Published in সমকাল on Sunday, 18 March 2018
বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন পরিচয়, নতুন দিগন্ত
জাতিসংঘের স্বীকৃতি
– ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
বাংলাদেশের জন্য একটি আনন্দের উপলক্ষ এসেছে। দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে আসার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি-সিডিপি। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে আসার সব শর্ত পূরণ করেছে। কয়েক দিক থেকে এ বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। এখন আর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত ৪৭ দেশের তালিকায় নেই। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ হচ্ছে এমন একটি দেশ, যার জিডিপি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা সব দেশের জিডিপির ১৯ শতাংশ, বাণিজ্যের ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং লোকসংখ্যা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ধরনের একটি দেশের এই উত্তরণ বৈশ্বিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আরও একটি বিষয় মনে রাখা চাই, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যারা উত্তরণের সব শর্ত পূরণ করে তালিকা থেকে বের হচ্ছে- মাথাপিছু জাতীয় আয়, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ও মানবসম্পদ সূচক। একই সঙ্গে লাওস এবং মিয়ানমারও এ তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে বলে সিডিপি জানিয়েছে।
আমাদের এই উত্তরণ অবশ্যই জাতীয় মর্যাদার বিষয়। বিশ্বে আমরা বহুকাল দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছি। এভাবেই আমাদের পরিচয়। এখন তা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। স্বভাবতই সমকাতারের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতদিন যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশকে সহযোগী দেশ হিসেবে বিবেচনা করেনি; বিনিয়োগ করতে দ্বিধা করেছে, তারা বাংলাদেশের নতুন পরিচয়ের কারণে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা ভাববে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে পরিবর্তন আনবে। ঝুঁকির যে রেটিং তাদের পরিবর্তন আসবে। বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববে। ঋণপ্রাপ্তির জন্য সহজে বিবেচনা পাবে। এতদিন আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ছিলাম। অনেক বিনিয়োগকারী দেশ ও সংস্থা বিনিয়োগে ঝুঁকি বোধ করত। বাণিজ্যিক ঋণপ্রাপ্তিতেও সমস্যা দেখা যেত। নতুন পরিচয় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
তবে মনে রাখতে হবে, আনুষ্ঠানিক উত্তরণের ঘোষণা আসবে ২০২৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে। আগামী ছয়টি বছর সেখানে আমাদের বর্তমান পরিচয় বহাল থাকবে। আমাদের আগে যে চারটি দেশের স্বল্পোন্নত পরিচয় থেকে উত্তরণ ঘটেছে, তাদের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আমাদের মনে রাখতে হবে। সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ওইসব দেশের সামগ্রিকভাবে জাতীয় আয়, ঋণপ্রাপ্তির শতকরা পরিমাণ, রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রভৃতি সূচক উত্তরণের আগের তুলনায় পরের সময়ে শ্নথ হয়েছে কিংবা কমে গেছে। মোদ্দা কথা, পরবর্তী সময়ে কতক ক্ষেত্রে এক ধরনের চাপে পড়েছে তারা। আমরা মালদ্বীপ, ভানুয়াতু, কেপভার্দে ও বতসোয়ানার কথা বলতে পারি। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের উত্তরণ মসৃণ হবে না। তবে মনে রাখতে হবে, ওইসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় পার্থক্য রয়েছে। আর সেখানেই বাংলাদেশের শক্তি নিহিত। ওই চারটি দেশ আয়তনে ছোট, তারা দ্বীপরাষ্ট্র, ভূ-পরিবেষ্টিত, স্বল্প পণ্যের ওপর প্রবল নির্ভরতা, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দুর্বল সম্পর্ক। এসব সীমাবদ্ধতা নিয়েই তাদের উত্তরণ ঘটেছিল। সে তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের আকার ও বিস্তৃতি যথেষ্ট। কমবেশি ভারসাম্যও রয়েছে। তবে রফতানি পণ্যে প্রধানত তৈরি পোশাকের ওপর রয়েছে ব্যাপক নির্ভরতা। কৃষিতে শস্য উৎপাদন ভালো। তবে সব সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। উন্নয়নশীল দেশের সারিতে দৃঢ় অবস্থান করে নিতে এসব ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি।
বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাজার সুবিধা। শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার বাজারের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, চীন, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে আমাদের রফতানি বেড়েছে। এ কারণে নারীদের কর্মসংস্থান হয়েছে। রফতানি বাণিজ্যে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হলে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা কমবে বা থাকবে না। উদাহরণ হিসেবে আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা বলতে পারি। সেখানে অস্ত্র ছাড়া সবকিছু আমরা বিনা শুল্ক্কে রফতানি করতে পারি। ওই অঞ্চলে রয়েছে আমাদের বড় বাজার- মোট রফতানির ৬২ শতাংশ। স্বল্পোন্নত দেশ না থাকলে নতুন শর্তে সুবিধা পেতে হবে, যাকে বলা হয় জিএসপি কিংবা জিএসপি প্লাস। এ জন্য আমাদের নতুন করে আবেদন করতে হবে। তারা হয়তো সীমিত সংখ্যক পণ্যে সুবিধা দেবে। তার জন্যও কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন পূরণে বাধ্যবাধকতা থাকবে, যেমন শ্রম-সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন, পরিবেশ মানদণ্ড-সংক্রান্ত কনভেনশন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট ও ইনটেলেকচুয়াল কনভেনশন, দুর্নীতি দমন কনভেনশন। এটা নিশ্চিত, এখনকার মতো শর্তহীন বাজার সুবিধা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে না। ভারত, কানাডা প্রভৃতি দেশেও সমস্যা হবে।
