধুর) রিকোয়েস্ট আসেনি। এটা তো আন-ইমাজেবল। তিনি এভাবে ইনস্টিটিউটকে রেসপেক্ট করতেন। আমাকে দায়িত্ব দেন এবং বলেন কাজ করে যাও। এটা আমার মনে আছে। আরেকটা বিষয় আমার মনে আছে। তিনি খুব বড় মাপের মানুষ ছিলেন, তার মন বড়, তার হার্ট আরো বড়, আর তিনি কত পাওয়ারফুল মানুষ কিন্তু জেনুইনলি একটা হিউম্যানিটি ছিল, ভদ্রতা ছিল। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। এত বড় মাপের নেতা, আকাশি লোক, তিনি মানুষকে দেখছেন খুব আপন করে। যেমন তুমি একটা সাধারণ লোক, তোমার সঙ্গে দেখা হলো, আবার ১০ বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা হলো হি উইল রিমেম্বার ইউর ফেস, অ্যান্ড ইউর নেম। আমার জীবনে অনেক বড় নেতাকে আমি দেখেছি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এমন আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল নেতা দেখি নিই। যে তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সমর্থন দিয়েছেন, যে তার পলিটিক্যাল ক্যারিয়ারের ইনস্পিরেশন ছিল, তাঁর প্রতি বঙ্গবন্ধুর খুব রেসপেক্ট ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার মেন্টর ছিলেন। কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন চিফ মিনিস্টার ছিলেন, কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সবসময় ডাকতেন বস বলে।
আমার মনে আছে ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তার জন্মদিন হলো, এটা তো বিশেষ একটা দিন। বঙ্গবন্ধু তো মৃত্যুমুখ থেকে ফেরত এসেছেন, স্বাধীন দেশ, তার ইন্সপেরেইশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তিনি তো এখন সাধারণ লেভেলের লোক নন। তিনি তো এখন আকাশি মানুষ। (উল্লেখ্য, আকাশি মানুষ বলতে রেহমান সোবহান বুঝিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানের হাইট বা উচ্চতা তখন আকাশচুম্বী। তিনি তখন সাড়ে সাত কোটি লোকের নেতা। )
প্রাইম মিনিস্টারের অফিস তখন হেয়ার রোডে, ওই বেইলি রোডের কোনায় ছিল। দেশ স্বাধীনের প্রথম কয়েক বছর ওখানেই প্রাইম মিনিস্টারের অফিস ছিল। ওই সময় তো সিকিউরিটি বলতে কিছু ছিল না। যেকোনো লোক ফুটপাত থেকে চলে এসেছে, বলে তো আমি একটু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে আসি। ঢুকে যেত এখানে কোনো বাধা নেই। হাজার লোক ওইদিন ফুল নিয়ে এসেছেন, দেখা করবে, ফুল দেবে বঙ্গবন্ধুকে, তার জন্মদিনে, সম্মান জানাবে। এভাবে সারা দিন চলে। তো দিনের শেষে এক-দুই মণ ফুল হবে প্রাইম মিনিস্টারের কার্যালয়ে। যখন মোটামুটি মেইন ক্রাউড চলে গেছে, ওটা তো ফাল্গুন মাস ছিল, আজকাল তো গরম পড়ে, ওই সময় এত গরম ছিল না। বঙ্গবন্ধু তার এডিসিকে নিয়ে সব ফুল নিয়ে, একগাদা ফুল নিয়ে তিন নেতার মাজার হাইকোর্টের পাশে যান। এবং সব ফুল সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মাজারের ওপর দিয়ে আসেন। সেখানে কোনো নিউজ পেপারের রিপোর্টার ছিল না। কোনো টিভি-ক্যামেরা ছিল না। পাবলিসিটি ছিল না। তাঁর চিন্তার গভীরতা ছিল। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে ছিল I must remember and respect who launched me politics. তিনি এ মাপের মানুষ ছিলেন। আমার মনে আছে, আমি তো খবরের কাগজে নিউজ করি, এ রকম একজন ব্যক্তি যার মধ্যে কৃতজ্ঞতা বোধ আছে, তাকে যে সমর্থন দিয়েছে, ইনস্পিরেশন দিয়েছে, তাঁকে তিনি এভাবে সম্মান দিয়েছেন। পলিটিক্যাল লোকদের মধ্যে এতবড় মাপের মানুষ খুব কম পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের সাড়ে তিন বছরের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বলুন। ওই সময় গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে তিনি কী ধরনের পদক্ষেপ নেন?
