Published in Banik Barta on Saturday, 8 February 2014.
কার্যকর গণতন্ত্রচর্চায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উদাসীনতা লক্ষণীয়
অধ্যাপক রওনক জাহান
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো।
আপনার দৃষ্টিতে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতন্ত্রের চর্চা কোন স্তরে রয়েছে?
আশির দশকের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র অর্থাৎ ইলেক্টোরাল ডেমোক্রেসি চালু হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্টিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্যম এশিয়ার অনেক দেশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়। এসব দেশেও গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়। এখন পৃথিবীর সবদেশেই জনগণ নির্ধারণ করছে, কারা ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু আমরা যদি উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপকে গণতন্ত্রের মডেল হিসেবে দেখি তাহলে এসব উন্নয়নশীল দেশে দেখি গণতন্ত্র নাম সর্বস্ব এবং শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক। গণতন্ত্রের গুণগত মান এসব দেশগুলোতে ওইভাবে পরিলক্ষিত হয় না। নির্বাচন কেন্দ্র করেও নতুন গণতন্ত্র চর্চাকারী দেশগুলোতে সংঘাত সৃষ্টি হয়। বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো যখন জরিপ করে তখন দেখা যায়, বেশিরভাগ দেশেই নাম সর্বস্ব গণতন্ত্র বিরাজ করছে। গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে বেশকিছু নিয়ামককে মানদণ্ড হিসাবে দেখা হয় যেমন- সেখানে নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে কিনা, আইনের শাসন আছে কি না এবং সবার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে কিনা প্রভৃতি। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো সবসময় এই বিষয়গুলোতে এগিয়ে থাকে। এসব দেশে সরকার সংসদ ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে সব সময় চেক এন্ড ব্যালান্স নিশ্চিত করা হয়। এদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা যায়, গণতন্ত্র চর্চার ইন্ডিকেটরে একটা দুইটা বিষয়ে উন্নতি হয়েছে। কোথাও কোথাও নির্বাচন হচ্ছে; আবার কোথাও কোথাও নির্বাচন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু ষাট কিংবা সত্তরের দশকে যে সেনা শাসন এই অঞ্চল, এমনকি ল্যাটিন আমেরিকাতেও ছিল, তা কিন্তু এখন আর নেই। এখন রাজনীতিবিদরা নির্বঅচিত হয়ে দেশ শাসন করছে এবং সেনাবাহিনী তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি অগ্রগতি। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে বর্তমানে যে বিষয়টি এগোচ্ছে না তা হলো সরকার সংসদ এবং বিচার ব্যবস্থার মধ্যে চেক এন্ড ব্যালান্স বজায় থাকছে না। এখানে দেখা যাচ্ছে, সর্বময় ক্ষমতা থাকছে সরকারের প্রধানের হাতে। সেক্ষেত্রে আইনের শাসন ব্যাহত হচ্ছে বৈকি। রাষ্ট্রের কোনো কাঠামোর মধ্যেই জবাবদিহিতা নেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের দূর অবস্থা দেখে এখন হয়তো ভাবছি, আমরা বিশেষ কিছু করতে পারছি না। কিন্তু আমরা যদি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাব, তাদের গণতন্ত্রও আমাদের মতো নানা সমস্যার মুখোমুখি। যেমন: আফ্রিকার দেশগুলোতে নির্বাচন হচ্ছে; কিন্তু সেখানে প্রচুর দুর্নীতিও হচ্ছে। আবার মালায়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বিরোধী জোটকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিশিষ্ট লেখক ফরিদ জাকারিয়া এসব দেশকে অনুদার গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমাদের অনেকের মনে হতে পারে যে, গণতন্ত্র চর্চার শুরুতেই আমরা হয়তো উত্তর আমেরিকা কিংবা ইউরোপের মতো গণতন্ত্র পাব কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। আমাদের দেশে গণতন্ত্র তো একেবারেই শিশু বলা যায়। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বেশিরভাগ সময়ই আমাদেরকে সেনা সমর্থিত সরকারের অধীনে থাকতে হয়েছে। ১৯৯০ সালে জনগণের আন্দোলনের ফলে সেনা শাসনের অবসান এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আবার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে নতুন একটি সমস্যা তৈরি হয়। সেখান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উৎপত্তি। ২০০১ সালে ঠিকভাবে নির্বাচন হলেও ২০০৬ সালে আবার একটা সমস্যা তৈরি হয়। এটি হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ম্যানিপুলেশনের কারণে। এর ফলশ্র“তিতে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমন। তাদের অধীনে ২০০৮ সালে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। এরপর নির্বাচন নিয়ে আবারও সমস্যা তৈরি হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হল, সেটার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তবে মনে রাখতে হবে, নির্বাচন হলো গণতন্ত্র চর্চার নিয়ামকগুলোর মধ্যে অন্যতম কিন্তু প্রধান নয়। সেখানে আমাদের দেশে বিশেষত ১৯৯০ সালের পর কিছু বাধাবিপত্তি ছাড়া নিয়মিত নির্বাচন হলেও গণতন্ত্রের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমনÑ কার্যকর জাতীয় সংসদ, সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ প্রভৃতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমাদের দেশের বিরোধীদলের নেতারা মনে করেন, রাস্তায় আন্দোলন করলেই বোধহয় গণতন্ত্র আসবে। এমন ধারণা ঠিক নয়। তবে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের অন্যতম একটি নিয়ামক জনগণের কণ্ঠস্বর যাতে গণমাধ্যম একটি ভূমিকা রাখে তা অনেক শক্তিশালী হয়েছে। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে সরকার এখনো পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এটি অবশ্যই একটি ভাল দিক। গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। আমরা গণতন্ত্রের চর্চা করছি, সেটি সন্তোষজনক না হলেও ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের পূর্ণ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি।
দুই দশকে যতটুকু পথ অতিক্রম করেছি, সেটিকে কী আপনি সন্তোষজনক বলবেন?
