টেলিভিশনঃ লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য

মোঃ আবু সালেহ

বর্তমানে আমাদের সন্তানেরা বেড়ে উঠছে ভারতীয় হিন্দি আর বাংলা টিভি চ্যানেল গুলো দেখে। এইসব ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো কোন এক অদ্ভুত কারনে তাদের অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু হিসেবে পারিবারিক কলহ, হিংসা, বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, নির্যাতন, হানাহানি, বিচ্ছেদ, অবৈধ সম্পর্ক, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদি বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়। তাদের ভাবনায়- এটা নাকি মহিলা দর্শকদের ধরে রাখার কৌশল, ক্ষমতাশীল করার উপকরণ- কেননা মহিলারাই মূলত এই গনমাধ্যমটির মূল দর্শক (গ্রহিতা/ভোক্তা)!!

আমাদের সমস্যা হল যে, মহিলাদের পাশাপাশি এগুলো তাদের সন্তানেরা দেখছেন এবং অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। ফলে ভারতীয় জীবন দর্শন, ধর্মীয় ও সামাজিক আঁচার সম্পর্কে ধরনা বাড়ছে। যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে নিশ্চিত প্রভাব ফেলবে। ভাল বা মন্দ সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কেউ দিতে পারে না। জীবন দর্শন এক জটিল সমীকরণের ফলাফল- যেখানে উপকরণ গুলো আসে আর্থসামাজিক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে।  আমরা শৈশবে আমেরিকান টিভি অনুষ্ঠান দেখে বড় হয়েছি এবং ভীষণ ভাবে প্রভাবিত হয়েছি। তবে সবাই নিশ্চয় স্বীকার করবেন-সেই সব আমেরিকান টিভি অনুষ্ঠানগুলো এডিট করে দেখানো হত, অধিকাংশই ছিল উচ্চমান সম্পন্ন, রুচিশীল, ইতিবাচক, আনন্দদায়ক, গঠনমুলক এবং শুভ পরিনতিবাচক। ভারতীয় হিন্দি আর বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো অধিকাংশই ঠিক তার উল্টো। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্রভাব এখনেই দেখা যায় অধুনা কিছু বিত্তশালীদের বিবাহের নানা আয়োজনে- মাত্রাহীন নাচানাচি, মাত্রাহীন রূপসজ্জা, অতিরঞ্জিত পোশাক পরিচ্ছদে।

প্রত্যেক দর্শকের অধিকার আছে তাদের পচ্ছন্দমত টিভি অনুষ্ঠান দেখার। আবার প্রত্যেক অভিবাবকের দায়িত্ব আছে সন্তানের ভালো মন্দ বিবেচনার। তাই অভিবাবক, টিভি অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে নিজেকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তেমনি সন্তানের ক্ষেত্রে সদবিবেচনাও প্রয়োগ করতে পারেন। পরিবারের বাইরে, সমাজেরও একধরনের দায়বদ্ধতা থেকে যায়। সমাজগত ভাবেও একটা ‘কমুনিটি’ যৌথ ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাদের এলাকায় কোন কোন টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করা উচিৎ কোনটি নয়। বাংলাদেশে এইরকম উদাহরণ আছে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির চাপে কিছু টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল একটা সময়ে।  সমাজের উপরে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে তার নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়া। সার্বিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া যে, কোন টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে পারবে, কোনটি নয়। রাষ্ট্রের নানা বৃহত্তর রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক বিবেচনা থাকতে পারে, তাই সিদ্ধান্ত নেয়াটা কিছুটা জটিল ও কঠিন।

কিন্তু একটা ‘কমুনিটি’ যৌথ ভাবে স্থানীয় কেব্‌ল অপারেটরকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে কিছু চ্যানেল বন্ধ করে দেবার জন্য। আবার, আমেরিকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নানা সামাজিক সংগঠন বা পেশাজীবী সংগঠন স্পন্সরদের কাছে ধরনা দিতে পারে যেন কিছু ক্ষতিকর অনুষ্ঠানের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়া যায়। এগুলো হোল নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি যা ব্যবহার করে নেতিবাচক টিভি সম্প্রচার ব্যাহত করা যায় -অন্যের অধিকার হরণ না করে- শান্তিপ্রিয় উপায়ে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হোল চাহিদা। ভারতীয় হিন্দি আর বাংলা টিভি চ্যানেল গুলোর চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকবেই। এদেশে দর্শক আছে। বাংলাদেশে এতো টিভি চ্যানেল থাকতে দর্শক কেন ভারতীয় হিন্দি আর বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো দেখতে চায় সেটা বুঝতে হবে। প্রায় সবাই স্বীকার করেন যে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের মান অনেক ভাল। কিন্তু সেগুলো দর্শকের কাছে পৌছুতে পারছে না। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, অধিক সময় নষ্ট, অনুষ্ঠানের পূর্ব ঘোষিত সময় মেনে না চলা- এগুলোই মুল কারন।

বাংলাদেশের টিভি সম্প্রচারের একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা ছিল। ছিল গর্ব করার মত ঐতিহ্য। দর্শকদের একধরণের রুচি তৈরি হয়েছিল। তাই আশা ছিল যে, রুচিহীন টিভি অনুষ্ঠান বা চ্যানেলগুলো  এদেশে বেশীদিন চলবে না। নিম্নমানের অনুষ্ঠান দর্শক দেখবে না। চাহিদা থাকবে না তাই সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি, মুলত ব্যবসায়িক কৌশলের কারনে। এদেশে প্রায় বিনা বাধায় ভারতীয় হিন্দি আর বাংলা টিভি চ্যানেলগুলো ঢুকেছে- কিন্তু বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তাই রাষ্ট্র যেখানে জনস্বার্থ রক্ষায় সফল হয়নি, সেখানে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সাংগঠনিক প্রতিরোধ জরুরী।  সামাজিক দায়বদ্ধতা ও স্বর্ণালি ঐতিহ্য অনুসরণ করে নানা পন্থায় দর্শককে ভালো টিভি চ্যানেল বা অনুষ্ঠান মুখী করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনাকাঙ্ক্ষিত পথে যেতে পারে।