রেহমান সোবহান: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণমানুষের লোক ছিলেন। অনেক রাজনৈতিক নেতা খ্যাতি লাভের পর জনগণ থেকে অনেক দূরে চলে আসেন। জনগণের নামে পলিটিকস করে জনগণকে ধোঁকা দেন। আসলে তার অন্তর থেকে একটা টান আছে, তার সবসময় মনে ছিল আমি কোত্থেকে এসেছি। আমি তো একজন সাধারণ লোক। বঙ্গবন্ধুর ডায়েরি কেয়ারফুলি কত লোক পড়েছেন তা আমি জানি না। যদি পড়েন, তবে বুঝবেন তিনি কী প্রকৃতির লোক ছিলেন। আজকাল সংসদে নেতারা যান এয়ারকন্ডিশন গাড়িতে চড়ে, অথচ তার তো ওই সময় নিজের গাড়ি ছিল না, টাকা-পয়সা ছিল না। তিনি বাংলাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন ট্রেনের থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে করে, নৌকা দিয়ে, সাইকেল-রিকশায় চড়ে, পুরনো বাসে করে, এভাবে পুরো গ্রামকে গ্রাম, পুরো বাংলাদেশ ঘুরে আওয়ামী লীগকে তৈরি করেছেন। যেই লোক এ রকম একটা পার্টি বিল্ডে যুক্ত থাকেন, তিনিই পারেন প্রত্যেক সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্দশা বুঝতে। তারপর ১৯৭০ সালে যে ইলেকশন ক্যাম্পিং ছিল, তার তো প্রতিজ্ঞা ছিল, দেশকে স্বাধীন করতে হবে, এমন সময় আসবে তখন হয়তো পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হবে। মুক্ত ইলেকশন আজকে হয়তো হবে, নিগোশিয়েশনের চেষ্টা হবে, শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান হয়তো ক্ষমতা ছাড়বেন না। শেষ মুহূর্তে যুদ্ধ লাগবে, যুদ্ধ ইয়াহিয়ার সঙ্গে করতেই হবে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, ট্র্যাডিশনাল মিডল ক্লাসের সমর্থন নিয়ে এটা যুদ্ধ করা যাবে না—ইতিহাস একটু বড় শক্ত। শহর কেন্দ্র করে ছোট ল-ইয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এদের দিয়ে পরিপূর্ণ লড়াই হবে না। এ রকম একটা ফাইন্যালাইজ যুদ্ধের জন্য সাধারণ জনগণকে মোবালাইজ করতে হবে। সেই সাধারণ জনগণ হলো গ্রাম-বাংলার কৃষক, তাঁতি, মজুর, কামার, কুমার। তো সাধারণ জনগণের মোবালাইজের জন্য আরেকটা অঙ্গীকার লাগবে এখানে। তারপর জনগণের যে চাহিদা, যে কষ্ট, যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ছিল, শুধু ওয়েস্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তো যুদ্ধ নয়, একটা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল। তো আমাকে বঙ্গবন্ধু গাইডিং ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন ফর প্রিপারেশনের জন্য, ১৯৭০-এর ম্যানিফেস্টো প্রস্তুতের জন্য। তো এ রকম ম্যানিফেস্টো করতে হবে—বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য, Self role Bangladesh যেন প্রতিষ্ঠা পায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতো ওই সময়। ওই যে Self role Bangladesh তার মেসেজ তো গ্রামে গ্রামে চলে গেছে। বঙ্গবন্ধু গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, স্বনির্ভর বাংলাদেশের কথা বলেছেন। এটা তো আমি নিজেও কয়েকবার দেখেছি। আমার মনে আছে কি আমি একবার ইলেকশন ক্যাম্পেনিংয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘুরছি। তাজউদ্দীন আহমদের কনস্টিটিউন্সিতে কালীগঞ্জে, ওখানে ভাষণ দেবেন। এখানে এবায়দুল কবিরের কনস্টিডিউশনও। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে গেলাম, আমাদের প্রথম স্টপিজ ছিল আদমজীনগর, আজমজীনগরের যেসব মাঠ আছে, প্রায় এক লাখ শ্রমিক জড়ো হয়েছিলেন ওখানে। তাছাড়া সমাজের ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত তরাও ছিল। আর মধ্যবিত্তরা তো সমর্থন দেবেই। তাছাড়া পার্টির কত নেতা দেখলাম। আসলে মূল কথা হলো, সাধারণ লোক তাকে সমর্থন দিচ্ছে। এক লাখের অধিক শ্রমিক জড়ো হয়েছে—এটাই ছিল তার মূল শক্তি। তারপর ওখান থেকে নদীপথে লঞ্চে করে ডেমরা থেকে কালীগঞ্জ প্রায় এক-দেড় ঘণ্টার রাস্তা-নৌপথ। দেখলাম পুরো নদীর দুই দিকে মানুষ ভিড় করেছিলেন। এ মানুষ কারা—এরা হলেন কৃষক, কৃষকের মা-বাপ-সন্তান, কৃষকের বাপের বাপ সবাই বঙ্গবন্ধুকে একটা নজর দেখতে চায়। ওই দিনটা ছিল আমার জন্য বড় একটা প্রাপ্তির দিন।
১৯৭১ সালে বাংলার মানুষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। বঙ্গবন্ধুর সব সময় মনে ছিল ওই সাধারণ লোক শুধু আমাকে ভোট দেয়নি, ওই লোকগুলো আমার জন্য রক্ত দিয়েছে। যুদ্ধ কে করেছে, ওই সাধারণ লোকরাই করেছেন। শ্রমিক, ওয়ার্কার, বস্তির মানুষ, কৃষকের সন্তান এরাই তো যুদ্ধ করেছে। রক্ত কে দিয়েছে, গ্রামের ঘরে ঘরের সন্তানরাই দিয়েছে। সবাই তো এই শ্রেণীর লোক, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ত্রিশ লাখ লোকের শহীদরা তো এরাই, এরাই দেশের প্রাণ। এভাবে একটা দেশ স্বাধীন হয়, গ্রেট মেজরিটি তো এরাই।
বঙ্গবন্ধু সাধারণ শ্রেণীর লোকদের চিনতেন, তাদের কথা সার্বক্ষণিক ভাবতেন, তাদের সমর্থন নিয়েই আজ তিনি দেশের রাজা হয়েছেন, তাই দেশের অর্থনীতিতে এ রকম একটা সমাজ সৃষ্টি করতে হবে, যেখানে বৈষম্য থাকবে না। বৈষম্য যেভাবে পাকিস্তান আমলে ছিল, ওই রকম একটা সমাজ যেন আর না আসে, বঙ্গবন্ধুর এমন একটা আশা ছিল। তাহলেই তিনি ওই সমাজের জন্য, নিপীড়িত বাংলার জন্য কিছু করতে পারবেন। তো শেষ পর্যন্ত বড়লোক, গরিব লোক সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সুসম্পর্ক ছিল। কখনো যদি তিনি দেখছেন— কোনো লোক তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তাঁকে অপছন্দ করছে, বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল না এ লোককে শাস্তি দিতে হবে। তিনি ভাবতেন ওই লোককে আমার বন্ধু বানাতে হবে। কেমন করে ওই লোক আমার বিরুদ্ধে চলে যাবেন দেখব। গুড বস তিনিই হবেন, যার শত্রু আছে তাকে বন্ধু বানাতে হবে—এ নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন আজন্ম।
আজকাল তো টেনডেন্সি আছে শত্রু আছে তো শত্রুই থাকবে। শত্রুকে যত কষ্ট দিতে পারি ততই ভালো। তিনি নিউটাল থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি অপনেন্ট পার্টিকে জায়গা দিতেন, অপনেন্ট ব্যক্তি বা দল দুর্বল সময়ে তাকে আঘাত করবে বা করতে পারে—এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল, সবাইকে আমি আমার সঙ্গে নিয়ে আসব। তারপর যাদের সঙ্গে তার প্রতিযোগিতা ছিল তাদের সঙ্গে তার ভালো ব্যবহারও ছিল। যাকে তিনি বন্ধু ভেবেছেন, তাকে চিরজীবনের জন্যই বন্ধু হিসেবে ভেবেছেন।
একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ্য করা প্রয়োজন, যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, তার কিছুদিন পর খাজা নাজিমুদ্দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা আসছেন। খাজা নাজিমুদ্দিন বেশ কয়েক বছর পর ঢাকায় আসবেন, তিনি তো নবাব পরিবারের লোক, অনেক বড়লোক। তিনি আবার ওয়াইস্টোনের কাউন্সিলে ছিলেন, জয়েন্ট বাংলাদেশ চিফ মিনিস্টার ছিলেন, গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান ছিলেন, ইস্ট পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার ছিলেন, পাকিস্তানের প্রাইম মিনিস্টার ছিলেন। কিন্তু যখন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হলো, গোলাম মোহাম্মদ তাকে বের করে দিলেন, তার ঢাকায় একটা ঘরও ছিল না। যখন তিনি এসেছেন—সব সময় তো আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ তর্ক-বিতর্ক ছিল—এটা তো পলিটিকসের ইতিহাস। কিন্তু যখন খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় ফেরত এসেছেন, তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, আতাউর রহমানের সঙ্গে, খাজা নাজিমুদ্দিনের দেখা হবে—এটা শেখ মুজিবের ভাবনায় ছিল। তিনি ভাবলেন খাজা নাজিমুদ্দিন কত বছর পর তার জন্মস্থানে ফিরে এসেছেন—তো তার সঙ্গে একটু সম্পর্ক রাখতে হবে। খাজা নাজিমুদ্দিনকে নিমন্ত্রণ দিয়েছেন। বললেন, আমার সঙ্গে ভাত খাবেন। আমার বাড়িতে বেড়াতে আসবেন।
বঙ্গবন্ধু আতাউর রহমানের সঙ্গে কোনো একটা সরকারি অফিশিয়াল ভিজিটে যাবেন, বঙ্গবন্ধু সাদা শেরওয়ানি পরে এসেছেন, খাজা নাজিমুদ্দিন সেখানে উপস্থিত, ওই সময় শেখ মুজিবুর রহমান খাজা নাজিমুদ্দিনকে সালাম করলেন। বললেন, ঢাকায় আপনি যেকোনো সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে আমাকে স্মরণ করবেন। আমি আপনাকে সেইভাবে সহযোগিতা করব। বঙ্গবন্ধু বললেন, You can except anything. অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, শেখ মুজিব এতটাই বড় মাপের মানুষ ছিলেন, একসময় খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব তার ওপর কত অত্যাচার-জুলুম করেছেন, জেলে ভরেছেন কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিনের দুঃসময়ে শেখ মুজিব তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। শেখ মুজিব বলতেন, এ দেশে নাজিমুদ্দিনের জন্ম হয়েছে, তিনি বয়সে বড়, তাঁর সঙ্গে ভালো ভদ্রতা করতে হবে—এ রকম একটা খেয়াল ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতিতে এ ধরনের স্পেশাল ব্যাপার ছিল।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫, যুদ্ধবিধস্ত একটি দেশ, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জিডিপির হার আশাব্যঞ্জকভাবে বাড়ছিল কি?
