Originally posted in বাংলাদেশ প্রতিদিন on 26 May 2022
কারণে অকারণে অর্থনীতিতে অস্থিরতা
ডলারের দাম বাড়ছেই, কমছে টাকার মান, শেয়ারবাজার মন্দা, মূল্যস্ফীতি, চাপের মুখে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাত, আমদানি কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ, বাজেটকে আরও গণমুখী ও কল্যাণকর করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতেও সংকট বাড়ছে। স্বস্তি নেই অর্থনীতির কোনো খাতেই। ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দামও। শেয়ারবাজারেও মন্দা। গতকালও ডিএসইতে সাধারণ সূচক কমেছে ২৩ পয়েন্ট। ব্যবসা-বাণিজ্যেও অস্বস্তি। আস্থার সংকটে বাড়ছে না কর্মসংস্থান-বিনিয়োগ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্ববাজারেও ডলারের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশে ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে কমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধিও আশাব্যঞ্জক নয়। ডলারের খরচ কমাতে ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিলাসী ও কম প্রয়োজনীয় প্রায় ২০০ পণ্যের আমদানি শ্রল্ক বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বন্ধ করা হয়েছে সরকারি, আধাসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিদেশ ভ্রমণ। তবু কমছে না অস্থিরতা। এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময়। আসছে বাজেটে সরকারের কিছু নীতির পরিবর্তন করার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রমতে, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো হয়েছে ১ দশমিক ৩০ টাকা। অবশ্য এ সময়ের মধ্যে এর আগের দুই সপ্তাহের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। কিন্তু আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের খরচও বেড়েছে। ১৮ মে পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে; যা ৩০ এপ্রিলে ছিল ৪৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
স্কুলশিক্ষক হাসিনা আক্তার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ভাড়া বাসায় বাস করছেন। এক সন্তান স্কুলে পড়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে আয় করেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। পেশাগত জীবনের গত ১৫ বছরে এতটা কঠিন সময় তিনি পার করেননি। তিনি জানান, খরচের খাতটা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে খাবার, জামাকাপড়সহ অন্যান্য খাতের বাজেট কাটছাঁট করতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। ফলে খরচ কমাতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর গোপীবাগের বাসিন্দা মনজুরুল ইসলাম। তিনি দুবাইপ্রবাসী ছিলেন অনেক বছর। করোনা মহামারির মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ইনস্টিটিউটের সাবেক ছাত্র। দুবাইয়ে দীর্ঘদিন কোম্পানির হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে ফার্মেসি ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, গত দেড়-দুই বছরে বাংলাদেশে যে হারে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে তাতে টিকে থাকা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে পরিবার চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, দু-তিন মাস ধরে ডলারের বাজারে অস্থিরতা চলছে। এর জন্য একটি পৃথক তহবিল গঠন করা যেতে পারে। এর অধীনে ব্যাংকগুলো আপাতত আমদানির ক্ষেত্রে কোনো মার্জিন রাখবে না। রপ্তানির ধারা ধরে রাখতে হবে। আগামী কিছুদিনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডলার ধরে রাখার ক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়ানো। এ সময় টাকার অবমূল্যায়ন কিছুটা কমানো যেতে পারে। তবে তা হতে হবে বাস্তবসম্মত। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার করতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানির লাগাম টানতে হবে। এখানে সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা কার্যকর করতে হবে। ব্যাংকগুলোর রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে। এখানে রেমিট্যান্স যাঁরা পাঠাচ্ছেন, নীতিনির্ধারক, যাঁরা রেমিট্যান্স আহরণ করছেন তাঁরা মিলে একটা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হালে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ মুদ্রা বিনিময় হার কখনই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়নি। অর্থনীতি যখন স্বস্তিদায়ক অবস্থায়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে কোনো সংকট ছিল না তখনো টাকার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। আর এখন চরম সংকটের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দিতে দফায় দফায় টাকার মান কমাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে বাংলাদেশে নির্ধারিত টাকায় ডলার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দরে খোদ ব্যাংকের ভিতরেও ডলার মিলছে না। কার্ব মার্কেটে পরিস্থিতি তো আরও কঠিন। এখানে আরেকটি বড় সমস্যা হলো ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলার রেটের পার্থক্য সব সময়ই অনেক। এ ব্যবধানটা কমিয়ে আনতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এদিকে ডলারের বাজারে অস্থিরতার কারণে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। আবার করোনা মহামারির ফলে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কমেছে। বাংলাদেশেও শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে এর একটা প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া বৈরী আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে দফায় দফায়। এবারও হাওরাঞ্চলের কৃষক সময়মতো ধান কাটতে না পারায় লোকসানের মুখে পড়েছে। এসব প্রেক্ষাপটে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। অনবরত বাড়ছেও। এর প্রভাবে মার্চ-২০২২ শেষে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে; যা ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ করোনা মহামারিতেও মূল্যস্ফীতি এতটা বাড়েনি; যা বেড়েছে গত তিন মাসে।
প্রবাসী আয়ের ধারায়ও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি চলছে। ২০২০ সালে কভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত দেশে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছিল বেশ ভালো। শুরুতে রপ্তানি নিয়ে নানা শঙ্কা দেখা দিলেও পরে তা-ও ঘুরে দাঁড়ায় খুব কম সময়েই। এমনকি আমদানি ব্যয়ও ছিল সহনীয়। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই কয়েকটি সূচকে অস্থিরতা দেখা দেয়। এর মধ্যে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি দূরের কথা, আগের বছরের সমান আয়ও করা যায়নি। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রবাসী আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ।