Originally posted in সময়ের আলো on 22 June 2022
বেশ কয়েকটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, মহামারি করোনার সময় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে দেশের দেড় কোটির ওপরে মানুষ। কর্মহীন অনেকেরই এখনও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়নি। এর মধ্যে উচ্চ পণ্যমূল্যের কারণে বিপাকে রয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। নতুন করে আরেক বিপর্যয় শুরু হয়েছে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ বন্যা। এতে অনেকে নিঃস্ব হয়েছে। এ অবস্থায় গত ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট পেশ করেছেন, তা পাসের আগেই বন্যার্তদের জন্য আলাদা বরাদ্দ অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাজেট পাস হতে পারে ৩০ জুন। নতুন অর্থবছর শুরু হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। প্রস্তাবিত বাজেটে এবার সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তাও পর্যাপ্ত নয়। করোনার মহামারির কারণে নতুন দরিদ্র, বেকার, অর্ধবেকারের কারণে এবার সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তার তেমন কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। বরং অনেকাংশে সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয়েছে। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আক্ষরিক অর্থে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। কিন্তু গতবছর এটি ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতের বরাদ্দ সম্পর্কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, এবারের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আসলে মূল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে ধরা হলে বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি হবে না। সরকারের প্রবণতা হচ্ছে এ খাতকে বড় করে দেখানো। এটি করে গরিব মানুষকে ঠকানো হয়। তিনি বলেন, আশা করেছিলাম এবার কিছুটা হলেও সংশোধন হবে। কিন্তু সরকার এ খাতে যে বরাদ্দের কথা বলে থাকে সেটাও বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে জিডিপির তুলনায় বরাদ্দ কমে গেছে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে প্রতিবন্ধীদের ভাতা বাড়ছে ১০০ টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ২০ লাখ ৮ হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাসে ৭৫০ টাকা হারে ভাতা পেয়ে আসছেন। তাদের সংখ্যা আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫৭ হাজার বাড়িয়ে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার করা হচ্ছে। জনপ্রতি মাসিক ভাতাও ১০০ টাকা বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৮৫০ টাকা। এ ছাড়া মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে উপকারভোগী রয়েছেন ১০ লাখ ৪৫ হাজার। আগামী অর্থবছরে উপকারভোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার বেড়ে দাঁড়াবে ১২ লাখ ৫৪ হাজার। এ খাতে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয়েছে ১ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কর্মসূচির সংখ্যা ১২৩টি থেকে কমিয়ে ১১৫টি করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
দুস্থ-প্রবীণ ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত ভাতার ক্ষেত্রে প্রবীণ নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে ৫৭ লাখ ১ হাজার জন বয়স্ক ব্যক্তি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে আগামী অর্থবছরের জন্যও ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থ বিভাগ আগামী অর্থবছরের জন্য যে ১১৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তালিকা তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায় অবসরভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন বাবদ ২৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ ৭ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, করোনার কারণে ব্যাংকের সুদ মওকুফ ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সুদ ভর্তুকি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তির জন্য ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এগুলোকেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বলছে সরকার। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এগুলোকে সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে মানতে নারাজ।
বন্যার্তদের জন্য বাজেটে বরাদ্দের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, নানা কারণে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাভোগীরা সঙ্কটে আছে। করোনার কারণে তাদের সঙ্কট আরও বেড়েছে। নতুন করে শুরু হয়েছে ভয়াবহ বন্যার প্রকোপ।এতে করে সিলেটসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সব জেলার কয়েক কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ এলাকার মানুষ বন্যায় তাদের সহায়-সম্বল সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর সব কিছু তাদের নতুন করে শুরু করতে হবে। সুতরাং অর্থমন্ত্রী গত ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে বাজেট পেশ করেছেন তাতে বন্যার্তদের জন্য আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে। বাজেট পাস হতে এখনও সপ্তাহখানেক বাকি। সতরাং এখনও সুযোগ রয়েছে, বাজেট পাসের আগে এটি অন্তর্ভুক্ত করা। বন্যার্তদের জন্য দুই রকম সহযোগিতাই দিতে হবে। খাদ্য সহায়তা ও নগদ অর্থ সহায়তা। সেই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে ওএমএসের মাধ্যমে কম দামে চাল এবং টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রি শুরু করতে হবে। বাজেট পাসের আগেই বন্যার্তদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা ন হলে বাজেট পাসের পর নতুন অর্থবছরে সমস্যায় পড়তে হবে।