Published in সারাবাংলা on Sunday 30 May 2020
করোনা সংকট: কেমন বাজেট চান অর্থনীতিবিদরা?
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আগামী বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট হতে হবে টিকে থাকার বাজেট। এই বাজেট হবে বাঁচা-মরার বাজেট এবং অর্থনীতিকে ধরে রাখার বাজেট। করোনাভাইরাস সংকটের কারণে কারও পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয়, এই বাজেটে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে মত তাদের। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি বাজেটে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার জন্য পদক্ষেপ নিতেও বলেছেন তারা। সেজন্য আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও কর্মসংস্থানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি অর্থনীতিবিদদের।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আগামী বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতকে। এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী। এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দ দেওয়া অর্থ যেন জনগণ পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অর্থ সবসময় অপব্যবহার ও তছরূপ হয়। আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এখনো প্রায়ই এই খাতের অর্থ সরাসরি চুরি হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা কিভাবে টিকে থাকতে পারি, তার ব্যবস্থাও করতে হবে। বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রণোদনা বলে যেসব দাবি করছে, সরকারকে সেদিক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অনেক প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোকে অগ্রধিকার দেওয়ার কিছু নেই। নানা কারণে সেসব প্রকল্প নেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্য থেকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। চূড়ান্তভাবে বলা যায়, বাজেটে ঘাটতি যতই বাড়ুক না কেন, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও কৃষি— এই তিনটি খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, এ বছরের বাজেট হওয়া উচিত টিকে থাকার বাজেট। কারও পরিস্থতি যেন খারাপের দিকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এই বাজেটে। এই বাজেট হবে আমাদের বাঁচা-মরার বাজেট। আমাদের অর্থনীতিকে ধরে রাখতে যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই থাকা উচিত এই বাজেটে।
তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য খাত আগে থেকেই দুর্বল। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের ওপর বেশ চাপ পড়েছে। আর কেবল করোনা নয়, করোনার বাইরেও যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা আছে, সেগুলো মোকাবিলা করতে এই খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ দিতে হবে। শুধু বরাদ্দ দিলেই হবে না, সেই বরাদ্দ যেন ঠিকমতো খরচ হয়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। এসব বরাদ্দ দিয়ে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামোর পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স ও হেলথ টেকনোলজিস্টও নিয়োগ দিতে হবে। এটাই হবে বাজেটের শীর্ষ অগ্রাধিকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গর্ভনর বলেন, করোনার কারণে আমাদের অনেক মানুষের আয় হঠাৎ করে কমে গেছে। যেসব মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, তাদের অনেকেই নিচে নেমে গেছে। অনেকের চাকরি চলে যাচ্ছে, কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, বিশেষত নগদ সহায়তা বাড়াতে হবে। অর্থনীতি আগের মতো চালু করা না গেলে প্রয়োজনে একাধিকবার নগদ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা বিবেচনায় কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে হবে। যেকোনোভাবে কৃষির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। কৃষি খাতকে পুনর্বাসন করতে হবে। কৃষি খাত যদি টিকে থাকে, তাহলে আমরাও টিকে থাকতে পারব।
স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও প্রণোদনার অর্থ প্রকৃত অভাবগ্রস্তদের কাছে পৌঁছানো— আগামী বাজেটে এই তিনটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে গেছে। সেটাকে জাতীয়ভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে সেবার মান নেই বললেই চলে। এসব ক্ষেত্রে কেবল অর্থ দিলেই হবে না, অর্থের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে রেখে হাসপাতালগুলোতে দক্ষ লোক নিয়োগ দিতে হবে।
বাকি দুইটি বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের খাত্যের সংস্থান নেই। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এসব অসহায় পরিবারের কাছে খাদ্য ও নগদ টাকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর দেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা সঠিকভাবে সঠিক লোক পাচ্ছেন কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। ধনী লোকেরা যেন প্রণোদনার টাকা খেয়ে না ফেলতে পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের কর প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ বছর খুব একটা কর আসবে না। আগামীতে বাজেটে তাই কর প্রশাসনকে পুনর্গঠন করে করে করনীতি নতুনভাবে সাজাতে হবে, যেন আমরা সঠিক কর পেতে পারি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানও আগামী বাজেটে চারটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। বিষয়গুলো হলো— স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপি‘র মাত্র দশমিক ৭০ শতাংশ। এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও বেশ কম। অবার স্বাস্থ্য খাতের এই বরাদ্দও সবসময় সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। তাই স্বাস্থ্য খাতে আমাদের বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনা সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের পর পরই আমাদের কৃষি, সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর বরাদ্দ দেওয়া অর্থ যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।