Published in মানব জমিন on Monday 6 July 2020
ঘরে ঘরে টানাটানি
ঘরে ঘরে চলছে টানাটানি। সংসার চলছে না। কর্ম আর বেঁচে থাকার লড়াই সর্বত্র। একদিকে মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হচ্ছেন। অন্যদিকে কোথাও কোথাও কাজ থাকলেও বেতনে পড়েছে টান। এর রেশ গিয়ে পড়েছে সংসারে। আগে যেখানে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারবে- এ নিয়ে অনেকেই ছিলেন নিশ্চিন্ত। কিন্তু এখন করোনা তাদের জীবিকাকে ফেলেছে হুমকিতে।
কোনো রকমে চলতে গিয়ে খেতে পারলে দিতে পারছে না ঘর ভাড়া। ঘর ভাড়া দিলে পারছে না সংসার চালাতে। এ এক অন্যরকম বাস্তবতার মুখোমুখি নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তাদের মনে হাহাকার। অন্তর পুড়ছে দহনে। তবুও মুখ খুলে কিছু বলতে পারছে না। তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি কেড়ে নেয়া হয়েছে হাসিও। এ লড়াইয়ে টিকতে না পেরে প্রতিদিনই বহু মানুষ ছাড়ছেন ঢাকা। কেউ কেউ পরিবারকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঢাকা ছাড়ার। কঠিন এ বাস্তবতার মুখোমুখি এখন রাজধানীবাসী। চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ এখন এমন বাস্তবতার সঙ্গে লড়ছেন। দেশের বিভিন্ন জরিপ বলছে, ইতিমধ্যে ঢাকা ছেড়েছেন কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ। প্রতি সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বেরুনোর পথগুলোতে দাঁড়ালে দেখা যায় ট্রাক ভরে মালামাল নিয়ে ঢাকা ছাড়ার দৃশ্য। একই সঙ্গে রাজধানীর বাড়ি বাড়ি টু-লেট টানানোর দৃশ্যও এখন মানুষের নজর কাড়ছে। বাড়িওয়ালারা আগে যে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতেন ১৫ হাজার টাকা। ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ার পর ওই একই ফ্ল্যাট ১২ হাজার টাকাও ভাড়া দেয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতি কখনো দেখেনি কেউ। হঠাৎ যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। বেঁচে থাকার লড়াই এখন মানুষের মাঝে। এ লড়াইয়ে সাজানো সংসার ভেঙে তছনছ হচ্ছে। ছেলে মেয়ের লেখাপড়ায়ও এর প্রভাব পড়বে। সব মিলিয়ে ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছেন ভুক্তভোগীরা। এ প্রসঙ্গে এক ব্যাংকার গোলাম মাওলা বলেন, হঠাৎ বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এক ছেলে পড়ে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে। মেয়ে পড়ে অনার্সে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুললেই পড়বে বেতন দেয়ার চাপ। বেতন কেটে নেয়ায় সংসারে চলছে টানাটানি। ঘরে পিয়াজ থাকলে তেল নেই। স্ত্রীকে বলেছি, খরচ কমাও। আচ্ছা বলুন তো খরচ কীভাবে কমাবো? পেটে যতটুকু নেয় ততটুকুতো খেতে হবে? ডাল ভাত কি প্রতিদিন খাওয়া যায়?
এ ব্যাপারে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনাকালে লকডাউনে মধ্যবিত্তরা তাদের হাতে থাকা সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে। এখন সেই সঞ্চয়ও শেষ। ফলে এই বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হওয়ার পথে। সবকিছু যখন স্বাভাবিক হবে তখন এই বিপুলসংখ্যক মানুষের চাকরি থাকবে না। এটাই হবে সবচেয়ে বড় সংকট। সরকারের যে প্রণোদনা সেখানেও মধ্যবিত্তের কোনো স্থান নেই। তিনি বলেন, আবার আমাদের যে ব্যবস্থা সেখানে সরকার চাইলেও মধ্যবিত্তকে কিছু করতে পারে না। ফলে ভয়াবহ সংকটে মধ্যবিত্তরা। এই পরিস্থিতিতে সরকারের দিক থেকে একজন চাকরিজীবীর শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। এ সময় যেন কাউকে চাকরিচ্যুত করা না হয়, সেদিকে নজর বাড়াতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি চাকরিজীবী, মাল্টিন্যাশনাল ও বড় কোম্পানিতে কাজ করা কিছু মানুষ বাদে অন্যরা সবাই সংকটে আছেন। এই মানুষগুলো সরকারি কোনো কর্মসূচির মধ্যেও নেই। এ কারণেই আমরা নগদ প্রণোদনার কথা বলেছিলাম। আমাদের দেশে ছয় কোটি ১০ লাখ শ্রমিক আছেন। এর মধ্যে এক কোটি শ্রমিক দিন এনে দিন খায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান যারা করেন তাদের সংখ্যা দুই কোটি ২০ লাখ। আমরা সরকারকে বলেছি, চারজন আছেন এমন একটি পরিবারকে মাসে আট হাজার টাকা হিসেবে দুই মাসের ১৬ হাজার টাকা দিতে। তাতে সরকারের ২৭ হাজার কোটি টাকা লাগবে। যা জিডিপির এক শতাংশ। এভাবেই এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করা যেতে পারে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সমপ্রতি এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে বলেন, করোনা নতুন একটি দরিদ্র শ্রেণি সৃষ্টি করেছে। যারা ব্যবসা-চাকরি-পুঁজি হারিয়েছে। কারো কারো বেতন কমেছে। এরা বেশিরভাগই শহরাঞ্চলের। এদের জন্য প্রচলিত কার্যক্রমের বাইরে গিয়ে সরকারের ভিন্নভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন। যদিও এদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। তারপরও সরকারের উচিত এলাকাভিত্তিক বা পেশাভিত্তিক এদের চিহ্নিত করে বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে সহায়তা করা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসব মানুষ হয়তো নতুনভাবে পেশা শুরু করতে পারবে। বেশিদিন না হলেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এসব নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে সহায়তার আওতায় আনা দরকার বলে মনে করেন ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।