মোটেই সন্তোষজনক নয়। ২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃতাধীন চারদলীয় জোট যখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করল তখনকার বিরোধী দল আওয়ামীলীগ তা মেনে নেয়নি। আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিলে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। দীর্ঘ দুই বছর একপ্রকার অবৈধভাবে তারা দেশ শাসন করেছে। সে সময়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবেলা করতে হয়েছে। বড় দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসলে সবাই ভেবেছিল সরকারি দল ও বিরোধী দল একই সঙ্গে একটি ব্যবস্থা উদ্ভাবন করবে যাতে নির্বাচন নিয়ে ভবিষ্যতে আর গোলজোগ না হয়। ২০১১ সালে বর্তমান সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তা মেনে নেয়নি। তারা বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে নির্বাচন অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দেয় এবং সেটিই করে। বিএনপি আন্দোলনে নামে। মাঝে জামায়াত তাণ্ডবও চালায়। এভাবে নির্বাচন নিয়ে বিশেষ যে অবস্থান ছিল আমাদের, সেটিও নষ্ট হয়ে গেল। কারণ ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেক্ষেত্রে কার্যকর গণতন্ত্র চর্চায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের মধ্যে স্বদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে কী?
কার্যকর গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো দলই আর হারতে চাচ্ছে না। দুটি দল থাকলে গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনে একদল জয়ী এবং একদল হারবে। বাংলাদেশেও সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। ক্ষমতা একটি ঘূর্ণায়মান প্রক্রিয়ায় চলবে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও ক্ষমতা সেভাবেই এসেছে। একবার বিএনপি পরের বার আওয়ামীলীগ দেশ পরিচালনা করেছে। সেক্ষেত্রে এখন কেন তারা আর হারতে চাইছে না, সে বিষয়টিও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে আইনের শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশে যারাই ক্ষমতায় যাচ্ছে তারাই আইনকে নিজেদের মতো করে নিচ্ছে এবং সেভাবেই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিরোধী দলের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে। সরকারে আসলেই ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সব মামলা তুলে নিচ্ছে আর বিরোধী দলের উপর নিত্য নতুন মামলা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। জেল-জুলুম চলছে। ফলে কোনো রাজনৈতিক দলই আর হারতে চাইছে না। কারণ ক্ষমতায় থাকলে অত্যাচার সইতে হবে না।
নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু নির্বাচনের পরেও তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দরকার। ভারতে নির্বাচনে কেউ হেরে গেলে বলছে না, আমি নির্বাচন মানি না। তারা যদি এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে, তবে আমরা কেন পারব না। বিরোধী দলকে ছায়া সরকার বলা হলেও আমাদের দেশে বিরোধী জোটে থাকা মানে অপরাধী হয়ে যাওয়া। ফলে তারা কীভাবে কাজ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশ কতটা ভূমিকা রাখে?
