Originally posted in সময়ের আলো on 15 June 2022
পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি কাজ করেন বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে। সোমবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এই প্রতিবেদনে দেশের একজন নারী-পুরুষ দৈনিক কত ঘণ্টা কী ধরনের কাজ করেন, প্রকাশ করা হয়েছে। নারীরা ঘরের যে কাজ করেন তার অর্থনৈতিক কোনো মূল্যায়ন নেই আমাদের সমাজে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একটি স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সংসারের অর্থ না মেলা কাজেরও মূল্যায়ন করা সম্ভব।
বিবিএসের সময়ের ব্যবহার নিয়ে সমীক্ষায় দেখা গেছে, নারীরা ২৪ ঘণ্টার অর্ধেক সময়ই সংসারের কাজকর্ম, শিশু-বৃদ্ধসহ পরিবারের সদস্যদের যত্ন-আত্তি করেই পার করে দেন। নারীরা গড়ে ১১ দশমিক ৬ ঘণ্টা এসব কাজে ব্যয় করেন। অন্যদিকে পুরুষরা সংসারের কাজে ব্যয় করেন মাত্র ১ দশমিক ৬ ঘণ্টা।
বিবিএস বলছে, নারী-পুরুষ সবাই কাজ করেন। কিন্তু তাদের কাজের ধারায় পরিষ্কার পার্থক্য আছে। ঘরের টুকিটাকি কাজ করা এবং পরিবারের সদস্যদের যত্ন করা দৈনন্দিন কাজের অংশ। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ দুজনের সমান দায়িত্ব পালন করা উচিত; কিন্তু নারীর ওপর বেশি বোঝা হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক ব্যবহার নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার ৮ হাজার নারী-পুরুষের ওপর সমীক্ষা করেছে বিবিএস। বিবিএসের সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, একজন পুরুষ দৈনিক গড়ে ১১ দশমিক ৩ ঘণ্টা নানা কাজে ব্যয় করেন। আর একজন নারী নানা কাজে ব্যয় করেন গড়ে ১০ দশমিক ৯ ঘণ্টা।
নারীর কাজের স্বীকৃতিও কম। তারা মজুরিহীন কাজেই বেশি সময় দেন। বিবিএস বলছে, নারীরা প্রতিদিন গৃহস্থালির কাজ ৪ দশমিক ৬ ঘণ্টা করেন এবং পরিবারের সদস্যদের সেবা করতে খরচ করেন ১ দশমিক ২ ঘণ্টা। সব মিলিয়ে মজুরি ছাড়া কাজ করেন প্রতিদিন ৫ দশমিক ৬ ঘণ্টা। এসব কাজে তারা কোনো মজুরি পান না।
অন্যদিকে পুরুষরা দৈনিক মাত্র দশমিক ৮ ঘণ্টা এমন মজুরিহীন কাজ করেন। দেখা যায়, প্রতিদিনের এক-চতুর্থাংশ সময় মজুরি ছাড়া সংসারের কাজকর্ম করেন নারীরা। অর্থনীতিতে এর কোনো স্বীকৃতিও নেই।
পুরুষরা মজুরি নিয়ে (কর্মসংস্থানভিত্তিক) প্রতিদিন গড়ে ৬ দশমিক ১ ঘণ্টা কাজ করেন। নারীরা করেন মাত্র ১ দশমিক ২ ঘণ্টা। এ ছাড়া নারী-পুরুষ প্রতিদিন নানা ধরনের কাজ করেন। নিজের জন্য রান্না করা, টিভি দেখা, খেলাধুলা করা, সামাজিকতা রক্ষা করা ইত্যাদি।
বিবিএস আরও বলছে, টিভি দেখা, অবসরযাপন, বিনোদনসহ বিভিন্ন কাজে একজন নারী দৈনিক ২ দশমিক ৭ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। আর পুরুষ এসব কাজে সময় খরচ করেন ২ দশমিক ৬ ঘণ্টা।
এ ছাড়া সমীক্ষায় মতামত প্রদানকারীদের প্রায় ৭৩ শতাংশই মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। নারীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। পুরুষদের মধ্যে তা ৮৬ শতাংশের বেশি। আর ২৮ শতাংশ নারী-পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। পুরুষের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ২১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
ঘরে নারীদের কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করা যায় সে বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সময়ের আলোকে বলেন, নারীদের কাজকে অর্থনীতিতে মূল্যায়ন করতে হবে। যে সময় নারীরা ঘরে কাজ করছেন সে সময় বাইরে কাজ করলে কত ইনকাম করতেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী, সেটা জিডিপির মধ্যে স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে হিসাব করতে হবে। স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট হচ্ছে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টের পাশে আরেকটি অ্যাকাউন্ট। সেটার মধ্যে হিসাব করা, যাতে রিফ্লেক্ট হয় যে, এটার মানে এই নয়- তাদেরকে টাকা দিতে হবে। বিষয় হচ্ছে, ওই সময়ের মূল্যটা কী সেটা বের করতে হবে। সেই কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করালে কী মূল্য দিতেন। সেইভাবে মূল্যায়ন করা যায়। এর বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এটি হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, সাংসারিক কাজ নারী-পুরুষ উভয়ের। শুধু মেয়েদের কাজ বলা হয়, এটা ঠিক নয়। এর যে আর্থিক মূল্যায়ন জিডিপির মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। কারণ জিডিপির যে সংজ্ঞা আছে সেটা পরিবর্তন সম্ভব নয়।
তবে সাংসারিক কাজে নারী বা পুরুষ যে সময় ব্যয় করেন, তা মূল্যায়নের জন্য একটি আলাদা হিসাব করা সম্ভব। সেটা স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করতে হবে। একটি স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট খুলে নারীর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমমূল্যের একটা আলাদা হিসাব করলে নারীর যে অবদান একেবারে আমাদের চোখের বাইরে থেকে যায়, সেটা বোঝা যাবে। এটা নারীর সম্মান বৃদ্ধিতে একটা ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখবে। তবে প্রচলিত যে জিডিপির নিয়মকানুন, সেখানে সংসারে যে কাজ করা হয় সেটাকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। অনেকে সেটা দাবি তোলেন, তবে আমি সেটার সঙ্গেও একমত নই।