Originally posted in প্রথম আলো on 28 May 2022
ডলার ও সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ
অর্থনীতির বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নেই বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। করোনার কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যের যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, সেটিকে আরও প্রকট করেছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। তাই অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সংকটও তত বাড়বে। কারণ, বৈশ্বিক অস্থিরতা রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করবে। এ অবস্থায় উৎপাদক শ্রেণিকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি দেশের গরিব মানুষের জন্য খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে।
এ ছাড়া চলমান সংকট মোকাবিলায় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে যত দেরি হবে, সমস্যাও তত বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ। রপ্তানিকারক ও ব্যাংকাররা চান, ডলারের বিনিময়মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। পাশাপাশি ব্যাংকের সুদহারও বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা।
প্রথম আলোর আয়োজনে ‘কোন পথে অর্থনীতি ও আগামীর বাজেট’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আজ শনিবার অনুষ্ঠিত এ বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। বৈঠকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফসহ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী চলে এ আলোচনা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি আসলে কত? সরকারি তথ্য বলছে, এ হার ৬ শতাংশ। আসলে কি তাই? আমরা সিপিডি থেকে বলেছি, মূল্যস্ফীতি কারও কারও ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশের ওপরে। চালসহ কিছু মৌলিক পণ্যের দাম ৪০-৬০ শতাংশ বেড়েছে। প্রশ্ন হলো এই মূল্যস্ফীতির তথ্য সঠিক কি না। তাই প্রথম কথা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হিসাব না করে যতই নীতি নেন না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না।’
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমরা বাজার অর্থনীতির কথা বলছি, আবার অন্যদিকে সংরক্ষণবাদী নীতিও নিয়েছি। প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী না করলে সবাই সুফল পাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু প্রবৃদ্ধি, বেকারত্ব নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কাজ অর্থ মন্ত্রণালয় করছে। এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা নিয়ে কথা হচ্ছে।’
হুন্ডি একটি অপ্রতিরোধ্য বিষয় হয়ে গেছে বলে মত দেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, যত দিন টাকা পাচার বন্ধ না হবে, তত দিন হুন্ডি চলবে। অনেকে অভিবাসী হয়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছেন। তাঁরা ১০, ৫০, ১০০ কেটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা তো এ দেশের ঘরবাড়ি ফেলে যাচ্ছেন না। এসব বন্ধে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি দুঃসাধ্য কাজ। আইনি কাঠামো নেই। যাঁরা চলে গেছেন, তাঁরা তো ওই দেশের অংশ হয়ে গেছেন। যেসব দেশে পাচারের টাকা যাচ্ছে, ওই সব দেশও বোঝে, এগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা। তারপরও তারা পাচার হওয়া অর্থ গ্রহণ করছে।
অর্থনীতিতে সংস্কার প্রসঙ্গে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমরা সংস্কার ভুলে গেছি। সংস্কার এখন ধরাছোঁয়ার বাইরের বিষয় হয়ে গেছে। রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় দরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন না বাজার অর্থনীতি, না কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি।’ তিনি আরও বলেন, দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও তথ্যপ্রযুক্তি—এই তিন বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। আবার তথ্য–উপাত্ত নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের অনীহা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত না থাকলে নীতি নির্ধারণও যথাযথ হয় না।