Published in বণিক বার্তা on Wednesday, 17 March 2017
বণিক বার্তা ও বিআইডিএসের এ অসাধারণ সম্মাননায় আমি আবেগাপ্লুত। এখানে অসামান্য ব্যক্তিরা জড়ো হয়েছেন। অনেক পুরনো ও নতুন বন্ধুসহ অনেকে সমবেত হয়েছেন। এ সবকিছুই আমার প্রত্যাশা ও ধারণার বাইরে ছিল। যে দুটি প্রতিষ্ঠান এ আয়োজন করেছে, তার একটি সংবাদপত্র, অন্যটি বিআইডিএস। বিআইডিএসের সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষক ছিলাম বিআইডিএসে। আবার অনেকেই হয়তো জানেন না, আমি সাংবাদিকও ছিলাম। ১৯৬০ সাল থেকে গবেষক হিসেবে আমি যা লিখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি লিখেছি সাংবাদিক হিসেবে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে যখন যথেষ্ট লিখছিলাম, তখন আমার সন্তানের স্কুলবন্ধুদের কাছে আমি সাংবাদিক হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে মিলে একটি প্রকাশনাও বের করতাম আমরা।
আজ যে দুটি প্রতিষ্ঠান আমাকে সম্মাননা দিয়েছে, তারা আমার জীবনের দুটি সময়কে তুলে ধরেছে। জীবনের শুরু থেকে যে কাজ আমি করেছি, তা একা করিনি। অর্থনীতি ও বৈষম্য থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের সঙ্গে ছয় দফা দাবি চূড়ান্ত করা পর্যন্ত, এর পর পরিকল্পনা কমিশন ও বিআইডিএসের কাঠামো পুনর্গঠন এবং পরবর্তীতে সিপিডি গঠন— সব কাজই আমি করেছি মানুষের সহযোগিতা নিয়ে। যা কিছু অর্জন, তার সবই হয়েছে সামষ্টিক সামর্থ্য কাজে লাগানোর মাধ্যমে। যারাই আমার সঙ্গে কাজ করেছেন, তারা সবাই আজকের এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্মান বোধ করছেন। আমরা যা কিছুই করেছি, তার মূল কেন্দ্রে ছিল সমতার সমাজ। বাংলাদেশে ফেরার পর এখানকার সমাজ ব্যবস্থাকে যে অবস্থায় দেখেছি, তা ছিল অসুস্থ। এর রূপান্তরের প্রয়োজন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের মাধ্যমে এবং সামাজিকভাবে যাদের সঙ্গে মিশেছি, সবাই একই ধরনের চিন্তা করতাম। ড. কামালের সঙ্গেও আমি গণতন্ত্র ও সমাজ নিয়ে কাজ করেছি। আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যেই এগুলো নিয়ে কাজ করছিলাম।
আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন দেখতে পাই, আমি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছি, তার বেশির ভাগের সঙ্গেই আমার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। আমি কোনো তত্ত্ব তৈরি করিনি, কিন্তু একটি সমাজের ধারণাকে তুলে ধরেছি। এটি তেমন বড় কোনো গুণ নয়, যার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন পাব। কারণ অর্থনীতির জগত্টা তেমন কোনো অর্থ বহন করে না, যদি তা বৃহত্ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়। আমি আমার লেখার মাধ্যমে রাজনীতি, গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
১৯৫৭ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাগত জীবন শুরু করি। আমার প্রথম ছাত্র ছিলেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তার সঙ্গেই আমি প্রথম কথা বলি। এখন ২০১৭ সাল। অর্থাত্ ৬০ বছরের পেশাগত জীবন পেরিয়ে গেছে। এখন আমার অবসর জীবনযাপনের সময়। কিন্তু যখন চারপাশে তাকাই, তখন দেখতে পাই, আবুল মাল আবদুল মুহিত তার জীবনের মুখ্য সময় পার করছেন। তিনি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। কিন্তু শেষ সময়েও রাজনীতিক জীবন আগলে রেখেছেন। এজন্য আমি তাকে সাধুবাদ জানাই। এ দেশের জন্মলগ্নের মৌলিক কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই তিনি এ জীবন বেছে নিয়েছেন। আমার চেয়ে বড় হয়েও তিনি অনেক বেশি সক্রিয়। কিন্তু আমি জীবনের ছোট একটি সময় ছাড়া বাকি সময়টা লেখার কাজ করেছি। আমি কখনই মাঠকর্মী ছিলাম না। যারা লেখার মাধ্যমে গণমানুষ ও তাদের ভাবনা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, তাদের সমস্যা হলো, কোন সময়ে এবং কার জন্য লিখছি, তা নির্ধারণ। আমার জীবনের বিড়ম্বনা হলো, আমি ৪০ পেরোনোর আগেই লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। প্রভাবশালী লেখক ছিলাম। এর কারণ আমি তত্কালীন রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলাম।
বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। বঙ্গবন্ধুর ভালো গুণ ছিল যে, তিনি অসম্ভব মানবিক ছিলেন, সবসময়ই শিখতে চাইতেন। আর সেসব বিষয়ই শিখতে চাইতেন, যে বিষয়গুলোয় তিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তিনি আলোচনা শুনতেন, সেখানে অংশগ্রহণ করতেন ছাত্র হিসেবে। এর পর রাজনীতিবিদ হিসেবে সেসব ভাবনা প্রয়োগ করতেন তিনি। তখন অর্থনৈতিক ধারণাগুলো আরো অনেক অর্থবহ হয়ে উঠত। অর্থনৈতিক ধারণার বাস্তব প্রয়োগ কেমন হতে পারে, তা খুব ভালো করে বুঝতে পারতেন বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মতো নেতারা। পরিকল্পনা কমিশনে আমরা যখন নীতিপরামর্শ দিতাম, তখন যত পরামর্শই দেয়া হতো, তা খুব ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতেন বঙ্গবন্ধু। রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করেই তিনি পরামর্শের কাজ এগিয়ে নিতে বলতেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত নেতারা এভাবেই পরামর্শ বাস্তবায়নের কাজ করতেন। এভাবে আমাদের প্রজন্মে আমরা কাজ করেছি, যা ছিল অনেক আনন্দময় এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। সবাইকে ধন্যবাদ।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের দেয়া বক্তব্যের অংশবিশেষ