রাজনীতিতে একটা কথা আছে, ‘পলিটিক্স ইজ লোকাল’ অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরেই রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করে, যার একটি নিজস্বতা আছে। এখানে প্রতিবেশী বা বিশ্বের অন্যান্য দেশ কেবল গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরির রূপরেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে। সে অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রতিবেদন তৈরি করলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চা খারাপ হিসেবেই স্থান পাবে। গবেষণা প্রতিবেদনগুলোও তাই বলছে। মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুর তারা কিন্তু পশ্চিমাদের মতামত তেমন একটি গ্রাহ্য করে না। না করার অন্যতম কারণ তাদের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী। আমাদের অর্থনীতি এখন রেমিট্যান্স, গার্মেন্টসহ কিছু খাতের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। পশ্চিমাদের প্রভাব আমাদের উপর তেমন একটা নেই ঠিক যেমনটা ছিল সত্তর কিংবা আশির দশকে। আমরা এখন সহায়তা নির্ভর নই, ফলে পশ্চিমাদের কথা না শুনলে তারা তেমন কিছুই করতে পারবে না। তবে এও সত্য, বিশ্বায়নের এ সুযোগ সবার মত উপেক্ষা করেও আমরা চলতে পারব না।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীকার আন্দোলনের সময় আমাদের সামনে গণতন্ত্রের দুটো মডেল ছিল। এক. পাকিস্তান আর দুই. ভারত। পাকিস্তান ধর্মীয় রাজনীতি করছিল এবং সেখানে কার্যকর গণতন্ত্র ছিল না। অন্যদিকে ভারত সেক্যুলার রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের চর্চা করছিল। তখন বিষয়টা সহজ ছিল এবং আমরা ভারতকেই আমাদের গণতন্ত্র চর্চার মডেল হিসেবে পছন্দ করেছিলাম। বর্তমানে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের পক্ষ ও বিপক্ষ কিংবা পাকিস্তানের পক্ষ ও বিপক্ষ হয়ে যাওয়াতে বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে পরেছে। পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করছে বলে সেখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে। তাদের অর্থনীতির অবস্থা আমাদের থেকেও খারাপ। অন্যদিকে আমাদের প্রতি ভারতের আচারণ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ভারত একটি বড় দেশ বলে তাদের প্রভাব আমাদের উপর থাকবেইÑ এমনটি ভেবে নেয়াও দূর্বলতা। আমাদের রাজনীতিতে ভারত একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময়ে বিএনপি যখন ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসল, আমরা ভাবলাম এবার হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ‘ভারত’ বিষয়টা উঠে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। মূল কথা হলো, আমাদের রাজনীতি আমাদের মত করেই চলবে এবং তাকে সেভাবেই চলতে দেয়া উচিৎ।
আমাদের গণতন্ত্র চর্চায় কোথায় কোথায় সংস্কার প্রয়োজন? অনেকে আমাদের গণতন্ত্রের মডেল নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
আমাদের দেশের যেকোনো লোককে জিজ্ঞেস করলেই বলবে, তারা দুর্নীতি চায় না। ফলে দুর্নীতি রোধ করতে না পারাটা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে। তাদের আইনের শাসনের প্রতি আরো শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিতে পেরেছে। কিছু কিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেছে। তাদের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও এটি প্রক্রিয়ার মধ্যে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এখানে গণতন্ত্রের চর্চা বার বার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক মতবাদে ভিন্নতা থাকবেই; কিন্তু সমস্যা রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান করতে হবে। আমরা বর্তমানে কিছুটা আফ্রিকার দেশগুলোর মতো আচরণ করছি যেখানে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। আমরা যদি রুয়াণ্ডার হুটু এবং টুটসিজের মত বিভাজন সৃষ্টি করে চলি তাহলে আমাদের গণতন্ত্রের পথ সুগম হবেনা।
পরিবারতন্ত্র কি গণতন্ত্রের জন্য অন্তরায়?
আবার ভারতের দিকেই তাকানো যাক। সেখানেও পরিবারতন্ত্রই চলে আসছে। কংগ্রেস এখন পর্যন্ত পরিবারতন্ত্রই চর্চা করছে। কিন্তু সেখানে পরিবারতন্ত্র নেতৃত্বের একটি দিক মাত্র। নেহেরু যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তার সমকক্ষ আরো অনেকেই ছিলেন। নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এবং তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নেতা গণতান্ত্রিক মনমানসিকতা সম্পন্ন হলে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্র তেমন কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
এরপর যে বিষয়টি বলা দরকার তা হলো নেতৃত্বের গুণাবলি ও সঠিক নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে ভারতের একটি ঘটনা বলা দরকার। নেহেরুরই শাসনামলে স্পিকার নেহেরুকে চিঠি দিলেন, তিনি তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে চান। এ জন্য তিনি আসতে চান। নেহেরু বললেন আপনি স্পিকার হয়ে আমার কাছে আসবেন- তাতে স্পিকারের পদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। বরং আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আপনার কাছে আসছি। এখানে নেহেরু একটি মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন যে প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের মধ্যে কি রকম সম্পর্ক থাকা দরকার। স্পিকার যাতে প্রধান মন্ত্রীর অজ্ঞাবহ তা যেন মনে না হয়। কিন্তু আমাদের দেশে কি সেরকম নেতৃত্ব আছে? অবশ্যই নেই। সেক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্ব না থাকাটাই আমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একটি বড় অন্তরায়।
বর্তমান অবস্থায় সরকার ও বিরোধী পক্ষের প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
বর্তমান সরকারের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দিন বদলের সনদে যে প্রতিশ্রতি দিয়েছে তারা সেটি রক্ষায় কাজ করবে। দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা করবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। বিরোধী দলকে নিপীড়নের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে।
বিরোধী দলের প্রতিও একই পরামর্শ থাকবে, তারা যেন দলের ভিতর গণতন্ত্রের চর্চা বৃদ্ধি করে। ছায়া সরকারের মতো কাজ করতে হবে তাদের। রাস্তার সহিংস আন্দোলন বন্ধ করতে হবে। কার্যকর গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে তারা যদি নিজেদেরকে প্রমান করতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বাড়বে বৈ কমবে না।
আর জনগণের নিশ্চয়ই সরকার ও বিরোধী পক্ষের জবাবদিহিতা প্রতিনিয়তই চাইবে। জনগনের কণ্ঠস্বর পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব গণমাধ্যমের পালন করতে হবে।