দ্বিতীয়ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওষুধ। বাংলাদেশ ব্যতিক্রমী স্বল্পোন্নত দেশের সারিতে থাকা দেশ, যার রয়েছে শক্তিশালী ওষুধ শিল্প খাত। আমরা জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু এ জন্য মূল কোম্পানিকে রয়ালটি দিতে হয় না। ফলে উৎপাদন ব্যয় কম থাকে, দেশের বাজারে দামও সঙ্গত কারণে কম পড়ে। এই ইনটেলেকচুয়াল সুবিধা ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকার কথা। কিন্তু ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণ ঘটলে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে মূল কোম্পানিকে রয়ালটি দেওয়ার প্রশ্ন আসবে। এর প্রভাব পড়বে উৎপাদন ব্যয়ে। দেশ-বিদেশের বাজারেও দেখা যাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা তীব্র হবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে ঋণপ্রাপ্তি। স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার কারণে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান থেকে ১ শতাংশেরও কম সুদে আমরা ঋণ পাই। এর পরিশোধের মেয়াদ ৪০ বছর, আরও আছে ১০ বছর গ্রেস। বাণিজ্যিক সুদের হার বেশি, কখনও কখনও ৩-৫ শতাংশ, গ্রেস থাকে না, পরিশোধের মেয়াদ হয়ে থাকে অর্ধেক। ফলে ঋণের সুদের হারজনিত দায়-দেনা বাড়ার কথা। এনজিও খাতের জন্যও সমস্যা হবে। অনেক নিম্নআয়ের লোক থাকায় পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সহায়তা মেলে। গবেষণা, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য ফি কম বা মওকুফ, বিভিন্ন সংস্থার বার্ষিক চাঁদা- এসব সুবিধা নতুন প্রেক্ষাপটে বর্তমানের মতো থাকার কথা নয়। মোট কথা, উত্তরণ পর্বটি মসৃণ হবে না। এ কারণে বাধাগুলোকে এখন থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন।
প্রথমেই নজর দিতে হবে বাজার সুবিধার প্রতি। বাজার সুবিধা যেন অব্যাহত থাকে, সে জন্য অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা চালাতে হবে। কানাডা, জাপান, ভারত, চীন- এসব দেশ থাকবে নজরে। দ্বিতীয় হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তাদের কাছ থেকে আমাদের প্রধান প্রধান পণ্যে জিএসপি ও জিএসপি প্লাস সুবিধা চাই। রফতানি বহুমুখী করতে হলে এটা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে এফটিএ উদ্যোগ নিতে হবে। ইতিমধ্যে শ্রীলংকার সঙ্গে এ ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সঙ্গেও একই ধরনের উদ্যোগ চাই। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সমন্বিত অর্থনৈতিক সহযোগিতার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্বল্প হার সুদে ঋণ সুবিধা পেতে সমস্যা হলে মিশ্র হারের কথা ভাবতে হবে। এর ফলে সুদজনিত ব্যয় কম রাখা সম্ভব হবে। পাশাপাশি খুঁজতে হবে নতুন ঋণের উৎস। এশিয়ান অবকাঠামো ব্যাংক, ব্রিকস ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার প্রতি আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে।
বিনিয়োগ সম্প্রসারণও গুরুত্বপূর্ণ। দেশি ও বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগ আমাদের বাড়াতে হবে। নতুন যে প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে, তার মোকাবেলায় এর বিকল্প নেই। কৃষি, শিল্প, মানবসম্পদ- সব ক্ষেত্রে চাই আরও বিনিয়োগ। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে নিম্ন উৎপাদনশীলতা। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এ সমস্যা আছে, বিভিন্ন খাতেও আছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যে নতুন ধরনের প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে, তাতে টিকতে হলে এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। তরুণ ও নারী শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
অর্থনীতির বহুমুখীকরণও গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিতে শুধু শস্যের ওপর নির্ভরতা নয়। সবজি, ফল, মাছ, গবাদি পশু; যেসব খাত থেকে বেশি আয়ের সুযোগ রয়েছে সেগুলোর প্রতি বাড়তি নজর দিতে হবে। কৃষিভিত্তিক শিল্পও গুরুত্ব্বপূর্ণ। ওষুধ. ইলেকট্রনিক্স, চামড়া, জাহাজ প্রভৃতি শিল্প খাতের সম্ভাবনা যথেষ্ট। রফতানি বহুমুখী করতে হলে আমাদের বাজারের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের প্রতিও নজর দিতে হবে। যেসব উদ্যোক্তা নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন করছেন কিংবা একক পণ্যের জন্য বাজার সুবিধা সৃষ্টি করেছেন, তাদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বলা যায়, শুধু খাতভিত্তিক নয়; ব্যক্তিভিত্তিক পরিকল্পনাও থাকা চাই।
এনজিও খাতও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সামাজিক খাতের উন্নয়নে অনেক সংস্থা এতদিন ভালো ভূমিকা রেখেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটলে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা আফ্রিকার যেসব দেশে দারিদ্র্য বেশি সেখানে চলে যেতে চাইবে। যেহেতু এ খাতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমবে তাই ট্রাস্ট তহবিল গঠনের কথা ভাবতে হবে।
সরকার ইতিমধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে, যারা উত্তরণ পর্যায়ের যাবতীয় কাজ মনিটর করবে এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেবে। এ কমিটিতে উদ্যোক্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবা যায়। আমরা চাই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ যতটা সম্ভব মসৃণ হোক এবং এ জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে।
গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)