Originally posted in সময়ের আলো on 30 July 2022
রিজার্ভের ওপর আরও চাপ বাড়বে
দেশের প্রকৃত রফতানি আয় বাড়ছে না
সদ্য বিদায়ি ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি বাণিজ্য থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলার। অথচ এই মোট রফতানি আয়ের প্রায় অর্ধেকই চলে যাচ্ছে কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আমদানিতে। তাহলে প্রকৃত রফতানি আয় কত। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ৫২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারই চলে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়ে।
এর বাইরে একদিকে তৈরি পোশাকের ইউনিট প্রাইস আরও কমে গেছে, অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর আরও চাপ বাড়ছে। এদিকে তৈরি পোশাকের ইউনিট প্রাইস কমে যাওয়ার পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে পোশাকের সিএম (কাটিং-মেকিং) প্রাইসও বেড়ে গেছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। সব মিলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। আবার গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে শিল্পের উৎপাদনও কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এভাবে রফতানি খাতগুলোকে চারদিক দিয়ে সঙ্কট ঘিরে ধরেছে বলে জানান শিল্প উদ্যোক্তারা। এসব কারণে সময়মতো ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না। এতে করে রফতানি আয় কমে যাচ্ছে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশও অনেক কমে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে সেখানে সঙ্কট আরও বাড়বে বলে জানান উদ্যোক্তারা। এ বিষয়ে নিটওয়্যার পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সময়ের আলোকে বলেন, একসঙ্গে অনেক সঙ্কট আমাদের ঘিরে ধরেছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট শিল্পের উৎপাদন একেবারে থমকে দিয়েছে। বিশেষ করে দিনের বেলাই আমরা গ্যাস পাচ্ছি না বললেই চলে। কারখানায় যেখান ১৫ পিএসআই গ্যাস দরকার সেখানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অধিকাংশ কারখানায় গ্যাস পাচ্ছি দশমিক ২ থেকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে দিনের বেলায় কারখানা একরকম বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এজন্য শিল্পের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এতে পোশাক রফতানিতে ধস নামবে, যা রিজার্ভ সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দেবে। এই সঙ্কটালীন সময়ের জন্য যা মোটেই শোভনীয় হবে না। সুতরাং সরকারকে সবার আগে শিল্পের উৎপাদন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে নিটওয়্যার পণ্য থেকে রফতানি আয় হয়েছে ২৩ বিলিয়ন ডলার এবং ওভেন পোশাক থেকে আয় হয়েছে ১৯ বিলিয়ন ডলার। এই দুই খাতে মোট রফতানি আয় হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এই ৪২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে কাঁচামাল আমদানিতেই চলে গেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাত থেকে গেছে ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ওভেন খাত থেকে গেছে ১২ বিলিয়ন ডলার। পোশাক খাতের রফতানি থেকে রিজার্ভে যাচ্ছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার যাচ্ছে নিটওয়্যার খাত থেকে, আর ওভেন খাত থেকে যাচ্ছে ৫ বিলিয়ন ডলার। পোশাক খাতের বাইরে আরও যে ১০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় আসে সেখান থেকেও প্রায় ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার চলে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। বিশেষ করে ফুটওয়্যারসহ আরও কয়েকটি খাতের কাঁচামাল আমদানিতে এই অর্থ চলে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে পোশাক খাতসহ অন্যান্য খাত মিলে কাঁচামাল আমদানিতেই চলে যাচ্ছে ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট রফতানি আয়ের অর্ধেক চলে যাচ্ছে আমদানি ব্যয়ে, আর অর্ধেক জমা হচ্ছে রিজার্ভে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইস মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রফতানি আয় আসলে যেটা বলা হয়, প্রকৃত আয় কিন্তু সেটা না। অর্ধেকই প্রায় চলে যায় কাঁচামাল আমদানিতে। এজন্য প্রকৃত রফতানি আয় বাড়াতে হলে তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে, অন্যান্য দেশীয় পণ্যের রফতানি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষিপণ্য, বেকারি পণ্যের মতো দেশীয় পণ্যের রফতানি বাড়াতে হবে। এ ছাড়া পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে এই সঙ্কটকালীন সময়ে রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না। কারণ দেশের স্বার্থে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মোট রফতানি থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বাদ দিলে প্রকৃত রফতানি হিসাব অনেকটাই কমবে। কিন্তু আমাদের দেশে আমদানিকৃত পণ্যে অভ্যন্তরীণ মূল্যসংযোগ কম হওয়ায় রফতানি আয় কম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমদানিকৃত পণ্যে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোগ বাড়াতে হবে। রফতানি আয়ের বড় অংশজুড়ে আছে তৈরি পোশাক। এ খাতে তুলা ও সুতার ব্যবহার বেশি। এ জন্য দেশি তুলা ও সুতার উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়িয়ে মূল্য সংযোজন বাড়াতে পারে। আর এ উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তাহলে ব্যাক টু ব্যাক এলসির পরিমাণও কমবে। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজনের পরিমাণও বাড়বে। তাই দেশীয় বস্ত্র খাতকে বাঁচাতে হলে সরকারি প্রণোদনা না বাড়ানোর কোনো গত্যন্তর নেই।
কমে যাচ্ছে রফতানি আদেশ : এদিকে দেশের অর্থনীতির সব সূচক যেখানে চরম মন্দা সেখানে একমাত্র রফতানি খাতে কিছুটা ইতিবাচক ধারা রয়েছে বিগত কয়েক মাস ধরে। তবে এখন এ খাতেও বড় ধাক্কা লাগছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আদেশ কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। এর প্রভাবে এরই মধ্যে ইউরোপের বাজারে ২০ শতাংশ পোশাক পণ্যের আদেশ কমে গেছে। বাংলাদেশে মোট পোশাক রফতানির ৫৬ শতাংশ যায় ইউরোপের দেশে। শুধু তাই একক বৃহৎ বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যান্য এলাকা থেকেও পোশাক রফতানি আদেশ কমে আসছে। এতে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে যেতে হচ্ছে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের। ইতোমধ্যে পশ্চিমা ভোক্তারা তাদের ব্যক্তিগত খরচেও বেশি হিসেবি হয়ে উঠেছেন। যে কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ওয়ার্ক অর্ডারের সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক খুচরা পোশাক বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যে পরিমাণ অর্ডার দিয়েছিল, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তার চেয়ে ২০ শতাংশ কম অর্ডার দিয়েছে। সেখানকার ক্রেতাদের কাছে আগের মতো পণ্য বিক্রি করতে পারছে না খুচরা বিক্রেতারা। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভোক্তারা আগের চেয়ে বেশি দামে জ্বালানি ও খাবার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে তারা পোশাকের বাজেট কমিয়েছেন।
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে গ্যাসের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। জ্বালানি ও খাদ্যে খরচ বাড়ায় বাংলাদেশের মতো তৈরি পোশাক সরবরাহকারী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফারুক হাসান উল্লেখ করেন, আসন্ন বসন্ত ও গ্রীষ্মে মৌসুমে ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) কমেছে ২০ শতাংশের মতো। সামনের মাসগুলোয় এ আদেশ আরও কমে যেতে পারে। এ বিষয় নিয়ে আমরা এখন খুবই উদ্বিগ্ন।