অঙ্ক মেলানো সহজ হবে না : ড. মোয়াজ্জেম

Published in সমকাল on Tuesday, 5 June 2018

বাজেট ২০১৮-১৯

নতুন একটি অর্থবছরের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে। আগামী ৭ জুন বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করবেন। বাজেট কেমন হবে, সমাজের বিভিন্ন অংশের কী প্রত্যাশা, সেটা জানার জন্য তিনি ইতিমধ্যে অনেক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। শুনেছেন দাবি ও সুপারিশ। আমরা ধরে নিতে পারি যে, ইতিমধ্যে বাজেট চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। এ বাজেট বাস্তবায়নে বর্তমান মহাজোট সরকার জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় পাবে। ডিসেম্বর নাগাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। যদি এ সরকারই ক্ষমতায় ফেরত আসে, তাহলে ধরে নিতে পারি যে, অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়নে তেমন সমস্যা হবে না। বরং ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। অন্য কোনো দল বা জোট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। অর্থমন্ত্রী এটাও বলেছেন, বর্তমান দায়িত্বে তিনি আর থাকতে ইচ্ছুক নন। নতুন কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করলে এমনকি একই দল বা জোটের সরকার হলেও অগ্রাধিকারে কিছু ভিন্নতা থাকতেই পারে। অর্থমন্ত্রীকে এ বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই নতুন অর্থবছরের বাজেট তৈরি করতে হবে। বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে, ক্ষমতায় পরিবর্তন হোক বা না হোক, বাজেটে যেন বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে না হয়।

আমাদের অর্থনীতি ভালো হচ্ছে, এটা নিয়ে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। তবে প্রত্যাশামাফিক সব সূচক সঠিক স্থানে নেই। তিনি টানা প্রায় দশ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তবে সম্ভবত আগের বছরগুলোতে যতটা স্বস্তি ছিল, এবারে অঙ্ক মেলাতে খানিকটা কষ্টই হওয়ার কথা। এখন আমরা বেশ কিছু অস্বস্তির জায়গা চিহ্নিত করতে পারি। রফতানি আয়ে স্বস্তি আছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণে মাঝে কিছুটা টান পড়লেও স্বাভাবিক ধারা ফিরেছে। তবে অস্বস্তির তালিকা বড়। ব্যাংক ঋণে সুদের হার বাড়ছে, যা বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মূল্যস্ম্ফীতির চাপ রয়েছে। গত বছর বোরো মৌসুম থেকেই চালের দাম বাড়তে শুরু করে, যা ভোক্তাদের কষ্ট দিয়েছে কয়েকটি মাস। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ানোর প্রস্তাব বিবেচনাধীন, যা সাধারণ নাগরিক থেকে শিল্প-বাণিজ্যের উদ্যোক্তা সবাইকে উদ্বিগ্ন রাখছে। জ্বালানি তেলের দাম বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। সস্তায় তেল- এটা এখন অতীতের বিষয়। জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের দায়িত্ব এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অর্থনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় রাখতে হয়। বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ঘটছে। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। বেসরকারি খাত ও দৈনন্দিন বাজারের ক্রেতা, কারও জন্য এ অবস্থা সুখকর নয়। ডলারের মূল্য বাড়লে আমদানি পণ্যের দাম বাড়ে। বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, নানাবিধ ইলেকট্রনিক সামগ্রী, শিল্পের মেশিন ও কাঁচামাল, খাদ্যদ্রব্যসহ অনেক কিছুই আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। ডলারের মূল্য বাড়লে বাজারে এর প্রভাব পড়ে।

বাজেটের শৃঙ্খলা বজায় রাখাও অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সংসদে অর্থমন্ত্রী প্রতি বছর যে বাজেট ঘোষণা করেন, তার শতভাগ বাস্তবায়ন হয় না। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের ৭৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল। এর আগের বছরগুলোর পরিস্থিতি এর তুলনায় কিছুটা ভালো ছিল। এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে বাস্তবায়নের দুর্বলতা। রাজস্ব বাজেটে অনেক সময় প্রাক্কলন অনুযায়ী ব্যয় সম্ভব হয় না। তবে মূল সমস্যা দেখা যায় উন্নয়ন বাজেটের ক্ষেত্রে, যার প্রভাব আবার রাজস্ব বাজেটে পড়ে। রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট ব্যবস্থাপনায় যুক্তদের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টির প্রতি এখন বাড়তি মনোযোগ দিতেই হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট রয়েছে। বিপুল ব্যয়ের এসব প্রকল্প রয়েছে সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায়। দেখা যাচ্ছে, এসব প্রকল্পের কারণে বাজেটে চাপ বাড়ছে, ঘাটতিও বাড়ছে। কিন্তু সরকার চাইলেই তো আয় বাড়াতে পারে না। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব আয় আগের বছরের তুলনায় ৪২ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে এমন অর্জন সম্ভব নয়, সেটা এনবিআর স্বীকার করে নিয়েছে। প্রবৃদ্ধি রাজস্ব আয়ে অর্জিত হতে পারে ১৬-১৭ শতাংশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-এর অনুমান, এ বছর রাজস্ব আয় হবে প্রাক্কলনের অন্তত ৫০ হাজার টাকা কম।

এমন বাস্তবতাতেই অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জন্য বর্তমান বছর থেকেও অনেক বড় অঙ্কের বাজেট ঘোষণা করতে চলেছেন, যা চার লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। আমাদের জানা আছে, চলতি অর্থবছরের জন্য সংসদে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কাটছাঁটের পর এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় না বাড়িয়ে কীভাবে চার লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, সেটা কেউ স্পষ্ট করছেন না। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই রাজস্ব আদায়ের নতুন উৎস খুঁজতে হবে। চলতি অর্থবছরে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায়ের নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা যায়নি ব্যবসায়ীদের আপত্তির কারণে। নতুন অর্থবছরেও এ ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ আসার কথা নয়। কারণ এটা যে নির্বাচনের বছর!

