প্রকল্প বাস্তবায়নে যে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে, তা হতাশাব্যঞ্জক – গোলাম মোয়াজ্জেম

Originally posted in প্রথম আলো on 24 October 2022

বাংলাদেশ ব্লেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড

প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে, লোকসানে ব্লেড কারখানা

আধুনিকায়নের জন্য নেওয়া প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে দফায় দফায়। উৎপাদন চলছে নামমাত্র। এ কারণে বছর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে।

অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ ব্লেড ফ্যাক্টরি লিমিটেডের (বিবিএফএল) কারখানার সামনেও একটি সাইনবোর্ড রয়েছে। তবে সেটি ভালো করে দেখেও বোঝা কঠিন, কী লেখা আছে।

অনেক অক্ষরই অস্পষ্ট, কিছু মুছে গেছে। মরচেপড়া সাইনবোর্ডের রং জ্বলে গেছে। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, সেখানেও ‘এলোমেলো’ অবস্থা। কারখানার অন্তত অর্ধেক অংশ ভাঙা হয়েছে। সেখানে চলছে নির্মাণকাজ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কারখানার যে অংশ এখনো ভাঙা হয়নি, সেখানে বর্তমানে নামমাত্র উৎপাদন চালু রয়েছে। পুরোমাত্রায় উৎপাদন না হওয়ায় কয়েক বছর ধরে টানা লোকসান দিয়ে চলেছে কারখানাটি।

বিবিএফএলের এই কারখানার অবস্থান গাজীপুরের টঙ্গী শিল্প এলাকায়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) এ কারখানায় ‘সোর্ড’ ব্র্যান্ডের ব্লেড উৎপাদন করা হয়।

প্রকল্প বাস্তবায়নে যে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে, তা হতাশাব্যঞ্জক। শুধু প্রকল্পের ব্যয়ই বাড়ছে না, কারখানার দক্ষ জনবলও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক

এই সোর্ড ব্লেডের মান ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কারখানাটির আধুনিকায়নে ২০১৮ সালের অক্টোবরে একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিএসইসি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সেটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে আরও প্রায় তিন বছর মেয়াদ বাড়ানো হয় প্রকল্পের। এরপরও এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্প শেষে উৎপাদনে গেলে কারখানাটি লোকসান কাটিয়ে উঠবে। যত দিন প্রকল্পের কাজ শেষ না হবে, তত দিন কারখানাটির লাভে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কারখানার বাকি অংশও ভাঙা হবে

বিবিএফএলের কারখানার আধুনিকায়নে চলমান প্রকল্পটির নাম ‘ডিসপোজেবল রেজর ব্লেড প্ল্যান্ট স্থাপন এবং বিদ্যমান প্ল্যান্ট আধুনিকায়ন’।

কর্মকর্তারা বলছেন, এ প্রকল্পের আওতায় আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে কারখানাটির বাকি অংশও ভাঙা হবে। তখন উৎপাদন শূন্যে নেমে যাবে। এরই মধ্যে কারখানার ৩৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ২০ জনকে বিএসইসির অন্য কারখানায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকি অংশ ভাঙার পর বাকি শ্রমিকদেরও অন্যত্র পাঠানো হবে।

১২ অক্টোবর সরেজমিন দেখা যায়, কারখানাটির ভাঙা অংশে নতুন ভবনের ভিত নির্মাণের কাজ চলছে। কারখানার বাকি অংশে ব্লেড উৎপাদনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে ওই দিন সেগুলো বন্ধ থাকতে দেখা যায়।

শ্রমিকেরা জানান, বেশ কিছুদিন ধরে যন্ত্র চালু করা হচ্ছে না। তবে সব কাজ পুরোপুরি থেমে নেই। ব্লেড মোড়কজাত করার কাজ চলছে। কয়েক দিনের মধ্যে ছাপারও (মোড়ক) কিছু কাজ হবে। কারখানার বাকি অংশ ভেঙে ফেলার পর অবশ্য কাজ করার সুযোগ থাকবে না।

