Originally posted in সমকাল on 27 October 2022
বৈদেশিক মুদ্রার সব উৎসেই ভাটা
বৈদেশিক মুদ্রার সব উৎসেই দেখা দিয়েছে নিম্নগতি। রপ্তানি, প্রবাসী আয় এবং উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়- তিন ক্ষেত্রেই বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ আগের চেয়ে কমেছে। গত সেপ্টেম্বরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে গিয়েছিল। এই অক্টোবরেও দুই ক্ষেত্রেই একই প্রবণতা। অন্যদিকে সর্বশেষ হিসাবে এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় আগের একই সময়ের চেয়ে কমেছে।
অর্থনীতিবিদ এবং উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বৈশ্বিক ও স্থানীয় নানা সংকটে অর্থনীতির ওপর তৈরি হওয়া চাপ সহসাই কাটবে না। রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার প্রবণতা আগামী মাসগুলোতেও অব্যাহত থাকতে পারে। সময়মতো পণ্য পাওয়া নিয়ে উদ্বেগে আছেন ক্রেতারা। কারখানায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে তাঁদের কাছে। প্রতিযোগী অন্য কোনো দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের এতটা সংকট নেই। এ কারণে সম্প্রতি রপ্তানি আদেশ কমেছে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ। আগামী কয়েক মাসের রপ্তানি আয়ের প্রতিবেদনে এর প্রতিফলন দেখা যাবে। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি সংকটের দ্রুত সমাধান, পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক ঋণ ছাড় করাতে আরও তৎপর হওয়া এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে কার্যকর কৌশল নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
করোনার ধকল কাটিয়ে টানা ১৩ মাস ইতিবাচক থাকার পর গত সেপ্টেম্বরে রপ্তানি নেতিবাচক ধারায় নেমে আসে। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় কমে ৬ শতাংশ। এই অক্টোবরের প্রথম ২০ দিনে তৈরি পোশাক রপ্তানি কম হয়েছে ১৯ শতাংশ। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সমকালকে বলেন, দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি কমছে- এটি নিশ্চিত। এসব মাসের রপ্তানি আদেশ এরই মধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের পরের পরিস্থিতি কী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, দিন দিন জ্বালানি পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন ক্রেতারা। কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করছেন তাঁরা। রপ্তানি আদেশ দেওয়ার পরও অনেক ক্রেতা আপতত উৎপাদন স্থগিত রাখতে বলছেন। আবার মন্দা পরিস্থিতিতে চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্রেতারা সংকটেও আছেন। কোনো কোনো ক্রেতা পণ্য নিচ্ছেন না, মূল্যও দিচ্ছেন না। পণ্য নেওয়ার পরও দর পরিশোধে সময় নিচ্ছেন কেউ কেউ। কিছু কারখানার এ রকম অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকটি ব্র্যান্ডের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিজিএমইএর বৈঠক হয়েছে। বিভিন্ন কারখানায় তাদের রপ্তানি আদেশে উৎপাদিত পণ্য পর্যায়ক্রমে গ্রহণ এবং সহনীয় সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সাধারণত পণ্য বুঝে পাওয়ার অন্তত তিন মাস আগেই ক্রেতারা রপ্তানি আদেশ দিয়ে থাকেন। রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর শুল্ক্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির জন্য ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) নিতে হয়। বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সরকারের পক্ষ থেকে ইউডি দিয়ে থাকে। এ দুই সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, এই অর্থবছরের গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ইউডি নেওয়ার হার কমেছে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ। বিকেএমইএর সহসভাপতি আকতার হোসেন অপূর্ব সমকালকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন কমেছে ৪০ শতাংশ। ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তির দরের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কমপক্ষে ৫ শতাংশ।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় তাঁর কারখানায় লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেল দিয়ে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে। এতে প্রতি মাসে গড়ে দেড় কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। ক্রেতাদের সঙ্গে আগেই চুক্তি হওয়ায় বাড়তি দর চাওয়া যাচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য পৌঁছাতে না পারলে স্টকলট, ডিসকাউন্ট কিংবা দেরিতে মূল্য পরিশোধের মুখোমুখি হতে হবে।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার তিন উৎস থেকেই আয় কমে যাওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভে আরও চাপ তৈরি হবে। একদিকে আমদানি দায় মেটানোর চাপ, অন্যদিকে ডলার আসার প্রবাহ এখনকার চেয়ে কম হলে কী পরিস্থিতি হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক না কেন, উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে রপ্তানি খাত থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা আসার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে। সহজে ব্যবসা পরিচালনার বিষয়টিও ভাবতে হবে। বিদেশি ঋণের ছাড় বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গতকাল ৩৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার। মূলত চলমান সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই অর্থবছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৪৮১ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়। গত অর্থবছর বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৬২ কোটি ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির পরও আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে গ্রাহকদের এখন ১০৬ টাকার মতো খরচ হচ্ছে। এই বছরের শুরুতেও যা ৮৬ টাকার কম ছিল।
২০ দিনে ১১০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স :২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমার পর এই অর্থবছরের শুরুতে বাড়ার প্রবণতা ছিল। তবে গত ১১ সেপ্টেম্বর রেমিট্যান্সে দর বেঁধে দেওয়ার পর থেকে আবার কমছে। অক্টোবরের প্রথম ২০ দিনে মাত্র ১১০ কোটি ডলার সমপরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা ১৫৪ কোটি ডলারের কম টাকা দেশে পাঠিয়েছেন। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় যা ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং আগের মাসের চেয়ে ২৪ দশমিক ৪২ শতাংশ কম ছিল।
বিদেশি ঋণের ছাড় কমেছে :এই অর্থবছরের গত জুলাই-সেপ্টেম্বর (প্রান্তিক) পর্যন্ত সময়ে বিদেশি সহায়তার ছাড়ের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ সময় বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ সহায়তা হিসেবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের পরিমাণ ১৩৫ ডলারেরও কিছু কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯৪ কোটি ডলার। তিন মাসে কমেছে প্রায় ৫৯ কোটি ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, গত প্রান্তিকে ঋণ এবং ঋণের সুদ বাবদ ৪৯৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৫০০ কোটি ৬৬ লাখ ডলার।
কম বৈদেশিক অর্থছাড়ের কারণ হিসেবে ইআরডির কর্মকর্তারা মনে করেন, গত অর্থবছরে করোনার টিকা সংগ্রহ বাবদ অতিরিক্ত সহায়তা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া করোনার অভিঘাত উপশমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচির আওতায়ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে বাড়তি অর্থ পাওয়া গেছে। তবে এ বছর সেই দুই পরিস্থিতি নেই। স্বাভাবিক পরিমাণ অর্থই পাওয়া গেছে। এ কারণে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে এই অর্থবছরের একই সময়ে বিদেশি অর্থছাড়ের পরিমাণ কম দেখা যাচ্ছে।