বাজেটের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেটের আকার সাধ্যের মধ্যে রাখা উচিত বলে মনে করি। রাজস্ব আয় বাড়ানো উচিত এবং সম্ভবও, এটা মেনেই বলছি- যতটা আদায় করার মতো প্রশাসনিক সক্ষমতা রয়েছে, ততটাই লক্ষ্যমাত্রা ধরা উচিত। উন্নয়ন বাজেটের ক্ষেত্রেও একই কথা- যেসব প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নের জন্য যতটা অর্থ বরাদ্দ দরকার, ততটাই রাখা চাই।

রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রেও রাজস্ব আয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে। শোনা যায়, নতুন বছরের বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করা হবে। আমাদের জানা আছে, তিন বছরও হয়নি সরকারি কর্মীদের জন্য পে কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় সবার বেতন-ভাতা দ্বিগুণ হয়েছে। মূল্যস্ম্ফীতি বাড়লেও সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর সময় আসেনি। এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। শিল্প-বাণিজ্য-সেবা খাতের প্রসার ঘটছে বেসরকারি খাতে। সরকারি খাতে বেতন বাড়লে বেসরকারি খাতেও চাপ বাড়ে একই ধরনের সুবিধা প্রদানের। যদি বেসরকারি খাত সরকারি খাতের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারে, তাহলে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়, যা কাম্য হতে পারে না। উৎপাদনশীল খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপরেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

অভিজ্ঞতা আমাদের এটাই বলছে যে, সরকার অনুন্নয়ন খাতের ব্যয় অপরিকল্পিতভাবে বাড়ালে পরিকল্পিত উন্নয়নও ব্যাহত হয়। সরকার অনেক প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে সমস্যায় পড়ে। এ ঘাটতি পূরণে ব্যয়বহুল উৎস থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করছে। উদাহরণ হিসেবে সঞ্চয়পত্র বিক্রির কথা বলা যায়। বাজেটে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে দায় বেশি এমন আয়ের উৎস সীমিত রাখা আবশ্যক। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি সূত্র থেকে ঋণ বেড়েছে। এ সূত্র থেকে অর্থের সুদহার দেশীয় সূত্রের ঋণের তুলনায় কম। পরিশোধের মেয়াদও দীর্ঘ হয়ে থাকে। বাজেট বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা দূষণীয় নয়। বরং এভাবে প্রাপ্ত অর্থ বাজেটের ওপর চাপ কমানোয় সহায়ক হয়।

নির্বাচনী বছরের বাজেটে ভর্তুকির চাপ বাড়তে পারে, এমন শঙ্কা করা হচ্ছে। কৃষি উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে রাখতে ভর্তুকি দিলে আপত্তির কিছু নেই। এতে খাদ্যশস্যের বাজারও নিয়ন্ত্রণে থাকে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকির ক্ষেত্রে মূল্য সমন্বয়ের দিকে নজর রাখা চাই। ব্যাংকের মূলধনজনিত সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, তা থেকে সুফল মেলেনি। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ বাবদ প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটা ব্যয় হয়েছে মূলত বেসিক ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের পেছনে। কিন্তু এ দুটি ব্যাংকের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। এখন দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি ব্যাংকও সরকারের কাছ থেকে সুবিধা চাইছে এবং সেটা দেওয়াও হয়েছে। কিন্তু সুদের হার কমানোর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হচ্ছে না।

সরকারের বড় বড় বা মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার সব ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ার কথা। কিন্তু প্রকল্প সময়মতো সমাপ্ত না হলে কিংবা বাস্তবায়ন ব্যয় প্রাক্কলনের চেয়ে বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে চাপ বাড়ে। মেগা প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়িত না হলে তার রিটার্ন আসাও বিলম্বিত হবে। উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ রাখার ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন সক্ষমতাও বিবেচনায় রাখা দরকার। বরাদ্দ রাখা হলো, অথচ ব্যয় করা গেল না- এমন পরিস্থিতি কাম্য নয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেখা গেছে, ফার্স্ট ট্রাকের জন্য চিহ্নিত প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ অর্থের ১৪ শতাংশ ফেরত গেছে। অথচ সামান্য অর্থ বরাদ্দ দিতে না পারায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পণ্য রাখার জন্য অপরিহার্য একটি শেড নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। আশা করব, নির্বাচনের বছর হলেও বাজেটে বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নয়, বরং অর্থনৈতিক ও গুণমান বিবেচনা প্রাধান্য পাবে। বাজেট বাস্তবায়ন হবে নির্বাচনের আগে ও পরে সমানভাবে। আশা থাকবে, অর্থমন্ত্রী এ বাস্তবতা বিবেচনায় রাখবেন। অর্থনীতিতে যেসব সংস্কার অপরিহার্য বাজেট ভাষণে তার দিকনির্দেশনা থাকলে ভালো হয়। বিশেষ করে শুল্ক্ক কাঠামো, ভ্যাট, কৃষি, ব্যাংক, পুঁজিবাজার- এসব বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট পরামর্শ-সুপারিশ থাকতে হবে। আরও নজর চাই কর্মসংস্থানমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রতি।

অর্থমন্ত্রীর সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রত্যাশা বিপুল; কিন্তু সাধ্য সীমিত। কী করবেন তিনি, জানতে পারব ৭ জুন।

 

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)