বাজারে পাওয়া যায় না সোর্ড ব্লেড

বিএসইসি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বাজারে বছরে ১২০ কোটি পিস ব্লেডের চাহিদা রয়েছে। এতে তাঁদের হিস্যা সামান্যই। তা ছাড়া তাঁদের সোর্ড ব্লেডের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

বিবিএফএলের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ কোটি পিস ব্লেড উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এর মধ্যে উৎপাদিত হয় প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ পিস ব্লেড। এরপরের কোনো অর্থবছরের উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায়নি। কর্মকর্তারাও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানাতে পারেননি।

বিবিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তৌহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সোর্ড ব্লেড সাধারণত সিলেট বিভাগেই বিক্রি বেশি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ব্লেড উৎপাদিত হয়েছে, এর প্রায় সবই গেছে ওই বিভাগে।

১২ অক্টোবর সিলেট নগরীর মির্জাজাঙ্গাল, মাছুদিঘীরপাড় ও জল্লারপাড় এলাকার পাঁচটি দোকান ও একটি সেলুনে খোঁজ নেওয়া হয়। এগুলোর একটিতেও সোর্ড ব্লেড পাওয়া যায়নি। দোকানিরা বলেন, প্রায় এক বছর ধরে সোর্ড ব্লেডের সরবরাহ নেই। সোর্ড ব্লেডের বিক্রয় প্রতিনিধি আসেন না।

সিলেটের মির্জাজাঙ্গাল এলাকার হিমানী স্টোরের পরিচালক নন্দলাল দে প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রতিটি সোর্ড ব্লেড দুই টাকায় বিক্রি করতাম। এখন অন্য কোম্পানির ব্লেড বিক্রি করি।

পুরস্কার পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি এখন লোকসানে

২০১২ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল প্রোডাক্টিভিটি অ্যান্ড কোয়ালিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিল বিএসইসির এই ব্লেড কারখানা। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও উৎকর্ষ অর্জনের জন্য ওই পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৫ সাল থেকে বিবিএফএল যা আয় করছে, তা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকদের বেতনই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিএসইসির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে কারখানাটির ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে আয়-ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী, ওই অর্থবছর থেকে টানা লোকসান দিচ্ছে কারখানাটি। গত পাঁচ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২১ কোটি টাকা।

বিবিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তৌহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বছরে আট কোটি পিস ব্লেড উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ওয়ান টাইম রেজর ব্লেড (একবার ব্যবহার করা যায়) এক কোটি পিস উৎপাদন করা যাবে। পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারলেই প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হবে।

‘প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা হতাশাব্যঞ্জক’

১৯৮৫ সালের জুলাইয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্লেড উৎপাদন শুরু করে বিবিএফএল। এটির আধুনিকায়নে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ছে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২৩ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রকল্পের প্রায় ৫০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ডলারের দাম বাড়ায় মালামালের দাম বেড়েছে। এখন যে সময় নির্ধারিত রয়েছে, ওই সময়ের মধ্যে কাজও না-ও শেষ হতে পারে। তাই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। এতে ব্যয়ও বাড়বে।

আগের অবস্থায় থাকার সময় কারখানাটি বাজারে বড় আকারে ভূমিকা রাখতে পারেনি—এ জন্য শুধু প্রযুক্তিগত দুর্বলতা দায়ী ছিল, নাকি অন্য কারণ ছিল, এমন প্রশ্ন তুললেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে যে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যাচ্ছে, তা হতাশাব্যঞ্জক। শুধু প্রকল্পের ব্যয়ই বাড়ছে না, কারখানার দক্ষ জনবলও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কারখানাটির দায়ভার আছে—নতুন করে চালু হলে পুরোনো দায় মেটানো মাথাব্যথার কারণ হবে। সেদিক থেকে দ্রুত কাজ শেষ করে পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে কারখানাটি পরিচালনা করতে হবে। নয়তো দীর্ঘসূত্রতার কারণে দায় আরও বাড়লে অন্যান্য বাণিজ্যিক সরকারি ইউনিটের মতো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার আশঙ্ক রয়েছে।