রেহমান সোবহান: কয়েকটি ব্যাপার বুঝতে হবে। সাধারণ লোকজন তো শুধু মনে করেছে একটা যুদ্ধের মধ্যে আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি। আমাদের আর ভাবনা-চিন্তা কি। আমাদের নাগলে সবকিছুই চলে আসবে। দেশের ওইসব সাধারণ লোকের মধ্যে এ ভাবনাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনগণের ভালোবাসা ছিল তীব্র। মানুষ মনে করতেন তিনি সবকিছু করে ফেলতে পারবেন। সত্যিকার অর্থে ১৯৭২ সালে আমাদের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস বা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ধ্বংস, রাস্তাঘাট ধ্বংস, দুটো বড় বড় ব্রিজ পাকিস্তান সাবোট্যাজ করে চলে যায়। হাইওয়েতে কোনো গাড়ি চলে না। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তবে মূল সমস্যা ছিল পাকিস্তানি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, পূর্ব বাংলার অর্থনীতির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। তারা একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে পাকিস্তান চলে যায়। মূলত অবাঙালি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় পাকিস্তান আমলে এদেশের ইকোনমি নিয়ন্ত্রণ করেছে, পূর্ব বাংলার ভেতর ও বাইরে থেকে। ইকোনমি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো হলো সব বড় বড় কারখানা, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, ট্রেডিং, পাটের ব্যবসা—সব তো অবাঙালিদের হাতে ছিল। হঠাৎ করেই ১৬ ডিসেম্বরের আগে সবকিছু গুটিয়ে তারা চলে যায়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠার পর খুব কম দেশেই এ রকম অবস্থা হয়েছিল। ইতিহাসে এ রকম নজির নেই বললেই চলে। দেশ থেকে পুরো একটা ব্যবসায়ী ক্লাস উধাও। আমাকে তো প্ল্যানিং কমিশনে ক্ষমতা দিয়েছে, বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড় করাও। অর্থাৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অ্যালোকেট করে রিভাইভ করো। সব তো তখন আমার হাতেই ছিল। এসব কঠিন কাজ তিন বছরের মধ্যে যে কিছু একটা হয়েছে, এটা তো কল্পনার বাইরে, এত শিগগিরই আমরা কিছু একটা দাঁড় করাতে পেরেছিলাম, এটাই তো অনেক। তারপর তিন বছরের মধ্যে সব কিছু কি গোলাপ বাগান হয়ে যাবে, এটা তো সম্ভব নয়। যতকিছু হয়েছে, সবই চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্যে হয়েছে। তবে হয়েছে অনেক কিছুই, ওটা তো সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য, তিনি দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন প্ল্যানিং কমিশন নিয়ে। তার নজরে ছিল কীভাবে দেশের মজবুত অর্থনীতির ভিত রচনা করা যায়। তবে তার আরো চাপ ছিল ডোনারের সঙ্গে, আমেরিকা তো ফুড শিপমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশে। ওই সময় ফুডের একটা সংকট বাইরে থেকে চলে আসে, ফলে সবকিছু তো তাকেই সামলাতে হচ্ছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে তখন আমরা এগোচ্ছিলাম। দেশ ও দেশের বাইরের নানা বৈরী পরিস্থিতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সামাল দিতে হচ্ছিল। তবে এর মধ্য থেকেও সবার সঙ্গে তিনি পারসোনাল সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, তাঁকে হারিয়ে আমরা কতটা পিছিয়ে গেছি?
রেহমান সোবহান: ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে শুধু একজন ব্যক্তিকে হত্যা করেনি, তারা ইতিহাসকে হত্যা করেছে। মূলত একটা সমাজকে হত্যা করেছে। তিনি যদি জীবিত থাকতেন, যে পরিশ্রমের দিন আমরা পার করেছি, যে কষ্টের দিন গেল, ফসল তো সব ১৯৭৫-এর মধ্যে আসা শুরু করল, তার মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে। এটা তো চিন্তাভাবনা করেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কি কষ্টের দিন তার মাথার ওপর ছিল, কি অমানুষিক কষ্ট করে তিনি একটা সংকট থেকে, যুদ্ধ করে দেশকে পাকিস্তানের কাছ থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন। ফসল যখন ঘরে উঠল, সে ফসল ব্যবহার করা হলো না, তখনই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ঘাতকপক্ষ ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু তো দেশকে একটা সম্মানজনক স্থানে নিয়ে গেছেন, এখন তার শ্রমের ফসল আমরা ভোগ করব, আমরা তার গড়ে তোলা দেশকে শাসন করব।
যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, তবে সাড়ে তিন বছরের কষ্টের ফসলের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মজবুত ভিত তৈরি হতো। সব তো ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দেশ যে পথে গেল, হয়তো সে পথে যেত না। তিনি দেশকে একটা পূর্ণতা দিতে পারতেন—এটা আমার স্পেকুলেশন। আমার মনে হয়, আরেকটা ইতিহাস হতো। এত সংকটের দিন থাকত না। এত মারামারি, এত কষ্ট, এত রক্তপাত হয়তো হতো না।